কাজিদা বলতে আমার প্রজন্ম একজনকেই বোঝে, তিনি কাজি আনোয়ার হোসেন, সেবা প্রকাশনীর প্রাণপুরুষ। আমার প্রজন্মের কাছে সেবা প্রকাশনী কী- এটা বলে বোঝানো যাবে না। এটা আবেগের বিষয়, উপলব্ধির বিষয়। আমার কৈশোরে, আমার তারুণ্যে আমি যেকোন পত্রিকার স্টলের সামনে গিয়ে বা গ্রন্থ বিপনিতে ঢুকে প্রথমেই “সেবার” মনোগ্রাম খুঁজতাম।” সেবার” মনোগ্রাম দেখলেই আনন্দে বুক ভরে উঠত। আমার মত এমন কিশোর, এমন তরুণ বাংলাদেশের সব জেলাতেই ছিল। আমার মত এমন অ-নে-ক মানুষ তাদের বেড়ে ওঠা, বড় হবার স্বপ্ন দেখা, জীবনে একটা কিছু হতে চাওয়া এবং অনেকেরই একটা কিছু হওয়ার পেছনে “সেবা প্রকাশনীর” অবদান রয়েছে। “সেবা প্রকাশনী” একা একটা প্রজন্মকে দাঁড় করিয়েছে। এটি অনেক বিজ্ঞজনই জানে না, কিংবা জানলেও স্বীকার করে না।
স্মৃতি থেকে বলি, ১৯৬৬ তে যখন মাসুদ রানা প্রথম প্রকাশিত হয়, সুশীল বাংলাদেশ কাজি আনোয়ার হোসেনকে “খোলা মাঠে নগ্ন করে চাবুক” মারার রায় দিয়েছিল। সেবা প্রকাশনীর প্রতি বিরূপ মনোভাব ছিল সকল বোদ্ধা শ্রেণীর। কঠিন তিরস্কার ও অবমাননাকর সমালোচনা করেছেন অনেকেই। কাজিদা থেমে যাননি। এগিয়ে গেছেন, একটা প্রজন্মকে বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ পেতে সাহায্য করেছেন। মাসুদ রানাকে নিয়ে মৌলিক উপন্যাস লিখেছেন পরপর ২টি, পাঠকের কাছে আজো “সবচেয়ে প্রিয়” বা “আগের মত হয় না” বলতে যে বইগুলোর রেফারেন্স দেন, সে বইগুলোর অন্তর্ভুক্ত। এরপর তিনি বিদেশি বইয়ের অনুসরণে লিখতে শুরু করেন। মনে আছে, থান্ডারবল যখন পড়ি, মাসুদ রানার “দুঃসাহসিক” এর কথাই মনে পড়ছিল। বিদেশি ভাষার উপন্যাসের অনুসরণে লেখা এসব উপন্যাসের শুরুর দিকে এমন একটা কথা লেখা থাকত, “বিদেশি কাহিনির ছায়া অবলম্বনে/ বিদেশি কাহিনি অনুসরণে”। কাজিদা নিজের মৌলিক লেখার বাইরে কখনো দাবি করেননি যে এগুলো তার লেখা। আমরা যারা কাজিদা বা সেবা প্রকাশনীর পাঠক ছিলাম (এবং আছি), তারা জানি প্রায় ২৫ জন “ভূত লেখক” মাসুদ রানা লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে কাজিদা’র নামে, লেখক পেয়েছেন সম্মানী। বিদেশি কাহিনির কিছু নাম পাল্টে আর আমাদের সংস্কৃতি উপযোগী করে পূণঃলিখন এসব উপন্যাস কিন্তু একটাও কারো মৌলিক রচনা নয়। এগুলো পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়েছে “মাসুদ রানা” ব্র্যান্ডের কারণে।
আজকে যখন কেউ দাবি করেন, “মাসুদ রানা” কাজি আনোয়ার হোসেনের নয়, অন্য কারো, তখন ঠিক কোন্ অনুভূতি ভেতরে কাজ করে, বুঝতে পারিনা। তব্দা খাওয়া বলে আমাদের এলাকায় একটা শব্দ আছে, আমার কাছে এমনই লাগছে।
“ভূত লেখক” হিসেবে লেখার সাধারণ শর্তই থাকে যে, লেখক এর মালিকানা দাবি করতে পারবেন না। লেখার বিনিময়ে সম্মানী পাবেন, ব্যস। জানিনা, কাজিদা তাঁর ভূত লেখকদের সাথে কী চুক্তি করে ছিলেন। কেউ মাসুদ রানার ২৬০ টি উপন্যাস লিখতেই পারেন, তাতে তিনি সেই বইগুলোর জন্য সম্মানী ও রয়ালটি দাবি করবেন এবং প্রাপ্য হবেন, কিন্তু “মাসুদ রানা” টাইটেল তার হবে কিংবা তিনি “মাসুদ রানা” এর দাবীদার হবেন- এটা হতে পারে না। বিদেশে শার্লক হোমসকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে অনেকেই লিখেছেন, কেউ আজ অবধি বলেনি, শার্লক হোমস, স্যার আর্থার কোনান ডয়েল এর নয়। একইভাবে জেমস বন্ডও ইয়ান ফ্লেমিংয়েরই আছে বরাবর।
লেখক সম্মানী পাবেন, রয়ালিটি পাবেন- এটাই কাম্য। এ ন্যায্যটার জন্য যদি আইনি পদক্ষেপে নিতে হয়, সেটি খুব লজ্জার। সে লজ্জা প্রতিষ্ঠানের, কাজিদা’র, এবং আমাদের। আশা করি এমন লজ্জার অবসান হবে। একই সাথে, “মাসুদ রানা” (এবং “কুয়াশা”) চরিত্রের স্রষ্টা কাজি আনোয়ার হোসেন - এ নিয়ে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আমাদের মাঝে থাকবে না।
(লেখক একজন উপ কর কমিশনার। বিদ্যালয় জীবন থেকেই লেখালেখি করেন। ফেসবুকে মূলত কবিতা চর্চা করলেও রম্য রচনা, ছোট গল্প,অণুগল্প ও লিখেন। বই প্রকাশে প্রবল অনীহা থেকে অদ্যাবধি কোন গ্রন্থ প্রকাশ করেননি।)
বাংলাদেশ সময়: ২১:২৬:৩১ ৯৬৬ বার পঠিত #কাজি আনায়ার হোসেন #পাঠক মূল্যায়ন #মাসুদ রানা #সেবা প্রকাশনী