৯৬তম পর্ব– (৩য় খন্ড-১১ তম পর্ব)
সপ্তপদী মার্কেট শাখা ,বগুড়া —
- চরিত্রের অপবাদ-৪
অনেকদিন পর আজ আবার আপার সামনে বসলাম। উনি একে একে হাতের কাজ শেষ করলেন। ক্যাশ গুনে ভল্টে তুললেন। আবার এসে চেয়ারে বসলেন।ক্যাশিয়ার চলে গেল , ম্যানেজার স্যার চলে গেল , অন্য সবাই চলে গেল। আর আমি তার টেবিলের সামনে বসে আছিই তো আছিই । আপা তো কিছু বলে না। একসময় আপা চেয়ারের তোয়ালেটা ঠিক করে নিয়ে নিলেন । কিন্তু তখনও চুপচাপ। মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো রিল্যাক্স মুডে আছেন। হ্যান্ড ব্যাগ খুলে ক্রিমের কৌটা বের করে মুখে- হাতে মাখলেন। সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। আমাকেও নিতে বললেন কিন্তু আমি রাজি হলাম না। আপা চাবির ব্যাগ হাতে নিয়ে তার চেন সাতবার খোলেন তো একবার বন্ধ করেন। যে আপা এক সেকেন্ড সময় নষ্ট করার মানুষ না তাকে কেন জানিনা আজ খুব উদাসীন মনে হচ্ছে। তিনি কেন চুপচাপ জানি না ,কিন্তু আমি কেন চুপচাপ তা অবশ্য জানি। আপা কিছু না জানতে চাইলে আমি তো কিছু বলতে পারিনা তাই আমি বাধ্য হয়েই চুপচাপ। চুপচাপের এ মহড়া আরো কতক্ষণ চলত জানি না, কিন্তু গেটের গার্ড এসে জানতে চাইল আমাদের বের হতে দেরি হবে কি না ? একটু দেরি হবে আপা জানালেন। নিচ থেকে কিছু খাবার আনতে তাকে পাঠালেন। আমি ভাবছি মিন্নাত ছাড়াও আরো কোনও ঘটনা ঘটেছে কি না। খাবার আসল। খাওয়া শেষ হলো । এবার সত্যি সত্যি আপা চাবির ব্যাগটা ধিরে ধিরে বন্ধ করতে করতে আমাকে বললেন
-তারপর কেমন আছো বলো ? সব খবর ভালো তো। অফিসে তো কথা বলার সুযোগই হয়না।
-তা তো ঠিকই। অফিসে ব্যস্ত থাকি আর আপনি তো আমার চেয়েও বেশি ব্যস্ত থাকেন। আমি ভালো, আল্লাহ চাহে।
-আমি তোমার কাছে কী দোষ করেছি ,বলোতো জালাল , তুমি সারাদিন শুধু রফিক-মিন্নাত নিয়ে থাক ,আমার কাছেও তো ঘেঁষোও না। এর কারণটা কী ?
তাইতো কারণটা কী ? আমি তো নিজেই কারণ জানি না। মনে মনে ভাবলাম আমি। আমাকে চুপচাপ দেখে আবার আবার বলল-
কই কারনটা বলো একবার। কেন এত দূরে দূরে থাক ?
একবার ভাবলাম আপা মনে হয় আমাকে তার দলে টানার জন্য কাউন্সিলিং করছেন। কিন্তু কণ্ঠস্বর শুনে তো মনে হচ্ছে কথায় এক ধরনের মোলোয়েম আবেগ মেশানো আছে। সে আবেগে আমি বিগলিত হয়ে গেলাম। বললাম-ঠিক আছে আপা এখন থেকে আপনার সব কাজে সর্বোতোভাবে সাহায্য করব।
-কাজটাই কী সব ? শোন জালাল আমি তোমাকে অনেক পছন্দ করি , আমি চাই তুমি একজন ভাল ব্যাংকার হয়ে প্রতিষ্ঠিত হও। সব সময় ওদের সাথে সময় কাটালে কি এটা হবে ?
আমি চুপচাপ। অনেক আবেগ মাখা কথা হয়েছে। আপা এবার নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন-
দেখ আমার বোধ হয় অচিরেই বদলি অর্ডার হবে। তোমাদের পাশে আর থাকতে পারব না। আমি ও ম্যানেজার সাহেব চাই তুমি আমার চেয়ারে এসে বসবে। মজিবর সাহেব সিনিয়র হলেও তাকে আমরা এ চেয়ারে বসাতে চাই না। কাল থেকে আমার কাজগুলি একটু একটু করে দেখে নাও।
-আমার আর চাবি নেবার ইচ্ছে নাই আপা , তাছাড়া মজিবর নানা তো আমার চেয়ে এক গ্রেড উপরের অফিসার তাকে এ দায়িত্ব দিলে ভাল হয়।
- জালাল তুমি তো জানই সপ্তপদী একটি বড় শাখা। পাশেই জোনাল হেড বসেন। এ শাখার সেকেন্ড অফিসার বানাতেও জোনাল হেডের মৌখিক হলেও অনুমোদন লাগে।
আমি আর কী বলব । চুপচাপ থাকলাম।আপা নিরবতা ভাঙ্গলেন।
-তোমাকে যে মিন্নাতের চরিত্রের বিষয়ে খোঁজ নিতে বলেছিলাম, কিছু খোঁজ খবর নিয়েছিলে?
বর্তমান প্রসঙ্গে অপ্রত্যাশিত এ প্রশ্নে আমার মাথায় আবার আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। কি জবাব দিব। লজ্জা জড়ানো কন্ঠে বললাম-
-আপা মিন্নাত একজন ভালো অফিসার।
-তা হোক, তার স্বভাব চরিত্র কেমন?
-ভালো। (অমুকের চরিত্র ফুলের মত পবিত্র –এ শ্লোগান তখনও জনপ্রিয় হয় নাই বিধায় তা আর বলতে পারি নাই।)
-কেমনে বুঝলা?
-তার ফাইলে চেয়ারম্যানের সার্টিফিকেট আছে।
-আরে ধ্যুৎ! এটা কি জবাব দিলা? তোমাকে আমি বুদ্ধিমান ভাবছিলাম। ও রকম চেয়ারম্যানের সার্টিফিকেট হাজারটা পাওয়া যায়। বুঝলা। আমি বলছিলাম অন্য কোনভাবে নিশ্চিত হতে পেরেছ কিনা?
কিযে বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমি এখন যেভাবে সবাইকে গল্প শোনাই তাতে আমার মনে হয় আমি আগে থেকেই গল্প বানানেরও ওস্তাদ ছিলাম। এছাড়া উপস্থিত জবাব দেবার ক্ষমতা কেন জানি সব সময় আমার ভালো ছিল। তার আরো প্রমান পরে দিব। আজ শুধু সেদিনের কথাই বলি। বিদ্যুতের ঝলকানি দিয়ে মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। আমি বলে উঠলাম-
-আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি আপা, মিন্নাতের চরিত্র ভালো।
-আমরা মানে?
-আমি আর রফিক সাহেব।
-কি করেছো? রফিককে আবার জড়ায়েছ কেন ?
-দু জন লাগতো এ কাজে।
-ঠিক আছে , কি করেছ তাই এখন বল।
-মিন্নাতকে আমরা স্ট্রং রুমের মধ্যে তুলে দরজা বন্ধ করে উলঙ্গ করে দেখেছি। ওর চরিত্র ভালো। কোনও ভেজাল নাই। দুচোখ বন্ধ রেখে আমি অতি দ্রুততার সাথে উত্তর দিলাম।
চোখ খুলে দেখি আপার মুখ সাদা কাগজের চেয়েও সাদা হয়ে গেছে। আমার সাথে আর কোনও কথা না বলে অফিস থেকে বের হয়ে গেলেন। পরবর্তী জীবনে তার সাথে আমার হাজার হাজার কথা হয়েছে , লাখ লাখ কথা হয়েছে। কিন্তু মিন্নাতের এ কথা আর কখনোই উঠে নাই। আশা করি সচেতন পাঠক-পাঠিকারও আমার এ উত্তর নিয়ে বৈজ্ঞানিক কোনও ভিত্তি খুঁজবেন না। আর এ ব্যাপারে আমি কোনও উত্তরও দিতে পারব না।
আপনাদের নিষেধ করলাম বটে তবে এ ঘটনার বছর ত্রিশেক পরে চরিত্রহীন বিবাহিত পুরুষ চেনার উপায় নিয়ে আনোয়ারা আপার সাথে আমি নিজেই বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষনে বসেছিলাম। সে কথাই বলব এখন।(ক্রমশঃ)
*************************************************
ডিসক্লেইমারঃ-রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন অনেক পুরনো স্মৃতি নির্ভর আত্মজীবনীমূলক লেখা। স্মৃতি-বিভ্রাট তো ঘটতেই পারে , তাছাড়া মূল ঘটনা বর্ণনা করতে কাল্পনিক সংলাপ বা ঘটনা ,ইত্যাদি সন্নিবেশিত হয়ে থাকতে পারে। তাই বইটির প্রকাশিত এবং প্রকাশতব্য খন্ড /পর্বগুলো কে উপন্যাসধর্মী আত্মজীবনী হিসেবে গণ্য করতে হবে।কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছদ্মনামও ব্যবহার করেছি। এ সব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কারো কোন আপত্তি থাকলে আমাকে জানালে তা সংশোধন করে নিব।
*********************
বাংলাদেশ সময়: ৯:১০:৪৮ ৫৩৩ বার পঠিত #রঙ্গে ভরা ব্যাংকিং.স্মৃতিচারণ মূলক #সাহিত্য. জালাল উদ্দীন মাহমুদের লেখা