আধুনিক প্রযুক্তির সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে বিস্ময়কর আবিষ্কার জোকারবার্গের ফেসবুক। আপনি যেমনটি চাইবেন সব পাওয়া যায়। এটি আরব্য উপন্যাসের দৈত্যের মত । সার্চ দিলেই সামনে এসে দাঁড়ায়-হুকুম করুন মালিক। কে জানতো এটি এতো জনপ্রিয় হবে ? মার্ক জোকারবার্গ নিজেও হয়তো ভাবেননি। আজ যদি ঘোষণা দেওয়া হয় যে আগামী মাস হতে ফেসবুক বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সব আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। তাহলে কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে ? আমারতো মনে হয় হঠাৎ অক্সিজেন বন্ধ করে দেবার ঘোষণার মতো হবে। আপামর জনসাধারণ, বিশেষ করে যুব সমাজ রাস্তায় নেমে শ্লোগান শুরু করবে “চলবে না চলবে না”।
আমরা অভিভাবকগণ ছেলে-মেয়েদেরকে কত শাসিয়েছি।,বিজ্ঞের ন্যায় উপদেশ দিয়েছি, এটা কখনো ধরবে না। এটা লেখাপড়া নষ্ট হয়। এটা বাজে জিনিষ। এখন আমরাই ছেলেমেয়েদের কাছে ধরণা দেই-বাবা একটু দেখাতো, কোনটা দিয়ে শেয়ার দিতে হয়। লাইক কোনটা ইত্যাদি। কত মহিলার যে ভাত নষ্ট হয়,তরকারী কড়াইতে দিবার মনে না থাকায় চূলায় আগুন ধরে। দুধ পুড়ে অঙ্গার। কত সমস্যা। বলে শেষ করা যায় না। পুরুষদেরও যে নেই তা বলা যাবে না। স্ত্রী বাজার যেতে বলে গেল। স্বামী মোবাইলে কি লোড দিয়ে সেটা দেখতে উদগ্রীব। লেগে গেল । স্ত্রী এসে জিজ্ঞেস করলো দোকান থেকে যে লবন আনতে বলে গেলাম এক ঘন্টা আগে, এনেছ নাকি ? -স্বামীর উত্তর: বলেছিলে নাকি ?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোবাইল নিষিদ্ধ হওয়ার কারনে ছেলেমেয়েদের কত যে মোবাইল ধ্বংস করা হলো তার খবর পত্রিকান্তরে বহু দেখেছি। সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন ঢুকে গেল ছাত্রছাত্রীদের মোবাইলে। ক্লাস হচ্ছে মোবাইলে। টিচার বলে দিলেন, আমার এই লেখাটি আমার ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। দেখে নিও। ছাত্ররা তখন বাধ্য মোবাইল দেখতে।
ফেসবুক একটি সামাজিক নেটওয়ার্কিং ওয়েবসাইট যা বন্ধু, পরিবার ও ব্যবসায়িক সহযোগীদের সংযুক্ত করে। এর একটি জনপ্রিয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে ছবি,অডিও, ভিডিও সংযুক্ত,সংগ্রহও সংরক্ষণ করা যায়। এতে দেশের খবর, দশের খবর, প্রাকৃতিক দূর্যোগ,বিভিন্ন অপরাধ জনিত খবর ইত্যাদি সবই পাওয়া যায়,যা আমরা গণ মাধ্যমে কিঞ্চিত পরেই পাই। সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত অনেক সংবাদকে সরকারও গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তদন্তও হয় দ্রুত। যতদুর মনে হয় পৃথিবীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষই এখন ফেসবুক ব্যবহার করে থাকেন। এটি একটি শক্তিশালী সোশ্যাল মিডিয়া। করোনাকালীন দূর্যোগের জন্য আমরা এখন গৃহবন্দী। যদি ফেসবুক না থাকতো তাহলে সময় কাটানোটা খুবই দূর্বিষহ হয়ে উঠতো। তাছাড়া আমাদের বন্ধুবান্ধব,আত্মীয়স্বজন,সহকর্মী কে কখন কিভাবে আছেন, করোনা পজিটিভ কি না,সুস্থ হচ্ছেন কিনা তা সবই ফেসবুকের কল্যাণেই প্রতি মুহুর্তে জানতে পাচ্ছি। এখান থেকে বিস্তর জ্ঞানার্জন করা যায়। এমন অনেক বন্ধু আত্মীয় বা সুহৃদজন আছেন, দীর্ঘদিন যাদের কোন যোগ সূত্র ছিল না। তাদের সাথেও এই ফেসবুকের কল্যাণে আবারও বন্ধন তৈরী হয়েছে। কথা হয়েছে,ছবি আদান-প্রদান, ভিডিও কলে কথা বলা হয়েছে এবং প্রতিনিয়তই হচ্ছে। শুভ দিনে শুভেচ্ছা বিনিময় ও দুর্দিনে দুঃখ প্রকাশের সুযোগ হয়েছে। আরও একটি সুবিধা হলো ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা যায় কোন মাশূল দিতে হয় না। চাপায় যতক্ষণ কূলায় চালিয়ে যান।
ফেসবুকের যেমনি ভালো দিক আছে, তেমনি কিছুটা খারাপ দিকও আছে। এটি এমনই একটি নেশা যে, অধিকাংশ জনগণ আমরা বেশী নিমগ্ন হয়ে যাই এই ছোট্ট একটা মুঠোফোনের মোহনীয় যাদুতে। কেহ কেহ মন্তব্য করেছেন যে মোবাইলের নেশা আর আফিমের নেশায় নাকি পার্থক্য নেই। আমরা মোবাইলের কারনে গতানুগতিক কত কাজই না বিনষ্ট করি। ঘুম থেকে উঠেই দেখতে চাই কে,কি পোস্ট করলো? কোন পোস্টে কত রিয়েক্ট ও কমেন্ট এলো? এতে ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব বাড়ে- সামাজিক বন্ধুত্ব কমে যায়। পরিবারের সাথে সময় কাটানো হয় কম।.এটা মাঝে মাঝে আমাদের মনে ঈর্ষার কারন হতে পারে। যেমন কেউ দামী আইফোন, গাড়ী,বাইক বা ঈদে কত দামী ল্যাহেঙ্গাটি কিনলেন, সে সব পোস্ট দিলে মনে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।,মনোকষ্টেরও কারণ হয় কারো কারো। আবার করোনায় গৃহবন্ধী গরীবদের যখন এক বেলা খাদ্যের চিন্তায় দিশে হারা,তখন আমরা উপাদেয় খাদ্য দিয়ে ইফতারী তৈরীর ছবি আপলোড করি। কেউ আবার মিষ্টি তৈরী করে লিখে দেই সহস্তে ঘরে তৈরী। তখন একটুও ভাবিনা নিরন্ন উপবাসি এই মানুষ গুলোর কথা।
ফেসবুক আমাদের আবার সুরক্ষাও নষ্ট করে দেয়। আইডি হ্যাক করে নানা ধরনের স্ক্যান্ডাল, মিথ্যা খবর বা ছবি দিয়ে ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত দেওয়া সহ অনেক অনর্থ ঘটায়। ভার্চুয়াল জগতের মানুষ আর রক্তমাংসের মানুষ কখনোই এক হয়না। প্রতিদিন আমরা ফেসবুক ব্যবহার করছি। এখন বিশেষজ্ঞ গণের ভাবার সময় এসেছে যে, এটা আমাদের জীবনকে নষ্ট করে দিচ্ছে নাকি বেশী উপকারই করছে।
ফেসবুকে আমার, আপনার,সবারই অনেক অনেক বন্ধু আছেন। আমরা তাদেরকে নিয়ে গর্ববোধ করি। কতবড় উচ্চ পদের একজন কর্মকর্তা । তিনি আমার ফেসবুক বন্ধু। কিন্তু কিছু কিছু উচ্চ পদের ফেসবুক বন্ধু আছেন যাঁরা কোনদিন কোন কমেন্ট,লাইক বা কোন ধরণের সাড়ই দেন না। তখন আবার মনটা খুব আহত হয়। ভাবি, কেন তবে এতো দীর্ঘ আমার ফ্রেন্ডলিষ্ট। তখনই বুঝতে পারি আমার আর তাঁর মর্যাদা এক নয় কখনো। তবে হ্যা, তাঁদের ব্যস্থতা,চিন্তা চেতনা অনেক ব্যপক নিঃসন্দেহে। পরে আবার ওনারা অবসর জীবনে বেশীরভাগই খুঁজখবর নিতে ভুল করেন না। তখন আবার মনকে সান্ত্বনা দিতে হয় এই বলে যে,Chair Makes a Man,
ফেসবুকের বন্ধুদের মধ্যে কিছু আছেন সক্রিয়,আর কিছু বন্ধু নিষ্ক্রিয়। নিষ্ক্রিয় মানে তাঁরা কোন পোস্টেই সাড়া দেন না। রিয়েক্ট, কমেন্ট কিছুই করেন না। তাঁরা একটু আভিজাত্য নিয়ে চলতে চান। তারা ভাবেন, মন চাইলে সাড়া দেবো নইলে দেব না এমন। চেষ্টা কর উচিৎ ফ্রেন্ডলিস্টের প্রায় সবার পোস্টেই সাড়া দিতে। যারা কোনদিনও আমার পোস্টে সাড়া দেন না,তাদের পোস্টেও আমি সাড়া দেই। মনে হয় এটা আমার ইচ্ছা অনিচ্ছা নয়, কিছুটা দায়িত্বও বটে। নইলেতো আনফ্রেন্ড করে রাখাই শ্রেয়। যাঁরা নিজেরা রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে ফ্রেন্ড হয়েছেন,তাঁদের প্রতি ধন্যবাদ/ কৃতজ্ঞতা/অভিনন্দন প্রকাশ করাও একটা ভদ্রতা। এতে নিজের মহত্বই প্রকাশ পায়। আমি ফেসবুকে আসি ২০১৭ এর ডিসেম্বরে। এইটুকু সময়ের অভিজ্ঞতার আলোকেই এই বিশ্লেষণটি। হয়তো কিছু অসম্পূর্ণ কিছু অপ্রয়োজনীয় হতে পারে।
কাউকে ছোট করে বলছিনা । প্রসঙ্গক্রমে একটি বাস্তব বিষয় আজ লিখতে চাই , আমার এক ক্লাসমেটকে আমি বার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাই, সে একসেপ্ট করলো। পরক্ষণেই ইনবক্সে লিখছে, আমি কেন তাকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে বিরক্ত করছি। আমি পাঁচ মিনিট ভাবলাম। সে ভাগ্যগুণে আজ প্রশাসনের উঁচু পদে আসীন।, তাঁকে বিরক্ত করার মতো অধিকার আমার আর নেই। তবে আমি রিকোয়েস্ট পেলে ভেবে দেখে অবশ্যই একসেপ্ট করি। অনেক উচ্চপদে আসীন স্যারদেরক শুভেচ্ছা জানালেও একটু আঁতকে উঠেন এই ভেবে যে, বোধ হয় কোন আব্দার আছে আমার কাছে। আমি চেষ্টা করি আমার সামর্থ অনুযায়ী অধস্তন অস্থায়ী কর্মচারী,আনসার,পিয়ন,সিকিউরিটি গার্ডদের পোস্টেও সাড়া দিতে। তাদেরকে সন্তুষ্ঠ করতে আমার কোন ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয় না। - এতে আমার কখনোই মনে হয়না যে আমার সম্মান হানি ঘটছে। ওরা খুশী হয়,আমারও ভালো লাগে। আমার ফ্রেন্ডলিস্টের বেশীর ভাগ বন্ধুই আমাকে প্রচুর স্নেহ করেন,ভালোবাসেন। কেউ কেউ শ্রদ্ধাও করেন। আমি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। তাঁদেরকে ধন্যবাদ জানাই। আমি শুধু আমার কথাই বলছিনা,লক্ষ্য করেছি অনেকের প্রোফাইলেই,একটা পোস্টে ফ্রেন্ডলিস্টের এক চতুর্থাংশেরও কম লোকের সাড়া মিলে।
কিছু বন্ধু আছেন অকারণেই ইনবক্সে টুনটুন করেন। বিরক্তিকর কিছু প্রশ্ন করেন। যেমন -. আপনার বাড়ি কোথায়?. এখন কি করছেন? আপনি কি করেন? আপনি কি খেয়েছেন? কি দিয়ে খেয়েছেন? নাস্তা কি হয়েছ? আপনার একটা ছবি দিবেন কি?. আপনার ফোন নং টা কি দেয়া যাবে? . আপনার পরিবারে কে কে আছেন?. কখন ঘুমাবেন? আপনার পাশে কে আছেন? এসব প্রশ্ন করে খুঁজ নিতে উৎসুক অনেক বন্ধু আছেন। তাদের এই আন্তরিকতার জবাব দিতেই তো ব্যস্ত থাকতে হয়। আমার মনে হয় মেয়ে মানুষদের নাম দেখলে বোধ হয় খুঁজ খবর নিবার দায়িত্বটা তাদের একটু বেড়েই যায়। যদিও এগুলোর প্রায় অধিকাংশই প্রোফাইলেই থাকে। আমি মনে করি অহেতুক এ প্রশ্নগুলো করে উভয়েরই মূল্যবান সময়টা নষ্ট করলেন।
আমি মনে করি নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণকে রিকোয়েস্ট পাঠানো বা রিকোয়েস্ট গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকাই ভাল। যেমন. যাঁরা ভূয়া নাম ব্যবহার করে আসছেন। . যাঁরা ছদ্মনামধারী অথবা বিকৃত নামধারী।.যাঁরা প্রোফাইলে নিজের ছবি না রেখে অন্যকিছুর ছবি ব্যবহার করেন। যেমন জীবজন্তু, পাখি ইত্যাদির ছবি রেখেছেন। যাঁরা জন্মতারিখ উল্লেখ করেননি।. যাঁরা অহেতুক ম্যাসেঞ্জারে বিরক্ত করেন।. যাদের ওয়ালে আপত্তিকর লেখা,অডিও, ভিডিও ক্লিপ বা নোংরা
ফেসবুকে ইদানিং নতুন আর একটি সংযোজন লক্ষ্য করা গেছে। সেটা হলো বিবাহ। দেশ আর বিদেশ নেই। জড়িয়ে পড়ছে প্রেমে। অভিভাবকগণ থাকেন অন্ধকারে। এর মধ্যে দু একজন বিদেশী বধুও আমরা পেয়েছি। আনন্দ সংবাদই বটে। কিন্তু বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে প্রতারণার ঘটনার সংবাদই আমরা পাই। কারন ছবির সাথে মিল নেই,বয়সের অমিল, গায়ের বর্ণ আশানুরুপ হলো না। সেই কল্পিত রাজকণ্যাও নয়। পেশায় সে আদৌ বড় ব্যবসায়ী বা বড় একজন কর্মকর্তা নয়। আরো আরো কত যে বিড়ম্বনা। ভুলের জগতে হা হুতাশ করা। এমনকি সর্বশান্ত হয়েছে বা পৈত্রিক প্রদত্ত জীবনটাও দিতে হয়েছে।
পরিশেষে এটাই বলতে চাই যে, ফেসবুকে আমরা একজন অন্যজনের পাঠক/ পাঠিকা বা বন্ধু/ বান্ধবী। এতে আমাদের মন্তব্য,প্রতিমন্তব্য থাকবে- তবে ওগুলোর ভাষা যেন শালীন হয়। আরো একটি কথা আজকাল অনেকেই প্রোফাইল লক করে থাকেন, সমস্যা নেই, আপনার কর্মস্থলটা উল্লেখ রাখবেন যাতে অন্যজন আপনাকে সম্যক জানতে পারেন। স্রষ্টা আমাদের সুস্থ ও সুন্দর রাখুন- এটাই কামনা। আমার সকল ফেসবুক বন্ধুদের শুভকামনা ও ধন্যবাদ।
বাংলাদেশ সময়: ২১:০৬:২৫ ১৫২৮ বার পঠিত #জোকারবার্গ #নিত্য ভালো লাগা আধুনিক প্রযুক্তি #ফেসবুক