স্বপন চক্রবর্তী,বঙ্গ-নিউজ: চৈত্রের শেষে প্রকৃতি তার সব রং নিয়ে হাজির হলেও বৈশ্বিক মহামারীতে রূপ নেওয়া নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বর্ণহীন হয়ে পড়েছে বাঙালির সার্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বাতিল করা হয়েছে বর্ষবরণের সব আনুষ্ঠানিকতা। তবে টেলিভিশনসহ অন্যান্য বিকল্প মাধ্যমে নববর্ষের ঐতিহ্য অনুযায়ী পরিবেশনায় মানুষকে অভয় দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পহেলা বৈশাখের নতুন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে রমনার বটমূলে প্রভাতী আয়োজনের মাধ্যমে বর্ষবরণের সকাল শুরু করা বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে।
১৯৬৭ সাল থেকে এ আয়োজন করে আসছে ছায়ানট। ১৯৭১ সাল মুক্তিযুদ্ধের বছর ছাড়া প্রতিবছরই এই পরিবেশনা হয়েছে।
২০০১ সালে রমনার বটমূলে বোমা হামলার পরও কখনো ছেদ পড়েনি ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে। মঙ্গলবার ভোরেও একইভাবে ১৪২৭ বঙ্গাব্দকে বরণ করার পরিকল্পনা ছিল সাংস্কৃতিক সংগঠনটির। তবে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার বাড়তে থাকায় অনুষ্ঠান বাতিলের কথা জানিয়েছে ছায়ানট।
ফলে এবার ভিন্ন পরিস্থিতিতে টেলিভিশন ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সীমিতভাবে বৈশাখী আয়োজনের কথা জানিয়েছেন ছায়ানটের সভাপতি সনজিদা খাতুন।
শনিবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “বর্তমান মহামারীতে বিশ্বজুড়ে অগণিত মানুষের জীবনাবসান ও জীবন শঙ্কার ক্রান্তিলগ্নে ছায়ানট তাই ‘উৎসব নয়, সময় এখন দুর্যোগ প্রতিরোধের’ এই অঙ্গীকার নিয়ে সীমিত আকারে নববর্ষ পালনের উদ্যোগ নিয়েছে।’’
ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী বলেন, “এবার তো বিশ্বব্যাপী দুঃসময়ে নববর্ষ আসল। প্রতি বছর ছায়ানট রমনার বটমূলে জনসমাগম করে যে আয়োজনটি করে সেটির তো এবার সুযোগ নেই। কারণ এতে যারা শ্রোতা-দর্শক তাদেরও সমস্যা হবে। যারা অংশগ্রহণকারী তাদেরও সুরক্ষা বিঘ্নিত হবে।”
সে কারণে এ অনুষ্ঠানের অর্থ দুর্গত মানুষ, বিশেষ করে বিপদগ্রস্ত শিল্পীদের দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
অবরুদ্ধ সময়ে মানুষকে সাহস যোগাতে পারে, এমন সব গান নিয়ে থাকবে এবারের বিকল্প উপস্থাপনা।
সারওয়ার আলী বলেন, “পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের একমাত্র অসাম্প্রদায়িক জাতীয় উৎসব। এবার সে উৎসব আয়োজন করা যাবে না। কিন্তু মানুষের মনে যেন প্রশান্তি আসে এবং আশাবাদ জাগ্রত হয় সেজন্য আমাদের গত তিন বছরের অনুষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ টেলিভিশন ধারণ করেছিল, সেখান থেকে কিছু গান বাছাই করেছি, যে গানগুলো মানুষের মনে আশার সঞ্চার করতে পারে।
“অনুষ্ঠানগুলো দেখে মানুষের মধ্যে প্রশান্তি আসবে এবং আশার সঞ্চার হবে। মানবসভ্যতা অজেয়- এই বিশ্বাস থেকে যেন তারা না টলে।”
পহেলা বৈশাখে সকাল ৭টা থেকে অনুষ্ঠানগুলো বিটিভিসহ ছায়ানটের ওয়েবসাইট ও ফেইসবুক পেইজে সম্প্রচার করা হবে। অনুষ্ঠান শেষে ছায়ানটের সভাপতি সনজিদা খাতুন এবারের নববর্ষের পটভূমিতে বক্তব্য রাখবেন।
“সময়টা খারাপ যাচ্ছে, এই নতুন বছরে এর প্রতিষেধক বের হবে এবং বিজ্ঞানের জয়যাত্রা হবে বলে আমি আশা করছি,” বলেন ডা. সারওয়ার আলী।
বাঙালির বর্ষবরণের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। বৈশাখের প্রথম দিন ঢাকার রাস্তায় মুখোশ, ফানুসসহ নানা শিল্পকর্মে নিজস্ব সংস্কৃতির বার্তায় আঁধার তাড়ানোর মঙ্গল আয়োজনে ভিড় নামে সর্বস্তরের মানুষের।
১৯৮৯ সালে স্বৈরাচারবিরোধী ভাবমূর্তি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে শুরু হয় এই আনন্দ শোভাযাত্রা, যা ১৯৯৬ সালে পরিচিতি পায় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে।
সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নানা অনুষঙ্গ মেশানো মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন ইউনেস্কোর ‘ইনটেনজিবল হেরিটেজ’ এর অংশ।
গত তিন দশকে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও নিরবচ্ছিন্নভাবে এই আয়োজন হয়েছে মঙ্গল কামনা ও শুভবোধ জাগ্রত করার বার্তায়।
এবার পরিকল্পনা থাকলেও সেই ধারাবাহিকতায় দাড়ি ফেলেছে নভেল করোনাভাইরাস। ফলে চৈত্রের শেষ দিকে চারুকলায় বর্ষবরণ প্রস্তুতির যে ব্যস্ততা থাকে, এবার আর তা দেখা যায়নি।
তবে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে ভয় জয়ের আহ্বান জানিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রার পোস্টার তুলে ধরছেন আয়োজকরা।
চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, “পোস্টারে প্রতিবছরই একটি থিম থাকে, থিমটাকে ধরে পোস্টারটা করা হয়। এই বছরও আমরা পোস্টারটা রেখেছি। পোস্টারটি প্রিন্ট করা সম্ভব না, সব দোকান বন্ধ। এ কারণে সফট কপিটা সব জায়গায় দিচ্ছি। পোস্টারে এই বছরের বার্তাটিও দিচ্ছি আমরা।”
কালো রংয়ের পোস্টারে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ উপন্যাসের সংলাপ ‘মানুষ ধ্বংস হতে পারে, কিন্তু পরাজিত হয় না’ স্লোগান তুলে ধরা হয়েছে।
আর এবারের প্রতিপাদ্য করা হয়েছে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মুক্ত করো ভয়, আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়’ পঙক্তিকে।
নতুন বছরটি যেন মঙ্গলময় হয়- সেই চিন্তা থেকেই মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি শুরু হলেও করোনাভাইরাসের কারণে বিশেষ পরিস্থিতিতে এবার সবাইকে পরস্পর থেকে দূরত্বে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক নিসার হোসেন।
তিনি বলেন, “ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবাইকে একত্রিত করাই মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল লক্ষ্য ছিল। মানুষের মঙ্গল কামনা করে আগে একত্রিত হতে বলতাম বা একত্রিত হওয়ার মধ্যেই সবার মঙ্গল নিহিত ছিল বলে আমরা বিশ্বাস করতাম। কিন্তু এই বিশেষ পরিস্থিতিতে আমাদের পরস্পর থেকে দূরে থাকতে হবে।
“আমাদের একসাথে মিলিত হওয়া যাবে না, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। এটা ছাড়া মানুষকে বাঁচানো যাবে না, পৃথিবীকে রক্ষা করা যাবে না।”
মানুষ বেঁচে থাকলে আগামীতে নতুন উদ্যমে বর্ষবরণ করা যাবে মন্তব্য করে সবাইকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সরকারের নির্দেশনাগুলো মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন নিসার হোসেন।
এই অধ্যাপক বলেন, “আমাদের পোস্টারের মাঝে একটা কথা আছে, আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়। সুতরাং কোনো অলৌকিক বিশ্বাসের ওপর বসে আমরা রাস্তায় বেরিয়ে যাব না বা একসাথে জমায়েত হব না। যেভাবে লকডাউনে জীবনযাপন করতে বলা হচ্ছে, সেভাবে জীবনযাপন করতে হবে।”
নিজেকে অবরুদ্ধ করে রাখতে মনোবল ও আস্থার পাশাপাশি ধৈর্যধারণেরও পরামর্শ শিল্পী নিসার হোসেন।
তিনি বলেন, “এখনকার যুদ্ধের যে শক্তি তা ধৈর্যশক্তি। আমাদের আগের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হওয়ার পরেও আমরা কীভাবে মনোবল নিয়ে ঘরের ভেতরে নিজেকে আটকে রাখব, সব কিছু থেকে বিরত রাখব, সেটারই পরীক্ষা হচ্ছে। এই পরীক্ষায় যে দেশগুলো দূরে আছে, তারা করোনাভাইরাসকে জয় করেছে।
“এটি না পারলে নিজে তো বিলীন হবই, গোটা মানবজাতিকে বিলীনের ব্যবস্থা করে দেব।”
এদিকে এবার প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ডিজিটাল পদ্ধতিতে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের ব্যবস্থা নিয়েছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ও।
সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সব সরকারি-বেসরকারি সব টেলিভিশনে বৈশাখের অনুষ্ঠান একযোগে সম্প্রচার করা হবে বলে মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা ফয়সল হাসান জানিয়েছেন।
কঠিন বাস্তবতায় বৈশাখের অনুষ্ঠান না হওয়ায় ঘরে থেকেই বর্ষবরণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন অনেকে।
প্রতি বছরই নিজের পরিবারকে নিয়ে পহেলা বৈশাখ উদযাপনে রমনা বটমূলে যান একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মী বেলায়েত শিকদার। কিন্তু এবার বাসার ভেতরেই পহেলা বৈশাখের আমেজ আনার চেষ্টা করবেন বলে জানান তিনি।
“এ বছর যেহেতু বের হওয়ার সুযোগ নেই তাই বাসায় বসে টেলিভিশনে অনুষ্ঠানগুলো দেখব। ঘরে বন্দি থাকতে থাকতে আসলে বাচ্চারা অস্থির হেয়ে উঠেছে, ওদের নিয়ে বারান্দায় বা ছাদে যাব। ভর্তা-ভাজি আর পান্তা খাব। মোটামুটি নববর্ষের একটা আমেজ যেন থাকে, সেই চেষ্টা করব।”
নিজের সংস্কৃতির সাথে সন্তানদের পরিচয় করিয়ে দিতেই প্রতিবছর পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে যান বলে জানান বেলায়েত।
“এবার আমরা আগের বছরের লাল-সাদা রঙের পোশাকে নিজেদের রাঙাবো। বাইরে বের হতে না পারলেও নিজেদের রঙিন রাখতে চেষ্টা করব।”
এ বছর স্ত্রী ও দুই মেয়েকে বৈশাখের নতুন জামা কিনে না দিয়ে সে অর্থ দরিদ্রদের দেওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি।
পহেলা বৈশাখে খোঁপায় তাজা ফুল আর রঙিন শাড়িতে নিজেকে সাজিয়ে ক্যাম্পাসের বৈশাখী উৎসবে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দিল আফরোজ খুশি।
অন্যান্য বছরে নববর্ষকে কেন্দ্র করে অনেক প্রস্তুতি থাকলেও এবার সব কিছু ফিকে লাগছে তার।
তিনি বলেন, “শেষ সময়টায় এসে প্রতি বছরই চুড়ি, ফুল এসব কেনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। চারুকলায় গিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি দেখতাম। চৈত্র সংক্রান্তি উদযাপন করতাম বন্ধুরা মিলে। এবার কোনো কিছুই নেই।
“চারদিকে শুধু করোনাভাইরাসের ভয় আর আতঙ্ক। ঘরে থেকে নানা কিছু করে সময় পার করছি। এ বছরও শাড়ি পরব, সাজব। বাইরে যাব না, কিন্তু অনলাইনে বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করব। শারীরিকভাবে একসাথে হয়ত থাকতে পারব না, ভিডিও কলে আমরা একসাথে হব।”
“করোনাভাইরাসের এই ভয়াবহ সময় কেটে যাবে, আমরা আগামী বছর আবার একসাথে মিলিত হব। সবাই মিলে একসাথে নববর্ষকে বরণ করব,” এই প্রত্যাশা জানান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী খুশি।
বাংলাদেশ সময়: ১০:৪৩:৩১ ৭৪০ বার পঠিত #অনাঅড়ম্বর নববর্ষ #আতঙ্কিত নববর্ষ #নববর্ষ-১৪২৭ #পহেলা বৈশাখ