চারিদিকে সবুজসবুজ পত্রপল্লবের সুশীতল ছায়ায় আচ্ছাদিত তারই মাঝে নয়নাভিরাম ” হাসনা হেনা ভিলা ” বাড়ীটির চারিদিকে মাধবী লতার দ্বারা আবৃত দৃষ্টি নন্দন কাড়া।
বাসার সামনে সান বাঁধনো পুকুরঘাট তার চতুর্দিকে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুপারি গাছ, সেই বাসায় বাস করে অফিস কর্ম কর্তা মারুফ হোসেন। এই বৈশ্বিক মহামারিতে ফ্ল্যাটের বাসিন্দা, দখিনা দিকের ব্যালকনিতে বসে দিন রাতে বেশি সময় পার করে। কখনো ফেসবুক, টুইটার, পেপার আর মোবাইল প্যাচাল ,বদ্ধ ঘরে , আর তার কত ভালো লাগে। দেখতে দেখতে বিশ রমজান শেষ , সামনে ঈদ ।
শিশির ভেজা ভোর চৈত্রের সময় ও কোকিলের কুহু কুহু ডাক, পত্র পল্লব নিজস্ব ভংগিতে দোল খায়। ওদের শাখা প্রশাখায় তর তর করে ঘুরেফিরে দুইটি ঘুঘু পাখি । যে যার ঠোঁট দিয়ে বিলি কাটে। নিজের সুখ ও সুখনভ ভাগ করে নেয়। প্রকৃতির এই অপরুপ শান্তি মারুফ সাহেব বসে বসে তা অনুভব করেন। আবার কখনো যে যার মতন আপন মহিমায় চুপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। ওরা যেন দৈনন্দিন দিনের জাবেদা নিরুপন করে।
দৃষ্টি সীমার শেষ সীমান্তে ওই এপার্টমেন্টের ছাদে দুরন্ত ছেলেরা ঘুড়ি উড়ায় ,ঘুড়িতে ঘুড়িতে পাল্লা পাল্লি দেয় কাটাকাটি খেলে আবার বাহাস করে।ওরাই আর কতক্ষন ঘরে থাকে ,অভিভাবকেরা স্বাস্হ্য বিধির কথা ভেবে মিষ্টি শাসনের মাধ্যমে ঘরে নিয়ে যায় , যেতে চাইনা মন তবু ও যেতে হয় ।
মারুফ সাহেব ঘরের দখিনা বেলকুনি দিয়ে দেখে। আবার মাঝে মাঝে ফেসবুকে কে কি পোস্ট দিল তার উপর লাইক কমেন্টস করে আর মাঝে মাঝে বেদনা বিধুর মৃত্যুর ঘটনা দেখলে চোখের কোণায় অশ্রু জমে৷
কখনো কখনো ব্যালকনির ভিতর ময়না পাখির সঙ্গে গল্প গুজব করে । বাসায় কথা বলার লোক নেই সহধর্মিনী বাসার কাজের সহকারি কে করোনার ভয়ে ছেড়ে দিয়েছে৷ তার দম ফেলার উপায় নেই আর সে ফুলবাবুর মত আছে।
মাঝে মাঝে সহধর্মিনী তীর্যক বাক্যে কর্ণকুহরে আছড়ে পড়ে।রান্নাঘর থেকে “আর কত ফেসবুক দেখবা, সংসারে তো অন্য কাজ ও আছে, আমি একাই ঘানি টানব ? আমারও শরীর, এটাতো মেশিন নয় , আর হাড়ি ঠেলতে পারবো না !
চলে যাবো বাপের বাড়ি ! এ পোড়া কপালে সংসার করে , আমার হাড় কালি হয়ে গেল । মড়া ঘটকরে যদি পেতাম, বেটার ঘটকালি করা ছোটাতাম৷”
মারুফ সাহেব মনে মনে ভাবে বৈশ্বিক মহামারিতে ঘরে চার দেওয়ালর ভিতর সে আজ বন্দি ,আর বন্দী কে খাবার দিতেই হবে “জেনেভা কনভেশনের আইনুযায়ী ” কিছুক্ষণ পর মৌসুমি ঝড় থেমে যাবে ,মন হালকা হলে চুপ হয়ে যাবে৷
আবার এটা ও ঠিক দেখতে দেখতে সামনে চলে এল ঈদ , এবার আর তার মার্কেট যাওয়া হলো না ,প্রতি বার শুরু থেকে গাউছিয়া নিউমার্কেটে বসুন্ধরায় কতবার যে যেতো তার ঠিক নায় ।
, নিজের ম্যাচিং করার জন্য লিপষ্টিক, আইসেডো, কাজল, শাড়ি, চুড়ি, দুল, হার আনতো যতখান মেচিং মন মতন হতো না ততখন পর্যন্ত চলতো মার্কেটে যওয়ার রেলগাড়ী , তার পাশাপাশি আপন জনের ও সুবিধা বঞ্চিতদের কাপড় আনতো , এবার সব গুড়ে বালি, মাথার উপরে সমস্ত সংসার , তার ও কষ্ট হচ্ছে , তার উপর আবার স্থুল শরীর ।
মাঝে মাঝে মারুফ সাহেব তার সহধর্মিণীকে সংসারের কাজে সাহায্য করার জন্য হাত বাড়ায়। পরক্ষণে সহধর্মিণী বলতে থাকে, “বহুত হয়েছে, আর লাগবে না রান্নাঘরে যাওয়াটা সহধর্মিণী মোটেই পচ্ছন্দ করে না ।
পুরুষ লোকের রান্না ঘরে কি ? একদিকে অপরিস্কার , অপর দিকে মিনুরমারা থাকে !
সারা জীবন চাকরি করেছে ৯টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত। অফিসের বস হিসেবে চাকরিতে ফরমান দিয়েছে, অধিনস্তরা তামিল করেছে ,এখন আর কে তামিল করে ! চাকুরির জগৎ ছিলই আলাদা । সকালের নাশতা খেয়ে অফিসে গিয়েছে আর সুর্যের তেজ নরম হলে গোধুলির লগ্নে বাসায় ফিরেছে।
এসেই খাওয়া দাওয়া করে বিশ্রাম নিয়ে টিভির সামনে বসে। আজ বৈশি্ক করোনা ভাইরাসে দীর্ঘ জগত সংসারের রুটিন যেন সব এলোমেলো। এ জীবনটাই যেন দুর্বিষহ ।
মারুফ সাহেব নিভিত্তে ফিরে যায় তার অতীতের কাছে, সেই কর্ম চঞ্চল অফিসের কাছে।
সেই দিনগুলির কথা তার মনে পরে ৯টা থেকে ৫টা অফিস । মাঝখানে টি ব্রেক কোনো দিন সমুচা, তেহারী, খিচুড়ি আর না হয় আলু সিঙ্গারা। রাধুনী টুনটুনির মার তুলনা হয় না । তার রান্নার কথা মনের অজান্তে বাসায় বললেই, ব্যস আর রক্ষা নাই৷
সহধর্মিনী সাথে সাথে তেলে বেগুনে জ্বলে যেতো। “তাহলে তার কাছে থেকে যেতে পারতে, এখানে আসলে কেন ? আজকাল পুরুষ লোক দিয়ে বিশ্বাস নেই। অন্য দিকে আরো সংসার আছে কিনা কেই বা জানে?”
এই নিয়ে তো ঘন্টার পর ঘন্টা রেডিও বাজতেই থাকল৷” এখন আর আমাকে তো ভাল্লাগে না। পুরুষ লোকের স্বভাব টাই এমন ” ব্যস ! মধুময় দিনের ১২ টা বাজা সাড়া। মাঝে মাঝে ভাবতাম, এত কথা রেখে কেনই টুনটুনির মার কথা বলতে গেলাম।
বার বার ঘুরে ফিরে আসে মারুফ সাহেবের কাছে অফিসের সেই স্বর্নালী দিনের কথা। তার আনন্দ ছিলই আলাদা ।অফিসের দিনের ফাইল দিনেই শেষ করে , দৈনন্দিন কাজের ডিসিশন সব কিছুই দিয়ে আসতো !
কোন কাজ পেন্ডিং রাখতাম না।এর জন্য কত কথা অফিস সহকারীদের , আবছায়ার ভিতর দিয়ে কর্নকুহরে আসতো। এই দেরি হয়াতে অফিস সহকারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে চুপি চুপি বলত ” স্যারেরতো বাজার করা লাগবে না , শ্বশুর বাড়ি থেকে টাকা আসে আর শালাতো ইতালি থাকে।” অফিসের নির্দিষ্ট সময় শেষ হলে জোরে জোরে জানালা দরজা বন্ধ করতো। যাতে জানানো যায় যে অফিস সময় শেষ। কিন্তু সে বুঝেও না বুঝার ভান করতো।
করে অফিসের কাজ শেষ করে ( ফাইল মুক্ত টেবিল ) অফিসের গাড়ি তে উঠতো ৷ আর গাড়ি তে উঠার সময় বলতো, ” আজ একটু দেরি হয়ে গেল। কি করবো , কাজতো আমায় ছাড়ে না , জবাবদিহি আমায় করতে হয় ।
আচ্ছা কাল থেকে অফিস টাইমে ছুটি হবে।আর গাড়ি ছাড়ার পর পিছন থেকে অফিস সহকারীরা বলতো ” সেই কাল আর আসবে না” সেই অফিসের সুখময় দিনগুলোর কথা , তারে নিরবে নির্ভিত্তে উঁকি ঝুঁকি মারে ।
নিশি রাত যতই গভীর হতে থাকে, কর্ম চঞ্চল মানুষ ঘুমের ঘোরে অচেতন , ক্রমেই ওয়াল ঘড়ির শব্দ টিকটিক করে বাড়তে থাকে। দুর থেকে দুরে, আরও দুরে। ট্রেনের ঝিকঝিক আর হুইসেলের শব্দে , তার মনের দরজায় ভেসে আসে।নিয়ে যায় পিছন থেকে আরো পিছনে সেই বালক বেলার কাছে
তার মনে পরে যায় যশোর শামসুল হুদা স্টেডিয়াম মাঠের ফুটবল টুনামেন্টের , কতো না কথা , ফাইনাল খেলায় বিজয়ের তৃপ্তি ছিল আলাদা , ট্রফি নেওয়ার সেই আনন্দ ঘন মুহুর্ত ! ট্রফি হাতে ও দলের পতাকা নিয়ে স্টেডিয়ামের চতু্র্দিকে ঘোরার সাধই ছিল আলাদা
, পরে হৈ-হুল্লোড় আনন্দে ঘন পরিবেশে বন্ধুদের সাথে হয়ে যেতো মাতোয়ারা । কখন যে গল্প স্বল্পে হয়ে যেত রাত। ঘড়ির কাটাটা ছিল বড়ই বদ ,ও বেটা আনন্দ বোঝে না !
তার মনে পরে যেতো বাবার শৈশবের সেই গোধূলি লগ্নে বাড়ী ফেরার কথা, মিষ্টি সেই শাসনের কথা। আজ তো আর রক্ষা নাই। সন্ধ্যা বাতির জ্বলার সাথে সাথে বাসায় ফিরতেই হবে। এটা ছিল বাবার আদেশ
সে দুরুদুরু মন নিয়ে দৌড় ঝাপ মেরে হাঁপাতে হাপাঁতে চলে আসতো বাড়ীর গেটের সামনে।
আদুরিনি বোন, বুড়ি তাকে বলত, “ভাইয়া, ভাইয়া বাবা আমাকে লাঠি খুজতে বলেছে। সাপ বিড়াল মরবে নাকি তোমার পিঠে পড়বে ! তা আমি জানিনা কিন্তু ।
” মারুফ সাহেব বলতো, “কি বলিস ! মা কোথায় ? ” “মা পাকান পিঠা বানাচ্ছে। ” আমি বলতাম, ” আর এদিকে বাপ আমাকে পিঠা বানাবে, তুই আস্তে আস্তে মা কে ডাক দে। বাবা যেন টের না পায় ”। আর বাবা লাঠি খুজলে বলবি,পাস নি ? ” “ভাইয়া, তাহলে আমি মিথ্যা বলব? ” “আরে মাঝে মাঝে একটু আধটু মিথ্যা বলতে হয়। ”
সে টিপ টিপ করে ঘরে ঢুকতো । পড়বি না পড় যমের ঘরে। বাবা তার কান ধরে বলতো, ” তোকে না বলেছি সন্ধ্যার সময় ঘরে ঢুকতে হয়। এটা আমাদের সাত পুরুষের নিয়ম ,
আর যারা বাঁদর তারা রাত্র দুপুরে আসে । তড়িঘড়ি করে মা ঘরে মধ্যে হাজির৷ অমাবস্যার মধ্যে পুর্নিমার আলো দেখতে পেতো৷ ” খুব হয়েছে ! কয় জনের ছেলে ট্রফি পায়, বলে বুকে জড়িয়ে নিল। মনের অজান্তে মধুময় স্মৃতি বার বার ঘুরেফিরে চলে আসে।
আকাশের চাঁদটা মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলছে। অবাক জোৎস্না বেলকুনির ভেতরে এসে গায়ে পরছে। সারা শরীরটা চাঁদ ও জোৎস্নার রং এ রাঙিয়ে যাচ্ছে। ক্রমান্নয়ে মাথার টিকিতে এসে পরেছে চাঁদ, সে উদ্ভাসিত আলোতে আলোকিত হয়ে পড়েছে বিশ্ব নিখিল৷ বেলকুনির খাচার ভিতর ময়না পাখি টা খাবার খাচ্ছে, মাঝে মাঝে তার সাথে চোখাচোখি করছে। যেন বলছে রাত হল ঘুমাতে যাও , আম্মা রাগ হবে ।
ড্রয়িংরুম থেকে ক্যাসেট প্লেয়ারে হাল্কা শব্দে বাজছে , বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান,”যখন পড়বে মোর আর পায়ের চিহ্ন এই ঘাটে।
আমি বাইব না মোর খেয়া তৈরী এই ঘাটে”
গান টা যেন সময়ের সাথে বেশ উপযোগী। পাশে সহধর্মিনীর যেন এক ঘুম হয়ে গেল। তার গায়ের উপর জোৎস্না যেন আলো দিতে কার্পন্য করেনি। পুরো ঘরটা যেন জোৎস্না আলো তে উদ্ভাসিত করে তুলেছে।
মানিক সাহেবের রং চটাহীন প্লাষ্টার খসে পড়া ,পাশের পৌড় বিল্ডিং । এখানে টক্ক সাপ বাস করে , হঠাৎ করে টক্ক সাপ , টক্ক টক্ক করে ডাকছে। তাই দেখে ময়না পাখিটা ও ডাক শুরু করল। কিন্তু এ কি ডাক ! এতো তার মনের ডাক ”
” করোনা শয়তান, করোনা ঘাতক , করোনা শয়তান, করোনা ঘাতক।”
বহু দিন ধরে এ ডাক শিখাচ্ছে। কিন্তু সে ভাবে ডাক দেওয়ার সময় পেলিনা এমন সময় ডাক দিল, ডাক শুনে সহধর্মিণী উঠে এক চোট নিল,” পেশারের রুগী, কাল রাতে জ্বর এসেছিল না ! এখন ও জেগে আছো ! রাত কয়টা বাজে?” প্রশান্তির রাত্রের শেষ না হয়েও হল শেষ !!!
বাংলাদেশ সময়: ৯:৩৪:১৯ ৯১২ বার পঠিত #গল্প #বাংলা #সাহিত্য