বঙ্গ-নিউজ: করোনা নিয়ে বিশ্ববাসি আজ আতংকিত। প্রায় প্রতিটি দেশ এখন বিপর্যস্ত। ডাক্তার আক্রান্ত,নার্স আক্রান্ত, আক্রান্ত সব সেবাদানকারীগণ। এমনই সময়ে করোনার জন্ম বৃত্যান্ত নিয়ে চলছে বিশ্বব্যাপি বাদানুবাদ। এর মধ্যে জাপানের একজন অধ্যাপক একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন।
একটি দেশের অভ্যন্তরে যখন কোন দুর্যোগ দেখা দেয় এবং সেটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তখন সেই দেশের প্রতিক্রিয়ায় বোঝা যায় যে তার সহযোগিতা, বিশ্বাস এবং তার ওপর বৈশ্বিক অংশীদারি দেশগুলোর বিশ্বাসের সম্ভাবনা কতটুকু।
এর অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে করোনা মহামারি। চীন এবং জাপানের দুর্যোগকালীন সময়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা এবং প্রতিক্রিয়াশীল জননীতির জায়গাগুলো দেখলেই বুঝা যায় যে এই পার্থক্যটি কেমন।
২০১১ সালে যখন জাপানের ফুকোশিমায় পরমাণু দুর্ঘটনা ঘটে তখন আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থার পক্ষ থেকে একটি তদন্ত করা হয়েছিল। ওই তদন্তের বিষয়ে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থার তৎকালীন মহাপরিচালক ইউকিয়া আমানো বলেছিলেন, মানবিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং কারিগরি দিকগুলো মাথায় রেখে এবং সেখানে কি এবং কেন হয়েছে তা জানার জন্য এই তদন্ত। যাতে এ থেকে শিক্ষা নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য সরকার, নীতি নির্ধারক এবং পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো চলতে পারে।
ওই তদন্তে বের হয়ে আসে যে জাপানের নীতির কারণে ওই ফুকুশিমায় পরমাণু দুর্ঘটনা ঘটে। পরে বেশ কয়েকজনকে এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়। এছাড়া জাতীয় পর্যায়েও ওই পরমাণু দুর্ঘটনার পর একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করে জাপান সরকার। ওই কমিটির তদন্ত বলা হয় যে মানুষের ভুলের কারণেই ওই পরমাণু দুর্ঘটনা ঘটেছিলো জাপানে। তদন্তে বলা হয়, ওই পরমাণু কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা টকিয়ো পাওয়ার কোম্পানি নামের প্রতিষ্ঠানটি নিরাপত্তার জন্য আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থার দেয়া শর্ত মেনে চলতে পারেনি।
তখন জাপান সরকার কিংবা জাপানের নাগরিকরা সত্য নিয়ে বিভ্রান্ত তৈরি করেনি অথবা ওই দুর্ঘটনা নিয়ে বিশ্বের জিজ্ঞাসার প্রতি কোন
ঔদ্ধত্য আচরণও করা হয়নি। বরং জাপানের নাগরিকরা তখন পরমাণু কেন্দ্র বন্ধ এবং স্বচ্ছ তদন্তের জন্য সরকারকে আরো চাপ দিয়েছেন । এছাড়াও জাপানের নাগরিকদেরকে পরমাণু কেন্দ্র বন্ধ করার জন্য অনলাইনে স্থানীয় এবং জাতীয়ভাবে জনমত গঠন করতেও দেখা গেছে। ওই জনমত জরিপের পর জাপান এবং বিশ্বের অন্যান্য অনেক বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ওই দুর্ঘটনার কারণ এবং সামাজিক প্রভাব জানার জন্য কাজ করে। এমন পরিস্থিতিতে জাপানের সরকার বিপাকে পড়ে। যদিও তখন অনেকেই পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার এবং পরমাণু কেন্দ্রের অংশীদারিদের গাফিলতির কারণটি তুলে ধরেছিলেন।
দুর্যোগকালীন সময়ে জাপান সরকার এবং তার নাগরিকদের মধ্যে অন্যতম লক্ষণীয় ব্যাপারটি ছিল তারা এই দুর্যোগকে তাদের ব্যবস্থার উন্নয়নের পথ হিসেবে বেঁচে নিয়েছে। যাতে এ ধরণের আর কোন দুর্ঘটনা না ঘটে। এবার আসা যাক করোনার দিকে। আমরা দেখেছি যে চীন থেকে উৎপত্তি হওয়া করোনা ভাইরাস নিয়ে অস্ট্রেলিয়া স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য খুবি পরিষ্কার যে করোনার কারণে দীর্ঘকালীন অর্থনৈতিক মন্দায় প্রাতিষ্ঠানিক এবং সরকারের নীতি প্রণয়নে যে সমস্যা হচ্ছে সেখান থেকে উৎরানোর জন্য করোনার উৎপত্তির বিষয়টিকে আরো ভালোভাবে বোঝা। তবে এ আহ্বানের পর চীন সরকার এবং এর নাগরিকরা দাবি করেছে যে অস্ট্রেলিয়া বর্ণবাদ, বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ার চীন রাষ্ট্রদূত চেং জিংইয়ে বলেছেন যদি তদন্ত হয় তাহলে অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকদের থেকে চীনাদের দূরে থাকতে থাকবেন এবং তাদের পণ্য বর্জনের করবেন।
অস্ট্রেলিয়ার এবং অন্যান্য দেশের বিরুদ্ধে এই হুমকি চীনকে আরো প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে। তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে আরো নষ্ট করছে। আর এতে ভবিষ্যতে বৈশ্বিক দুর্যোগের সময় তাদের যে স্বচ্ছতা এবং সহায়তার সম্ভাবনার আলোকে নিভিয়ে দিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক স্বাধীন একটি তদন্ত না হতে দেয়ার মত সেখানে কি আছে? কেন আর্থ সামাজিকভাবে সচ্ছল একটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যা কিনা একটি ভালো বিশ্ব মানের প্রশাসনিক ব্যবস্থা অর্জনের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে তাদেরকে হুমকি দেয়া হচ্ছে?
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো যে কেন তদন্ত করতে চাইলে বর্ণবাদী, বৈষম্যবাদী আখ্যা দিতে হবে। চীন ২০৩৫ সালের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক আধুনিকীকরণ করতে চায় এবং ২০৪৯ সালের মধ্যে একটি আধুনিক সমাজতান্ত্রিক, উন্নত, গণতান্ত্রিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে উন্নত একটি জাতি হতে চায়। যদি চীন এমনটি করতে চায় তাহলে তাদের স্বচ্ছতা, আইনের শাসন আরো বাড়াতে হবে।
এ বিষয়ে চীনের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জ্যাং উই উই বলেন, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমা রাজনৈতিক দল থেকে আলাদা। তারা চীনের অধিকাংশ মানুষের স্বার্থের দিকটি বেশি বিবেচনা করে। যদি তাই হয় তাহলে কি এ জন্য তথ্য লুকিয়ে করোনার বিষয়টি লুকাতে চেয়েছে চীন সরকার।
চীনের বিশ্বাসের জায়গা শক্ত করতে হলে তাদেরকে জাপান থেকে শিক্ষা নিতে হবে। জাপান ফুকুশিমা পরমাণু দুর্ঘটনার পর যেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল এছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রতি চীনের যে প্রতিক্রিয়া ছিল সেখান থেকে শিখতে হবে।
আর এ জন্য ধন্যবাদ দিতে হবে সেই সব নাগরিকদের যারা কোন বিতর্ক ছাড়াই তদন্তের বিষয়টি মেনে নিয়েছিল।
চীনের দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছিলে, কারো অজ্ঞতার পরিধি জানাই প্রকৃত জ্ঞান। আর এটি মূলত স্বাধীন তদন্তকেই ইঙ্গিত করে। করোনা তদন্ত করতে গেলে হয়তো চীনের বেশ কিছু ত্রুটি বের হবে যা চীনের স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তাই হয়তো চীন তদন্তের বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে। তবে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং আইনের শাসনের মাধ্যমে চীন যদি জাতীয়ভাবে পুনরুজ্জীবিত হতে চায় তাহলে তাদের অবশ্যই তদন্ত করতে দিতে হবে। (জাপান টাইমস এর কলাম থেকে অনুবাদ করা।)
লেখক:ড. স্টিফেন আর. নাগি
সিনিয়র সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক স্টাডিজ বিভাগ
আন্তর্জাতিক খ্রিস্টান বিশ্ববিদ্যালয় টোকিও, জাপান।
বাংলাদেশ সময়: ৯:৫০:২৩ ৬৫১ বার পঠিত # #করোনা ভাইরাস #মহামারি আকারে করোনা ভাইরাস #সারা বিশ্বে করোনা