কোভিড-১৯ তথা করোনা ভাইরাস মহামারীতে গতকাল ২৪ জুন ২০২০ খ্রিস্টাব্দ তারিখে বাংলাদেশের একজন জ্যেষ্ঠ ও অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ বিচারকের মৃত্যুতে বিচার বিভাগ সহ গোটা দেশের মানুষ শোকে মুহ্যমান। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী, করোনা দুর্যোগের মধ্যেও ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে আদালত পরিচালনা ও অন্যান্য দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অধস্তন আদালতের বিভিন্ন পদস্থ ২৬ জন বিচারক (সহকারী জজ হতে জেলা জজ পর্যন্ত) করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। শঙ্কার বিষয় হচ্ছে এ সংখ্যা দিন দিন উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে! গণমাধ্যম হতে আরো জানা যায় যে, আদালতের কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট সহায়ক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে এ সংক্রমণের হার তিন গুণেরও বেশি! সুপ্রিম কোর্টে সহায়ক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে এ সংখ্যাটি ২৬ জন এবং অধস্তন আদালতে ৭১ জন। শহীদ বিচারক (সিনিয়র জেলা জজ) জনাব ফেরদৌস আহমেদ লালমনিরহাটে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালের বিচারিক দায়িত্ব পালনকালে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন। করোনার উপসর্গ দেখা দিলে গত ০৪ জুন কর্মস্থল লালমনিরহাট থেকে ঢাকায় আসেন এবং নমুনা পরীক্ষায় কোভিড-১৯ পজিটিভ হওয়ায় তিনি চিকিৎসা গ্রহণ শুরু করেন। পরবর্তীতে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সি.এম.এইচ) এ স্থানান্তর করা হয়। দশ দিনের অধিক সময় ধরে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করে গতকাল ২৪ জুন, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ তারিখ সন্ধ্যা ৭.৩০ ঘটিকার সময় তিনি সি.এম.এইচ. এ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুর পূর্বে চার দিন তিনি উক্ত হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে এই প্রথম কোন বিচারক মৃত্যুবরণ করলেন। একদিকে জনগণের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকার অন্যদিকে করোনা মহামারীর টানাপোড়েনে বাংলাদেশের বিচারক ও বিচার বিভাগীয় পরিবারের মধ্যে এ মৃত্যু গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে সীমিত আকারে জরুরি বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করলেও বিচারকরা প্রসিকিউশন, পুলিশ, সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী সহ প্রশাসনিক বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সংস্পর্শে থেকে বিচারিক কাজ করতে হয় বিধায় তাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে মর্মে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের ধারণা। উল্লেখ্য যে, বিচারক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার তথ্য সংগ্রহ, চিকিৎসা ও সুরক্ষা সেবা সহ অন্যান্য সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় পৃথক পৃথক মনিটরিং সেল গঠন করে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশন অধস্তন আদালতের বিচারক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য একটি কোভিড বিশেষায়িত হাসপাতালের সাথে সমঝোতা স্বাক্ষর করেছেন। দ্রুততম সময়ে করোনার ব্যাপক বিস্তৃতির কারণে বিশাল জুডিসিয়াল পরিবার-কে করোনা মোকাবেলায় হিমসিম খেতে হচ্ছে। প্রয়াত জেলা জজ ফেরদৌস আহমেদ এর মৃত্যুতে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক (এম.পি.) এবং বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশন পৃথক পৃথক শোকবার্তায় মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। মরহুমের জানাজা আজ ২৫ জুন ২০২০ খৃষ্টাব্দ তারিখ সকাল ১০.০০ ঘটিকায় তাঁর নিজ বাড়ি জামালপুর জেলা সদরের আমলা পাড়ায় অনুষ্ঠিত হয় এবং তাঁকে জামালপুর পৌর কবরস্থানে দাফন করা হয়। বিচারক ফেরদৌস আহমেদ ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের বিচার কর্ম বিভাগে মুন্সেফ (বর্তমান সহকারী জজ সমমর্যাদার) পদে যোগদান করেন দীর্ঘ ৩৬ বছর ভোলার জেলা ও দায়রা জজ, লালমনিরহাট ও কুমিল্লার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালের বিচারক, কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ সহ বিভিন্ন জেলার জজকোর্ট ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে প্রেষণে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। বিচার কর্ম বিভাগের অগ্রজ ও অনুজ সহকর্মী এবং বিচার কর্ম সংশ্লিষ্টদের নিকট তিনি বিনয়ী, সদালাপী, বন্ধু বৎসল, মানবিক ও ন্যায়নিষ্ঠ বিচারক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস একজন কর্মে দক্ষ, সৎ, অভিজ্ঞ ও অভিভাবক তুল্য সদস্যকে হারালো। মৃত্যুকালে তিনি দুই কন্যা, এক পুত্র ও সহধর্মিণী সহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে যান।
লেখকঃ মোহাম্মদ দিদার হোসাইন
মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট , ঢাকা !
বাংলাদেশ সময়: ২৩:৩১:০২ ৭৭৭ বার পঠিত #করোনা #ফেরদৌস আহমেদ #বিচারক #শহীদ