চীনকে করোনা ভাইরাসের আঁতুড়ঘর বলা হলেও মৃত্যু, আতঙ্ক আর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিবেচনায় ইতালি-কে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বিপর্যস্ত দেশ হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়। ইতালিতে করোনা সংক্রমণের ইতিহাস যতটুকু জানা যায়, ২৩ জানুয়ারী চীনের হুবেই প্রদেশ হতে মিলান বিমানবন্দর দিয়ে ঐ দেশে প্রবেশের পর অসুস্থ হয়ে পড়লে ২৯ জানুয়ারী তাদের শরীরে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। ২২ ফেব্রুয়ারী ইতালিতে করোনা সংক্রমণে প্রথম মৃত্যু ঘটলেও ওয়ার্ল্ডওমিটারে ০৫ এপ্রিল রাত ৯.৩০ টায় মৃত্যুর সংখ্যা দেখাচ্ছে ১৫,৩৬২ জন আর আক্রান্ত ১,২৪,৬৩২ জন। ইতালির পরিস্থিতি মাত্র ৪২ দিনের মাথায় কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা আর চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর প্রয়োজন দেখা যায় না। প্রতিবেশী জার্মান-দের অবস্থা সে তুলনায় অনেক সহনীয়, আক্রান্ত প্রায় লাখ খানেক হলেও মৃত্যু মাত্র হাজার খানেক ছাড়িয়েছে! ভাববেন না নাজী (নাৎসি) উত্তরাধিকারীরা করোনারও অরুচি হয়েছে! পৃথিবীর সুপ্রাচীন সভ্য জাতি হিসেবে পরিচিত রোমান-রা ধুঁকছে কেন? দ্বিমত শিরোধার্য্য ধরে নিলেও ‘সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়’ বুঝতে না পারার নিশ্চিত পরিণতি ভোগ করছে আজকের ইতালি। মিডিয়া পর্যালোচনায় ইতালির অপরিণামদর্শী যেসব ঘটনাকে আজকের বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তার দু’একটি নমুনা তুলে না ধরলেই নয়। ইতালিতে করোনা আক্রান্ত যখন ৪০০ আর মৃতের সংখ্যা ২ অংকের ঘরে তখন ইতালির ডেমোক্রেটিক পার্টির এক নেতা সুরা পাত্র হাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ছবি পোস্ট দিয়ে লিখেছিলেন - ‘ইতালীয়দের অভ্যাস পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই!’ মাত্র ১০ দিনের মাথায় ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান সেই নেতা নিকোলা জিঙ্গারেত্তি অপর একটি পোস্টে নিশ্চিত করলেন তিনি নিজেও করোনায় আক্রান্ত! ভীড়ে গিজগিজ করা ইতালির মদের বারগুলোর আজকের শূণ্য দশা দেখতে মিডিয়ায় চোখ রাখা অপ্রয়োজনীয়, চোখ বুজলেই দেখা যায় অনায়াসেই। সবকিছু ছাপিয়ে ইতালিতে, এমনকি প্রতিবেশী স্পেনে করোনার ভয়াবহ বিস্তারের জন্য দায়ী করা হয় ইউরোপের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবল লীগ ‘চ্যাম্পিয়ন্স লীগের’ একটি ম্যাচকে। ১৯ ফেব্রুয়ারিতে ইতালির বার্গামো প্রদেশের মিলান’স সান সিরো স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত আতালান্টাও স্পেনের দল ভ্যালেন্সিয়ার মধ্যকার এই খেলায় প্রায় ৪০ হাজার দর্শক ছিল স্টেডিয়ামে! আর অর্থনৈতিক চাপের কথা বলে ইতালির নীতিনির্ধারকদের স্বাভাবিক কাজ-কর্ম চালিয়ে যাওয়ার বাগাড়ম্বর ফানুসের মতো হাওয়ায় মেলাতেও বেশি সময় লাগেনি! আর বিশ্ব মোড়লপনার দেশ যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতাতো আরো ভয়াবহ! ট্রাম্পের কুচ পরোয়া নেহি মনোভাব হতাশায় ম্রিয়মাণ হতে সময় লেগেছে মাত্র এক সপ্তাহ! আজকে যুক্তরাষ্ট্রের করোনা মৃত্যুর সরকারী প্রাক-ধারণা কয়েক লক্ষ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে! ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, নিউইয়র্ক টাইমস ‘ইতালি : এ কশনারি টেল ফর ওয়ার্ল্ড’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও নিউইয়র্ক নিজেই আজকে বধ্যভূমি! ইরানে করোনা সংক্রমণের ইতিহাস দেশটির ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচন ও ইসলামী বিপ্লবের ৪১ তম বার্ষিকী উদযাপনের খাঁড়ায় হারিয়ে গেলেও করোনা মোকাবেলায় পূর্ব সতর্কতার অভাব ও বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেয়ার প্রবণতাকে সামনে নিয়ে আসে। ফল হয়েছে করোনা করুণ, ইরানের ইসলামি মূল্যবোধ ভুলে তাদের জনগণ এলকোহলে আশ্রয় খুঁজেছেন কিন্তু হিতে-বিপরীত দশা দেখা দেয় যখন এলকোহলের বদলে স্পিরিট পান করে শ’ দুই-তিনেক মানুষ পটল তোলেন! এবার আসা যাক, ভারতবর্ষের বাস্তবতায়। অতি বাম, অতি রাম আর তাবলীগি ঝঞ্জাট ভারতীয় করোনা প্রস্তুতিতে বাগড়া দিয়েছে! উহানে যখন শ’য়ে শ’য়ে মানুষ মরছিল ভারতবাসীর সামনে বাবা রামদেব করোনা প্রতিষেধক হিসেবে হাজির করলেন গোমূত্র আর গোবর! কাজ না হওয়ায় ভক্তরা পিঠটান দিয়েছেন আর বাবা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন রহস্যময় কারণে! লক্ডাউন হয়েছে ভারত, কিন্তু বামরা শ্রমজীবী আর কর্মজীবীদের বৈষম্য আর ক্ষুধা কাতরতার পুরনো ধুয়া তুলে মাঠে রাখার উস্কানি দিলে তেল চকচকে লাঠির ঘায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে অনেকটা। কিন্তু করোনা যুদ্ধ প্রস্তুতিতে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা যখন ভারতবাসীর কাছে সময়ের ব্যপার মাত্র তখনই বড় বিপত্তি ঘটালো দিল্লির নিজামুদ্দিনের বিশাল তাবলীগী সমাবেশ! ভারত সরকারের নাকের ডগায় যে এই তুঘলকি কান্ড ঘটতে পারে তা ভাবলেও গা শিউরে ওঠে। করোনা জ্বর অনেক কিছুই ভুলিয়ে দেয় হয়তোবা ইতিহাসের পাতায় ব্যতিক্রম কিছু লেখা হবে বলে। আমার সোনার দেশে ৮ মার্চ করোনা দুঃসংবাদ নিয়ে আসে, কিন্তু প্রথম মৃত্যু হতে সময় লাগে মাত্র ১০ দিন। কিন্তু এতেও মানুষের বোধোদয় হয়নি। ভৌগোলিক সুবিধা, তাপমাত্রা তত্ত্ব, ইমিউনিটি তত্ত্ব সহ হরেক রকম তত্ত্ব আর যুক্তিতর্কে কেটে যায় আরো এক সপ্তাহ। তারপর সরকারের হস্তক্ষেপ আর লকডাউন ঘোষিত হলে রাস্তায়, জনপদে লোকজনের পিকনিক আমেজ, সপ্তাহ পার না হতেই লকডাউন ভাঙ্গতে গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠা এসব দেখে চোখ ছানাবড়া দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের আর শিরদাঁড়ায় আতঙ্কের শীতল স্রোত বইতে থাকে সচেতন নাগরিকদের, লোকজনকে ঘরে ঢোকাতে গলদ-ঘর্ম হয় আর্মি, পুলিশ, র্্যাব, বিজিবি। পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে ধরে নিয়ে দেশবাসী যখন কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিল তখনই গার্মেন্টস শ্রমিকদের কাজে যোগদানের জন্য গার্মেন্টস মালিকদের হঠকারী নির্দেশ রাস্তায় রাস্তায় গার্মেন্টস কর্মীদের স্রোত নামিয়ে দেয়। ৫,০০০ কোটি টাকার সরকারি প্রণোদনা ঘোষণার পর আগারটা খেতে এবং তলারটা কুঁড়াতে সিদ্ধহস্ত গার্মেন্টস মালিকদের সীমাহীন লোভ আর অবিবেচনাপ্রসূত আচরণ জাতিকে নতুন করে সংকটে ফেলে দিল। যেসকল দেশে পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে সেসব দেশে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ততা, রক্ষণশীল মানসিকতা লক্ষণীয়। কিন্তু আমাদের দেশে সরকারের সময়োপযোগী ও উদারনৈতিক নীতির বিপরীতে কিছু গোঁড়া ও স্বার্থান্ধ মানুষের অপতৎপরতা করোনা মোকাবিলায় ছন্দপতন ঘটিয়েছে মারাত্মকভাবে। অথচ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পূর্ভাবাস মতে এই মুহুর্তে বিপজ্জনক মাত্রায় করোনা ঝুঁকিতে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়া।
বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার পরিসংখ্যান যে বার্তা দেয় তা হতে ধারণা করা হয় দক্ষিণ এশিয়ায় করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কয়েক কোটি লোকের আর মৃত্যুর সংখ্যা বাংলাদেশের ঘাড়ে চাপতে পারে ৫ লক্ষ!
কবিগুরুর ‘আষাঢ়’ কবিতার এ স্তবক যেন আজকের সংকটের সাংকেতিক সতর্কবার্তা দিয়ে যায়-
“ওগো, আজ তোরা যাস নে গো তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।
আকাশ আঁধার, বেলা বেশি আর নাহি রে।
ঝরো-ঝরো ধারে ভিজিবে নিচোল, ঘাটে যেতে পথ হয়েছে পিছল–
ওই বেণুবন দোলে ঘন ঘন পথপাশে দেখ্ চাহি রে॥”
লেখকঃ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, ঢাকা।
জাজে’স কোয়ার্টার, আজিমপুর, ঢাকা।
বাংলাদেশ সময়: ১৪:০১:০৬ ৯৮২ বার পঠিত #আর্টিকেল #করোনা #বিশ্ব #মহামারী