মো: রফিকুল ইসলাম
বঙ্গ-নিউজ-
হিমালয়ের একটি গিরিপথ লিপুলেখ, যেখানে ভারতের উত্তরাখন্ড, চীনের তিব্বত এবং নেপালের সীমানা গিয়ে মিশেছে। গত ৮ই মার্চ ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং লিপুলেখ এলাকায় প্রায় ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি লিঙ্ক রোডের উদ্বোধন করেন। যে পথ ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান কৈলাস-মানস সরোবরের মধ্যকার দূরত্ব অনেকাংশে হ্রাস করবে। একই সাথে চীন ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক রুট হিসেবেও ব্যবহৃত হবে। লিপুলেখ লিঙ্ক রোড উদ্বোধনের পর পরই নেপাল তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তাদের দাবি- লিপুলেখ হচ্ছে তাদের ভূখণ্ড। কাজেই ভারত তার মধ্যে রাস্তা তৈরি করে নেপালের সার্বভৌমত্বে আঘাত হেনেছে।
ভারত-নেপাল সীমান্ত বিরোধের পটভূমি
অষ্টাদশ শতকে ভারত ব্রিটিশ শাসনের অর্ন্তভুক্ত ছিল। ব্রিটিশরা ভারত সীমান্ত নেপাল পর্যন্ত বর্ধিত করতে চেয়েছিল। তৎকালীন সময় নেপাল ছিল গোর্খা সাম্রাজ্যের অধীন। ১৮১৪ সালে নেপাল ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। প্রায় ২ বছর যুদ্ধ চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ১৮১৬ সালে দুই পক্ষের মধ্যে সুগৌলী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বিরোধপূর্ন অঞ্চলে ব্রিটিশরা এবং গোর্খা সাম্রাজ্য কোনটি কতটুকু অঞ্চল শাসন করবে, তা নির্ধারণ করাই ছিল সুগৌলী চুক্তির মূল বিষয়। সুগৌলী চুক্তির ফলে নেপাল সিকিম এবং দার্জিলিং এ তাদের আধিপত্য হারায় এবং নেপাল সীমান্ত নির্ধারণের জন্য দুটি নদীর গতি পথকে ব্যবহার করা হয়। নেপালের পশ্চিম অংশটি মহাকালি নদীর গতিপথ এবং পূর্বের অংশটি মিচি নদীর গতিপথ অনুযায়ী নির্ধারিত হবে।
নেপালের পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত মহাকালি নদীর মূল গতিপথ যেটি লিম্পিআধুরা পর্যন্ত প্রবাহিত, চুক্তি অনুযায়ী সেটিই ছিল নেপালের সীমানা। কিন্তু ব্রিটিশরা পরর্বতীতে অনুধাবন করে যে, লিম্পিআধুরা থেকে লিপুলেখ অঞ্চলটি চীনের সাথে যোগাযোগ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এ ভাবনা থেকে ব্রিটিশরা ১৮৬০ সালে তাদের মানচিত্র পরির্বতন করে ফেলে। ব্রিটিশরা তখন লিপুলেখ থেকে গুঞ্জি অবধি মহাকালি নদীর একটি ছোট শাখাকে ধরে নেপালের পশ্চিমের আংশটি ভারতের অর্ন্তভুক্ত করে। ঐ সময় ছোট এই অঞ্চলটি নিয়ে নেপাল খুব একটা চিন্তা করে নি।
১৯৫০ সালের ৩১ জুলাই, ভারত ও নেপালের মধ্যে ‘পিস অ্যান্ড ফ্রেন্ডশিপ ট্রিটি’ স্বাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তির বলে নেপাল ও ভারতের মধ্যে ওপেন বর্ডার সিস্টেম চালু হয়। ফলে নেপাল ও ভারতের নাগরিকরা অবাধে একে অপরের দেশে ভ্রমণ, ব্যবসা, পড়ালেখা, চাকরি, সম্পত্তির মালিকানা নিতে পারে। দুই দেশের নাগরিকের জন্য পাসপোর্ট বা পারমিশনেরও দরকার হয় না। এ চুক্তির ফলে নেপাল সামরিকভাবেও ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তৃতীয় পক্ষ থেকে অস্ত্র আমদানির ক্ষেত্রেও ভারতের অনুমতির প্রয়োজন হয়। ১৯৬০ সালের দিকে নেপাল বুঝতে পারে, এ চুক্তি নেপালের বিপক্ষে গিয়েছে। নেপালি নাগরিকদের অতিমাত্রায় ভারতে গমন, সেখানে থাকা ও চাকরি করার কারণে এবং নেপালের অর্থনীতি অতিমাত্রায় ভারত নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ায়, নেপালে এ চুক্তির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠতে থাকে।
1962 সালের ইন্দো-চীন যুদ্ধের সময় নেপাল সীমান্তে নেপালের অনুমতি নিয়েই ভারতীয় সৈন্যরা অবস্থান নেয়। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত ভারতীয় সৈন্যরা নেপাল সীমান্তে অবস্থান করছে।
সীমান্ত বিরোধের বিষয়টি নেপালে ১৯৯০ সালে নতুন করে সামনে আসে, যখন নেপালে সংসদীয় গনতন্ত্রের সূচনা হয়। গণতান্ত্রীক সরকার তখন দেশের সীমান্ত নিয়ে নতুন ভাবে চিন্তা করে এবং তারা উপলদ্ধি করে যে, লিম্পিআধুরা পর্যন্ত অঞ্চলটি নেপালের অংশ। তখন থেকেই এই অঞ্চলটি বিরোধপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পায়।
২০০০ সালের জুলাই মাসে অটল বিহারী বাজপাই ও তখকালীন নেপালের প্রধানমন্ত্রী সীমান্ত সমস্যা সমাধান নিয়ে আলোচনায় বসেন। কালাপানি সীমানা নির্ধারন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। কিন্তু সেই চেষ্টা র্ব্যথ হয় যখন ভারত তাদের সৈন্যদের উপস্থিতি কালাপানি সীমান্ত থেকে প্রত্যাহারের আপত্তি জানায়।
মহাকালি নদীর উৎস নিয়ে নেপাল ও ভারতের মতের ভিন্নতা
এখন সুগৌলী চুক্তি অনুসারে দুই দেশের সীমানা নির্ধারিত হলেও সমস্যা ঠিক কোন জায়গায়? ভারত ও নেপালের মধ্যে সীমানা নিয়ে সমস্যার কারণ হচ্ছে মহাকালি নদীর উৎস নিয়ে দুই দেশের ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্ব। নেপালের দাবি হচ্ছে- এই নদীর উৎপত্তি হয়েছে লিম্পিআধুরা থেকে। যে জায়গা লিপুলেখ থেকে পশ্চিম দিকে অনেক ভেতরে। অন্যদিকে ভারতের দাবি- মহাকালি নদীর উৎপত্তি হয়েছে লিপুলেখ থেকে। এর বিপরীতে নেপাল বলছে, ভারত যে নদীকে মহাকালি নদীর উৎস বলছে, যা হচ্ছে সেই নদীরই একটি উপনদী। এদিকে বিতর্কিত ভূখণ্ডটি দুটি নদীর মাঝখানে পড়েছে।
সাম্প্রতিক উত্তেজনা
২০১৫ সালের মে মাসে ভারত ও চীন একটি বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করে, যেখানে তারা লিপুলেখ পাসকে বাণিজ্য পথ হিসেবে ব্যবহার করবে। এই চুক্তির ফলেই ভারত নেপাল সীমান্ত নিয়ে নতুন উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। গত বছর নভেম্বরে ভারতের প্রকাশিত নতুন মানচিত্রে কালাপানি ও লিপুলেখ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
৮ই মার্চ উত্তরাখণ্ডের পিথাউরাগড়-লিপুলেখের মধ্যে একটি লিংক রোডের উদ্বোধন করেছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। তার পর থেকেই বিবাদের শুরু। নেপালের দাবি, ওই ভূখণ্ড তাঁদের। রোড উদ্বোধনের সময় কাঠমান্ডুতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে নিজেদের আপত্তির বিষয়টি উল্লেখ করে একটি কূটনৈতিক নোট দেয় নেপাল সরকার। কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে এক বিবৃতিতে জানিয়ে দেওয়া হয়, ওই ভূখণ্ড কোনওদিনই নেপালের ছিল না। তাই সেখানে রাস্তা নির্মাণের অধিকার ভারতের রয়েছে। এর পর থেকেই নেপালের রাজনীতিতে ভারত বিরোধী স্লোগান উঠতে শুরু করেছে। উল্লেখ্য, নেপাল ও ভারতের মধ্যে ১৬ হাজার কিলোমিটারের বেশি খোলা সীমান্ত রয়েছে। যার মধ্যে বেশ কয়েকটি জায়গার অধিকার নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ রয়েছে।
ভারতের চিফ অব আর্মি স্টাফ মনোজ নারাভানে মন্তব্য করেছিলেন, লিপুলেখের লিংক রোড নিয়ে নেপাল সরকারের আপত্তির কারণ অন্য। এক্ষেত্রে অন্য কেউ কলকাঠি নাড়াচ্ছে। আর সেই দেশের কথা শুনেই ভারতের বিরুদ্ধে গর্জাচ্ছে নেপাল। দুই ভূখণ্ড কালাপানি ও লিপুলেখকে নিজেদের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নেপাল সরকার। নেপাল সরকারের মুখপাত্র ও অর্থমন্ত্রী য়ুভরাজ খাটিওয়াদা জানিয়েছেন, খুব তাড়াতাড়ি নতুন মানচিত্র প্রকাশ করা হবে। স্কুল-কলেজের বইপত্রে, সরকারি প্রতীকে এবং অফিস-আদালতের সব কাগজপত্রে এবার থেকে এই নতুন মানচিত্র থাকবে।
নতুন মানচিত্র র্নিধারণে নেপালের সংবিধান সংশোধন
নেপালের নতুন রাজনৈতিক মানচিত্র এবং নতুন জাতীয় প্রতীক নির্ধারণে দেশের সংবিধান সংশোধনে সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন দিয়েছে নেপালের পার্লামেন্ট। নতুন এই মানচিত্র ও প্রতীকে এখন আনুষ্ঠানিকভাবে লিপুলেখ, কালাপানি এবং লিম্পিআধুরাকে নেপালের ভূখণ্ড হিসাবে প্রদর্শিত হবে। ১৮১৬ সালের সুগৌলী চুক্তি অনুযায়ী নেপাল এই দাবি করছে, যদিও ভারত সেই দাবি নাকচ করে দিয়ে আসছে। মে মাসের মাঝামাঝিতে বিতর্কিত ভূখণ্ড কালাপানি আর লিপুলেখকে নিজেদের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নেপালের সরকার।
৯ জুন সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব পাস হওয়ার পর সদস্যরা রীতি অনুযায়ী দীর্ঘক্ষণ ধরে টেবিল চাপড়ে উল্লাস প্রকাশ করেন। এখন প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী বান্দারি অনুমোদন দেয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে সংবিধান সংশোধন কার্যকর হবে।
নেপাল বর্তমানে ভারতের প্রভাব বলয় থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। আর তার পেছনে যে চীনের প্রভাব রয়েছে তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু বর্তমানে যে বিষয়টি নিয়ে বিরোধ তার সাথে চীনও জড়িত। প্রতিবাদ শুধু ভারতকে জানিয়ে লাভ নেই। এ বিষয়ে সমাধান করতে হলে চীনের সাথেও নেপালকে বসতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২২:৩৫:৫১ ২১৪০ বার পঠিত #ভারত-নেপাল সীমান্ত #হিমালয়