৯৩ তম পর্ব– “(৩য় খন্ড-৮ ম পর্ব)
সপ্দপদী মার্কেট শাখা ,বগুড়া —
- চরিত্রের অপবাদ-১
প্রথম খন্ডে বর্ণিত তালোড়া শাখার সেই রফিক সাহেবের কথা মনে আছে? ঐ যে কাল্পনিক তামিল ভাষা শিখাতো। সেই রফিক সাহেব এক সময় বদলি হয়ে সপ্তপদী মার্কেট শাখায় আসল। আর আমিও ঋণবিভাগ ছেড়ে ম্যানেজারের নির্দেশে শাখার জেনারেল সাইডে চলে এসে রফিক সাহেবের পাশে বসলাম।
একটা কথা আজকে কিছুতেই বুঝতে পারছিনা- আমি ও রফিক সাহেব কোনও দিনও কেন একজন আরেক জনকে কখনো ভাই বা অন্যকিছু বলে ডাকতাম না। নামের সাথে সাহেব যোগ করে সম্বোধন করতাম। সে বলতো জালাল সাহেব, আমি বলতাম রফিক সাহেব। সে সময় আমি সিনিয়র অফিসার, রফিক সাহেব অফিসার। আমার উচিৎ ছিল বয়সে সিনিয়র হিসেবে তাকে রফিক সাহেব না বলে রফিক ভাই বলে সম্বোধন করা। গতস্য শোচনা নাস্তি ।তাই সে আলোচনা থাক।
মিন্নাত আলীর কথা আগেই বলেছি। নিরীহ গো-বেচারা তবে শ্রোতা হিসেবে খুবই মনোযোগী। আমি ঋন বিভাগ থেকে জেনারেল সাইডে এসে রফিক সাহেব ও মিন্নাত আলীর পাশে বসে দেখলাম আগের তুলনায় রফিক সাহেব আরো পরিপক্ক হয়েছেন তবে আমার প্রতি তার শর্তহীন সমর্থন আগের মতই আছে। কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের মানে আমার, রফিক সাহেব ও মিন্নাত আলীর মধ্যে অপূর্ব এক জোটবদ্ধতা সৃষ্টি হলো। আমার একপাশে বসত দ্বিতীয় কর্মকর্তা আনোয়ারা বেগম এবং মজিবর রহমান। তারা উভয়ই তখন প্রিন্সিপাল অফিসার এবং উভয়ই আমাদের জোটের বাহিরে । উভয়ের মাঝ খানে করিডোর থাকায় তাদের সাথে আমাদের টেবিল লাগালাগি ছিল না। রফিক সাহেব আবার কেমন করে যেন আমদের ৩ জনের টেবিল লাগালাগি করে জোড়া দিয়ে নিল। নির্মল হাসাহাসি করা ছাড়াও আমাদের ত্রিরত্ন জোটের (আমরা তিনজনই ছিলাম অতি সাধারণ তাই কেউ এখানে রত্ন নয়, আমিতো নয়ই) অন্যতম কাজ হলো আনোয়ারা আপা এবং মজিবর স্যারের প্রতিটি কাজের গোপনে বিরোধিতা করা। মজিবর স্যার আবার এক সম্পর্কে আমার নানা হতো। স্বাভাবিকভাবেই আমাকে তুমি তুমি বলত। আমিও নানা করতাম।তবে শাখার কেহই এ মজিবর নানাকে পছন্দ করত না। আমরাও করতাম না। পছন্দ না করার কারণ অজ্ঞাত। তবে আনোয়ারা আপা আবার সবার মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু কি যেন কি কারনে আমাদের ত্রিরত্নের কাছে সমালোচনার পাত্রী ছিলেন। এখানেও প্রকৃত কারণ অজ্ঞাত। সম্ভবতঃ তিনি নয় তার প্রশাসনিক ক্ষমতা এবং সে ক্ষমতার অবশ্যম্ভবী কিন্তু বহুল ব্যবহার আমরা ভালো ভাবে নিতে পারতাম না। আপনা মাংসে হরিণা বৈরী , অর্থাৎ হরিণের শত্রু হরিণের নিজেরই মাংস।হরিণের মাংস সুস্বাদু বলে শিকারি তার পেছনে তীর হাতে ছোটে। হরিণের মাংস বিস্বাদ হলে শিকারি হরিণের দিকে চোখ তুলে হয়তো তাকাতোও না। অন্যদিকে সিংহের সাথে হরিণের জমি-জিরাত নিয়ে গন্ডগোল নাই। শত্রুতার কারণ ঐ মাংসই। কাজেই হরিণ নিজেই নিজের শত্রু।আর আপার প্রাশাসনিক ক্ষমতার জন্যই তিনি আমাদের তখন শত্রু না হলেও অপচ্ছন্দের তালিকায় ছিলেন।
অন্যান্য কয়েকজনের কথাও একে একে আসবে। এখন শুধু বলে রাখি শহরের একদম কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বিধায় এ শাখায় মহিলা কর্মকর্তা-কর্মচারীর আধিক্য ছিল । তদুপরি শুধু মহিলা গ্রাহকদের জন্য এখানে মহিলা কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত “মহিলা কর্নার” ছিল। রফিক সাহেবের ব্যাচমেট জাহাঁনুর ছিলেন ঐ মহিলা কর্নারের ইনচার্জ।এর আগে কোন শাখাতেই আমার মহিলা সহকর্মী ছিল না। এই প্রথম । অফিসে বিপরীত লিঙ্গের সহকর্মী থাকলে বাড়িতে নাকি অশান্তি বাড়ে । কিন্তু আমরা এরকম কোনও সমস্য তখন পাইনি। অশ্লীল কথা বলা, যৌন উত্তেজক ছবি দেখানোর চেষ্টা করা, কু-ইঙ্গিত দেওয়া অথবা গায়ে হাত দেওয়া-এ সব আমরা তখন চিন্তাই করিনি। কিন্তু এ সব একবারেই যে ছিল না , তা বোধ হয় নয়। শাখায় একজন কর্মকর্তা এক জন মহিলা কর্মকর্তাকে নাকি এ রুপ ইঙ্গিত দিয়েছিল। কিন্তু একটি অফিসে কেবল যৌন-আগ্রহী মানুষই থাকে না, অনেক মানুষ থাকে কর্ম-আগ্রহী ও অনৈতিকতা বিরোধী। সে সময় বিষয়টির সত্য মিথ্যা যাচাই করা না হলেও প্রায় সবাই ঐ মহিলা কর্মকর্তাকে নৈতিক সাপোর্ট দিয়েছিল বলে মনে পড়ে। আজকাল অনেক পুরুষ সহকর্মী মনে করেন, মেয়েরা কম কাজ করে বেশি সুবিধা পায়। অফিসের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে মেয়েদের ভাল সম্পর্ক থাকে। এতেই মেয়েদের দ্রুত পদোন্নতি হয়। এভাবে ঢালাও অভিযোগ করা উচিৎ কিনা তা অনেকে চিন্তাও করে না। এ সব নিয়ে পরে এক সময় আলোচনার ইচ্ছে আছে, আজ থাক।
সে সময় আমদের সবার উপর কাজের অনেক লোড ছিল। তবে আমরা আনন্দের সাথেই সব কাজ করতাম। অফিস শেষে সাতমাথার এক ধারে দাঁড়িয়ে আড্ডাও দিতাম। শাখার ও আমাদের কাজের ফিরিস্তি আবারো দিলাম।
ওঃ ম্যানেজার স্যারের কথা এ পযার্য়ে আবার বলা হয়নি। সপ্তপদী মার্কেট শাখায় আমার প্রথম ম্যানেজার ছিলেন জনাব রমজান আলী স্যার। তিনি বদলি হয়ে যাবার পর শাখায় এসেছেন জনাব মোজাহার হোসেন স্যার।
আমি ,রফিক সাহেব আর মিন্নাত বিকেল ৫টার পর (তখন ৯-৫ টা অফিস ছিল)বের হয়ে প্রায়ই দৈনন্দিন বাজার করতে রাজা বাজার ও ফতেহ আলী বাজারে যেতাম এবং নানা গাল-গল্প করতাম। বৃহস্পতিবার ছিল হাফ অফিস। অফিস শেষে সেদিন একসাথে আমরা বাজারে যেতামই। শীতকালে মাঝে মাঝে বথুয়া শাক কিনতে আমরা মাইল খানেক দুরের কালিতলা হাটেও যেতাম। সেখানে একদম টাটকা শাক পাওয়া যেত । অনেকে হয়তো বথুয়া শাকের নামই শোনেনি। আমাদের দেশে প্রচলিত শাকের মধ্যে অন্যতম হলো বথুয়া শাক। এটি মূলত গম, আলু ক্ষেতে আগাছা হিসেবে প্রচুর জন্মে থাকে।এটি কেউ চাষ করেনা। জমিতে আগাছার মত আপনা আপনি জন্ম নেয় এ শাক। আবার শহরের বাজারে আঁটি বেঁধেও বিক্রি হয় এটি। এ শাক দামে খুব সস্তা। বথুয়া শাক মূলত শীতকালে পাওয়া যায়। উত্তরবঙ্গে এ শাক বেশি জন্মে। আমার স্রীদার ১ নম্বর পছন্দের তালিকায় ছিল এ বথুয়া শাক। আমারও। তাদেরও। সবাই পছন্দ না করলে কেন এ শাক সংগ্রহের জন্য অতদুর যেতাম ?
শুনেছিলাম মন খুলে যে হাসতে পারে না সেই পৃথিবীর সবচেয়ে অসুখী ব্যক্তি । সে বিবেচনায় আমরা তিন জন হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে অসুখী ব্যক্তি ছিলাম না। কারন আমরা মন খুলে হাসতাম।
মিন্নাত আবার রফিক সাহেবের ব্যাচমেট ছিল। তারা ক্লার্ক হিসাবে একসাথে ব্যাংকে যোগদান করেছিল। রফিক সাহেব মিন্নাতকে “তুই” বলত কিন্তু মিন্নাত তাকে আপনি বলত। আজ মনে হচ্ছে আমাকে ছাড়াও তাদের মধ্যে আলাদা একটা নেটওয়ার্ক ছিল।
দ্বিতীয় কর্মকর্তা আনোয়ারা আপা ম্যানেজার ছাড়া সবাইকে “তুমি” বলতেন। উনি আমাকে প্রায়ই বলতেন তুমি আমার কাছে না বসে সব সময় রফিক -মিন্নাতের সাথে থাক কেন? আমার কাজে একটু সাহায্য করতে পার না? কি আর করা মাঝে মধ্যে সান্ধ্য ব্যাংকিং এর সময় তার কাজে সাহায্যে করতাম। একদিন আনোয়ারা আপা বললেন,“তোমাকে একটা গোপন কথা বলতে চাই, কথাটা কিন্তু খুব গোপন রাখবা , জানই তো গোপন কথা তোমার গোলাম। কিন্তু ফাঁস করে দিলে তুমি তার গোলাম।” বললাম- বলেন আপা। আমি কাউকে বলব না। বলেন। উনি বললেন- আজ না, কাল সন্যাবলর পর অফিস থেকে সবাই গেলে তখন বলব। তুমি কাল যেন ৫টায় অফিস থেকে বের হয়ো না। অপেক্ষা কোরো। মুখে বললাম ঠিক আছে। কিন্তু মনে মনে ভাবলাম- কি এতো গোপন কথা যে কাল নির্জনে শুনতে হবে। আমি তো বিয়ে করেই ফেলেছি- তাই নিশ্চই কোন বিয়ের প্রস্তাব হবে না। কোনও দলীয়, উপ-দলীয় কোন্দলও করিনা। তাহলে কি সে গোপন কথা? যাক -যেহেতু কথা দিয়েছি তাই বিষয়টি গোপন রাখতে হবে।শেখ সাদী বলেছিলেন “তিন জনের নিকট কখনো গোপন কথা বলিও না- (ক) স্ত্রী লোক. (খ) জ্ঞানহীন মূর্খ. (গ) শত্রু।” । কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিলাম শুধু স্ত্রী লোক. ,জ্ঞানহীন মূর্খ ও শত্রু নয় , আমি আপার গোপন কথাটি কাউকেও বলব না। মিন্নাত বা রফিক সাহেবের সাথেও শেয়ার করব না। মনে মনে আগেই প্রতিজ্ঞা করে রাখলাম । (ক্রমশঃ)
/****************************************************
ডিসক্লেইমারঃ-রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন অনেক পুরানো স্মৃতি নির্ভর আত্মজিবনীমূলক লেখা। স্মৃতি-বিভ্রাট তো ঘটতেই পারে , তাছাড়া মূল ঘটনা বর্ণনা করতে কাল্পনিক সংলাপ বা ঘটনা ইত্যাদি সন্নিবেশিত হয়ে থাকতে পারে। তাই বইটির প্রকাশিত এবং প্রকাশতব্য খন্ড /পর্ব সমূহ কে সত্যাশ্রয়ী উপন্যাসধর্মী আত্মজীবনী হিসেবে গণ্য করতে হবে।
&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&
বাংলাদেশ সময়: ১১:০৪:৪৩ ৭১৫ বার পঠিত #জালাল উদ্দীন #রঙ্গে ভরা ব্যাংকিং #রসাত্মক সাহিত্য #স্মৃতিকথা