৯০তম পর্ব–
সপ্তপদী মার্কেট শাখা ,বগুড়া —-
গোডাউন কিপার -বাকী বিল্লাহ (৩)
মোঃ আব্দুল বাকী তাবলিগ জামাত করত এবং আমাকে সে পথে প্রায়শই দাওয়াৎ দিত। তার সাথে তাবলিগ জামাত বিষয়ে আমার কি কি কথা হয়েছিল তা আজ আর ঠিকঠাক মনে নাই। যা বলব তা অনেকটা অনুমান নির্ভর। তবে যে সব ঘটনা ঘটেছিল তা কিন্তু মোটা দাগে মনে আছে।
তাবলিগ জামাত সম্পর্কে সে সময় আমার স্পস্টভাবে তেমন কিছু জানা ছিল না , এখনও নাই। জানি তাবলিগ জামাত একটি ইসলাম ধর্মভিত্তিক সংগঠন যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকা। তাবলিগ জামাত অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এর সদস্যগণ আখিরাত, ঈমান ও আমলের কথা বলে । তাদের এ প্রচারণার পথে যে সব দলিল প্রদর্শন করা হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো পবিত্র কোরানের সুরা আল ইমরানের ১১০ নং আয়াত । যেখানে বলা আছে “তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে।” তাবলিগ জামাতের মূল লক্ষ্য হলো মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকা। এ কাজে সবাইকে প্রথমে ৩ দিনের জন্য তারপর ৭ দিনের এবং ৪০ দিনের জন্য সময় দিতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। সে সময় আব্দুল বাকী আমাকে ৩ দিনের জন্য উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। আমিও যাব যাব করছিলাম।
ম্যানেজার সাহেব বাকীকে কেন জানিনা এক সময় বাকী বিল্লাহ বলে ডাকা শুরু করেন। পরে অবশ্য এ নামেই সে পরিচিত হয়ে উঠতে থাকে। তো বাকী বিল্লাহ মানে বাকী একদিন আমাকে বলল, স্যার আমার সাথে আপনাকে এ সপ্তাহেই ৩ দিন তাবলিগ জামাতে সময় লাগাতে হবে। বহুত ফায়দা হবে। আমি আবারো দেখি দেখি, হবে হবে করলাম। তো প্রত্যহ নিয়মিত তাগাদা চলতেই থাকল । তাগাদার প্রেক্ষিতে একদিন হাল্কাভাবে স্বগোতোক্তির মত করে বললাম দেখি সামনের বৃহস্পতিবার পারি কিনা? তখন বৃহস্পতিবার হাফ অফিস ছিল, শুক্রবার ছুটি। তাবলিগ জামাতে ৩ দিন সময় দিতে বাকী বৃহস্পতিবার ব্যাংক থেকে মসজিদে যেত । মসজিদ থেকেই শনিবারে অফিসে আসত । অফিস শেষে আবার মসজিদে চলে যেত। বাকী বিল্লাহ আমাকে বললো আপনিও এভাবে মসজিদ থেকেই শনিবার অফিস আসবেন। আমি বললাম বৃহস্পতিবার আগে আসুক তখন দেখা যাবে। আমি বাকী বিল্লাহকে কোন পাকা কথা দিলাম না। সত্যি কথা বলতে কি আমি বাকী বিল্লাহর সাথে আমার এ কথোপকথন পরবর্তীতে কাজের চাপে বোধ হয় ভুলেই গিয়েছিলাম।
পরের বৃহস্পতিবার । বৃহস্পতিবার হাফ অফিস হলেও বের হতে হতে বিকেল গড়িয়ে যেত। সেদিন বাসায় পৌঁছিতে পৌঁছিতেই আসরের আযান দিয়ে দিল। নীচতলায় লাগানো কলিং বেল টিপতেই দোতলা থেকে আমার স্ত্রী বলে উঠল
- তোমার ডাইরেক্ট মসজিদে যাবার কথা না? বাসায় এসেছ কেন?
- কোন মসজিদ?
- মালগ্রামের মসজিদ।
- সেখানে কেন যাব?
- ওমা! বাকী বিল্লাহ না বাসায় এসে তোমার কাঁথা, বালিশ, লুঙ্গি, গামছা সব নিয়ে গেল। বলল স্যার তিন দিন মসজিদে সময় লাগাবে। আমি খুশি হয়ে তাকে সব দিয়ে দিলাম। ভেবে ছিলাম তুমি সরাসরি মসজিদে বাকীর কাছে যাবে।
- বাকী কোন মসজিদের কথা বলেছে?
- মালগ্রামের নতুন মসজিদ।
- ঠিক আছে আমি সেখানে যাচ্ছি। আজ থেকেই যে সময় লাগাব আমি তো তাকে এমন কথা দেই নাই।
-কথা দাও নাই তাতে কি হয়েছে , সে তো ভালো কাজেই যেতে বলেছে। বাসায় খেয়ে ওখানে চলে যাও। দোতলার বরান্দা থেকে আমার স্ত্রী বলল। আমি এতক্ষণ নীচ তলা থেকেই কথা বলছিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম বাসায় এখন ঢুকব না। আগে বাকীর কাছে যেয়ে শুনব সে ভালো ভাবে না শুনে এসব করল কেন? আজ সকাল থেকেই বাকীর সাথে অবশ্য দেখা হয় নাই। সে গোডাউনে গেছে জানতাম। আমার স্ত্রী উপর থেকে আবার ডাকল। ভাবলাম বাসায় খেয়ে মসজিদে যেয়ে আমার কাপড় চোপড় ফেরৎ নিয়ে আসব। তাছাড়া আমার হাতের অফিস ব্যাগটাও তো বাসাতে রাখতে হবে।
বাসা থেকে বের হয়ে যখন মসজিদে পৌঁছলাম তখন মাগরিবের আযান হতে হয়তো আর মিনিট ত্রিশেক বাকী। ঐ মসজিদের মাঝখানে সবায় গোল হয়ে বসে আছে। একজন বয়ান করছেন। আমাকে মসজিদের গেটে দেখেই বাকী হাসি মুখে এগিয়ে এল ছালাম দিয়ে হাত মোসাফা করে বলল স্যার আসুন আপনাকে ডিষ্ট্রিক্ট জজ সাহেব মোশাররফ হোসেন স্যারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। পরিচয় করিয়ে দিলেন। এ জামাতের জিম্মাদার অ্যাডভোকেট শফিকুল ইসলাম খাঁনের সাথেও পরিচয় করিয়ে দিলেন। আরো অনেক অ্যাডভোকেট ছিলেন সেখানে। আমার স্যার, আমার স্যার বলে বাকী অনেকের সাথেই পরিচয় করিয়ে দিলেন। নামাজের প্রস্তুতির জন্য বয়ান থেমে গেছে। এ সুযোগে বাকী মনোযোগ দিয়েছে সবাইকে আমার সাথে পরিচয় করে দেবার দিকে। যাদের সাথে পরিচিত হলাম দেখি তাদের সবার তুলনায় আমি অতি নগন্য। সুযোগ থাকলে বাকী আরো কতক্ষণ পরিচয় পর্ব চালাত জানি না, কিন্তু মাগরিবের আযান পড়ে যাওয়ায় পরিচয় পর্বের ইতি টানতে বাকী বাধ্য হলো। আমিও অস্বস্তির হাত থেকে রেহাই পেলাম। তবে শীঘ্রই এটা বুঝতে পারলাম আগামী ৩ দিন আমাকে এ মসজিদেই এ টীমের সাথে অবস্থান করতে হবে। এত জনের সাথে পরিচয়ের পর কোনমুখে বাসায় ফিরে যাবার কথা বলব ? সব কিছু না হয় বাদই দিলাম ,লজ্জা-শরম বলে তো একটা কথা আছে। শেষ পর্যন্ত ৩ দিন মসজিদে কাটাতে হলো।
মসজিতে কাটানো দিনগুলির রুটিন ওয়ার্ক আমার ঠিক মনে পড়ছিল না । স্মৃতি বিভ্রান্তেও আক্রান্তও হচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ আগে বাকী বিল্লাহর সাথে মোবাইলে কথা বলে স্মৃতি ঝালাই করে নিলাম। বাকী বিল্লাহ বর্তমানে ঢাকায় এক হাউজিং সোসাইটিতে ম্যানেজারের দ্বায়িত্ব পালন করছে।
যাহোক পরের ৩ দিন মোটামোটি রেগুলার রুটিন ছিল এরুপ- মাগরিবের নামাজের পর বয়ান আধা ঘন্টার মত। এশার নামাজ। হেকায়েতে সাহাবা থেকে পাঠ। ৪ জন মিলে এক প্লেটে খাওয়া। ঘুম। ফজরের নামাজের পর বয়ান। তারপর গাস্ত (ধর্মের পথে দাওয়াত) এর জন্য দ্বারে দ্বারে হাজির হওয়া , দু’ তিন জন করে দলেদলে। আধা ঘন্টা পর মসজিদে ফিরে এসে নাস্তা। তারপর জিম্মাদারের নেতৃত্বে মাশারা বা পরামর্শ সভা। সারাদিন কে কী কাজ করবে, কী কী হবে তার একটা পরামর্শ আর কি। যারা খেদমতগার থাকতেন তারা বাজার-সদাই করতেন, রান্না করতেন। অনেক লোকের জন্য একসাথে করা রান্না খেতে মজাই লাগত। গোসল করতে হতো মসজিদেই। জোহরের নামাজের পর একটা হাদিস বর্ণনা। দুপুরের খাবার। খাবার পর ঘুম। আসরের নামাজের আগে উঠে তালিম। আসরের নামাজ । তারপর গাস্ত বা দাওয়াৎ। এরুপ। অত্যন্ত ছকবাঁধা রুটিন। দৈনন্দিন খরচ মিটানোর জন্য সম্ভবত ২০-৩০ টাকা করে দিতে হতো। একজন জিম্মাদারের নেতৃত্বে সব কিছু এমনভাবে পরিচালিত হচ্ছিল যে আজ আমার মনে হচ্ছে ম্যানেজমেন্টের দক্ষ ব্যাক্তিদেরও সেখান থেকে শেখার অনেক কিছু আছে। তবে এটা ঠিক যে ধর্মীয় চেতনা থাকায় সবাই বিনা ওজরে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে সবকিছু পালন করত। কোন রাজনৈতিক আলাপ বা অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ,ধর্মান্তরিতকরণের প্রচারণা বা জঙ্গিবাদী হবার সামান্যতম কোন উপকরণ আমি তাবলিগ জামাতে তখন দেখি নাই। সঠিক নিয়মে নামাজ-রোজা ইত্যাদি পালন করা এবং অন্য মুসলমানদেরও তা পালন করতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য পরামর্শ দেয়া হতো।
কথায় কথায় অনেক কথা বলা হলো। জানি না সীমিত জ্ঞান নিয়ে আমার এসব বলা উচিৎ হলো কিনা । কোনও তথ্যগত ভুল হলে ক্ষমা প্রার্থী।
যা হোক মালগ্রামের নতুন মসজিদে তাবলিগ জামাত এরে সাথে ৩ দিন সময় কাটািয়ে রবিবার সকালে বাসায় ছালাম দিয়ে যখন ঢুকলাম তখন নিজেকে কেন জানিনা খুব পবিত্র পবিত্র মনে হলো। জামাতের নির্দেশনা মোতাবেকই স্ত্রীকে ছালাম দিয়ে বাসায় ঢুকেছিলাম।
তিন দিন মসজিদে সময় কাটিয়ে আমি সন্তুষ্ট ছিলাম বিধায় বাকীর এভাবে ধরে পাকরে তাবলিগ জামায়েত নিয়ে যাওয়ার কারনে তাকে আর তেমন কিছু বলি নাই।
বছর ত্রিশেক পর আজ যখন সে স্মৃতি কথা লিখছি তখন মনে হচ্ছে বাকী যদি সে সময় এভাবে ধরে পাকরে আমাকে মসজিদে না নিয়ে যেত তবে হয়তো আমার কোনও দিনও মসজিদে থাকা হত না। আজ চারিদিকে করোনাভাইরাসের আতঙ্ক চলছে। এ জীবনে আর কবে মসজিদে যেয়ে থাকতে পারব –জানি না। তবে বাকীর তৎপরতায় একসময় সুযোগ পেয়েছিলাম –মনে হচ্ছে এ পার্থিব জীবনে তা ছিল এক বিশাল অর্জন। যার অছিলায় এ সুযোগ পেয়েছিলাম সেই বাকীকে মনে হচ্ছে কাছে গিয়ে ছালাম দিয়ে আসি। সে সুযোগও আর মিলবে কি ?-জানা নেই। (ক্রমশঃ)
ডিসক্লেইমারঃ-রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন অনেক পুরানো স্মৃতি নির্ভর আত্মজিবনীমূলক লেখা। স্মৃতি-বিভ্রাট তো ঘটতেই পারে , তাছাড়া মূল ঘটনা বর্ণনা করতে কাল্পনিক সংলাপ বা ঘটনা ইত্যাদি সন্নিবেশিত হয়ে থাকতে পারে। তাই একে সত্যাশ্রয়ী উপন্যাসধর্মী আত্মজীবনী হিসেবে গণ্য করাই উত্তম।
বাংলাদেশ সময়: ২১:১০:২৪ ১০১০ বার পঠিত #জালাল উদ্দীন মাহমুদের স্মৃতি চারণ #রঙ্গে ভরা ব্যাংকিং #রসাত্মক সাহিত্য