স্বপন চক্রবর্তী, বঙ্গ-নিউজ: ব্যাংকারদেরকে করোনা ভাইরাসের ছুটির মধ্যেও যথারীতি অফিস করতে হচ্ছে। যানবাহন বন্ধ থাকার পরও দুরদুরান্ত থেকে অফিস করে যাচ্ছে তারা। সমন্বয়ের অভাবে প্রথমে অনেক ব্যাংকারকে রাস্তায় পুলিশের হাতে নাজেহাল হতেও দেখা গেছে। আক্রান্ত হয়েছে বা অসুস্থতা দেখা দিবার পরও কাসটডিয়ান হবার কারনে অফিস যেতে হয়েছে। ব্যাংকারগণ কোন সময়েই লম্বা সরকারী ছুটিও ভোগ করতে পারে না। ঝুঁকি নিয়ে অফিস করতে গিয়ে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছে। প্রণোদনা প্রদানের আশ্বাস প্রদান করা হলেও এখনও তা অনিশ্চিত। সকল সম্মুখ যোদ্ধাদের মত করোনা কালীন ঝুঁকি নিয়ে সেবাদানকারী এই ব্যাংকারদের নাম কোথাও তেমন উল্লেখ হয়নি। এরই মধ্যে “বিএবি” সব ব্যাংককে একটি চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে যে আগামী দেড় বছরের জন্য ব্যাংক কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা ১৫ শতাংশ কমাতে হবে। বোনাস,ইন্ক্রীমেন্ট,নতুন নিয়োগ ও পদোন্নতি বন্ধ রাখার পক্ষেও সুপারিস করা হয়েছে।
এরই প্রতিবাদ জানিয়েছে ব্যাংক কর্মকর্তাগণ। কর্মকর্তাদের ক্ষোভের প্রেক্ষাপটে “বিএবি” চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেছেন, এটা নির্দেশনা নয়, কেবল পরামর্শ। বেসরকারি ব্যাংক-উদ্যোক্তা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) রোববারের এক চিঠিকে কেন্দ্র করে এই ক্ষোভ।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে লকডাউনের মধ্যেও তাদের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়েছে, যে কারণে অনেকে আক্রান্তও হয়েছেন। অথচ এখন বেতন কমানোর খড়গও নামছে।
তবে তাদের এ ধরনের চিঠির এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে এ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ।
বিএবির চিঠির খবর শুনে সোমবার সকাল থেকে ক্ষোভ ছিল কর্মকর্তাদের মধ্যে। বিভিন্ন ব্যাংকে কর্মকর্তাদের এ নিয়েই আলোচনা করতে দেখা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যাংকের কর্মকর্তা বলেন, “ভাই, বেতন কমলে ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার চালাব কী করে। করোনাভাইরাস মহামারীতে খরচ তো কমেনি; উল্টো বেড়েছে। আমরা চলবো কী করে?”
বিএবির চেয়ারম্যান নজরুল মজুমদার বলেন, “কোনো ব্যাংককেই বেতন কমাতে নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। বলা যায় এক ধরনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
“আমরা ব্যাংক মালিকরা বসেছিলাম। বাস্তব অবস্থা নিয়ে আলোচনা করে যে সব কর্মকর্তার বেতন ৪০ হাজার টাকার উপরে, তাদের আগামী দেড় বছর ১৫ শতাংশ বেতন কমানোর বিষয়ে সবাই একমত হয়েছিল। সে সিদ্ধান্তের আলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল।”
এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল মজুমদার বলেন, “সিদ্ধান্ত নেবে ব্যাংকগুলো। যদি তারা মনে করে কমাবে, তাহলে কমাবে। আর যদি মনে করে কমাবে না, তাহলে কমাবে না।”
বেতন কমে গেলে কর্মকর্তাদের সংসার চালাতে সমস্যা হবে কি না- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আমরা তো যাদের বেতন ৪০ হাজারের বেশি, তাদের বেতন কমাতে বলেছি। যারা কম বেতন পান, তাদেরটা তো কমাতে বলিনি। সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সঙ্কটের সময় তো সবাইকেই ছাড় দিতে হবে।”
এক্সিম ব্যাংকে সিদ্ধান্তটি কার্যকর হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে এটা আমরা করেছি। কর্মকর্তারাও মেনে নিয়েছে।”
এদিকে বিএবির এই তৎপরতায় ক্ষোভ জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি বলেন, এ ধরনের চিঠি ব্যাংকগুলোর কাজে হস্তক্ষেপের শামিল। বিএবি কোনো অবস্থাতেই তা দিতে পারে না।
“বিএবি হচ্ছে ব্যাংকের চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানদের সংগঠন। কোনো ব্যাংকের যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র ওই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের। বিএবি পরিচালনা পর্ষদকে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে কোনো অবস্থাতেই চাপিয়ে দিতে পারে না।”
ইব্রাহিম খালেদ বলেন, “ব্যাংক কোম্পানি আইনের ক্ষমতাবলে এখনই বাংলাদেশ ব্যাংকের এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা উচিৎ। দ্রুত করা উচিৎ।
“বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখার কোনো কারণ নেই। একটি সংগঠন থেকে বেতন কমানোর উস্কানি দেওয়ার সাহস তারা কোথা থেকে পায়, সরকারকেও সেটা খতিয়ে দেখতে হবে।”
কৃষি ব্যাংকের সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত বেশ কয়েকটি ব্যাংকের সাবেক এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, “আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে, একটি ব্যাংকের ৯০ শতাংশ টাকার মালিক কিন্তু আমানতকারীরা। উদ্যোক্তা মালিকদের অংশ মাত্র ১০ শতাংশ। ১০ শতাংশের মালিক যারা, তারা এমন স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত কোনো অবস্থাতেই নিতে পারেন না।”
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান এবং ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার বলেন, “বিএবি কোনো ব্যাংকের রেগুলেটরি বডি নয়; তারা কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে পারে না। বেতন কমানোসহ যে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।
“কোনো ব্যাংক যদি মনে করে, কঠিন এই পরিস্থিতিতে তাদের ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বেতন কমানো দরকার কমাবে; আর যদি মনে করে কমানোর প্রয়োজন নেই, কমাবে না। কমানোর প্রয়োজন হলে কতোটুকু কমাবে, কিভাবে কমাবে সব সিদ্ধান্তই নেবে ব্যাংকের বোর্ড। অন্য কেউ নয়।”
বেতন কমানোর খবরে কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ-আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে স্বীকার করেন ইফতেখার।
এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বলেন, “সঙ্কটকালে ব্যাংকের খরচ কমাতে হবে ঠিক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেটা কর্মকর্তাদের বেতন কমিয়ে কেন? অন্য নানা উপায়েও তো খরচ কমানো যায়! সে সব পথ বেছে না নিয়ে স্পর্শকাতর এ সিদ্ধান্তের কথা কেন আসছে, বুঝতে পারছি না।
“এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। কর্মকর্তাদের বেতন কমলে তাদের মধ্যে হতাশা কাজ করবে। কাজের গতি কমে যাবে। ব্যাংকাররা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। তাদের মনোবল ভেঙে পড়বে। সে ক্ষেত্রে ব্যাংকও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
বেতন কমানোর খবরে কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ-হতাশা ‘খুবই’ স্বাভাবিক বলে মনে করেন এই ব্যাংকার।
বাংলাদেশ সময়: ১৯:২৮:০০ ১২৯৭ বার পঠিত #অর্থনীতি ব্যবস্থাপনা #ক্ষুব্দ ব্যাংকার #বিএবি #বেতন #হ্রাস করা