৮৯ তম পর্ব–
সপ্তপদী মার্কেট শাখা ,বগুড়া —- ,
গোডাউন কিপার -বাকী বিল্লাহ (২)
ব্যাংকে সি সি (প্লেজ) নামে এক প্রকার ঋণ- সুবিধা গ্রাহকদের দেয়া হয়। আমাদের সময় এ ঋণ বহুল প্রচলিত ছিল , এখন তেমন আর নাই। এ ঋণের আওতায় ঋণ গ্রহীতা ঋণ নিয়ে যে ব্যবসায়িক মালামাল ক্রয় করত তা একটা গোডাউনে রাখা হতো। গোডাউন তালাবদ্ধ করে চাবি ব্যাংকের হেফাজতে থাকত। গোডাউন পাহারায় থাকত একজন “গোডাউন চৌকিদার”। ঋণ গ্রহীতা ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে টাকা জমার অনুপাতে মাল ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে গোডাউন থেকে বের করে নিত। এ সব হিসাব-নিকাশের জন্য একজন “গোডাউন কিপার “ থাকে। গোডাউন কীপারগণ গোডাউনের মালামালের হিসাব রাখা ছাড়াও ব্যাংকের দৈনন্দিন অনেক কাজ করে। কিন্তু তাদের কোনও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় প্রথম প্রথম কাজ করতে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পার হতে হয়। দেখে দেখে শুনে শুনে তারা শিখে। এক সময় তারা অবশ্য পাকা হয়ে যায়। কিন্তু প্রাথমিক বিড়ম্বনা প্রায় সবারই ভাগ্যে জোটে। গোডাউন কিপার –মোঃ আব্দুল বাকী এর বেলায় কী ঘটেছিল তা এখন বলতে চাই। তার আগে একটুখানি বলে রাখি শাখায় ম্যানেজার সাহেব তাকে বাকী বিল্লাহ নামে ডাকত আবার অনেকে বাকী হুজুর বলে ডাকত। অমি বাকী নামেই ডাকতাম।
বাকী শাখায় যোগদানের পরপরই শাখার দ্বিতীয় কর্মকর্তা মিসেস আনোয়ারা বেগম তার নামে ”লেজার ব্যালান্সিং “ এর অফিস অর্ডার করে দেয়। নবাগত বিধায় তখন সে ব্যাংকিং এর কাজ-কর্ম কিছুই বুঝত না। লেজার ব্যালান্সিং তো আরো দুরের কথা। নতুন প্রজন্মের ব্যাংকারদের কাছে লেজার ব্যালান্সিং কথাটি অপরিচিত মনে হতে পারে অথচ এক সময় (ব্যাংকে কম্পিউটার ব্যবহার শুরুর আগে) লেজার ব্যালান্সিং ব্যাংকারদের নিকট সবচেয়ে বিরক্তিকর -পরিশ্রমসাধ্য কাজ ছিল। গ্রাহকের হিসাবের শুদ্ধাশুদ্ধি বোঝার জন্য ব্যালান্সিং ছাড়া আর কোন কার্যকরী বিকল্প ব্যবস্থাও ব্যাংকে ছিল না। যা হোক ,বাকী আমার কাছে লেজার ব্যালান্সিং বিষয়টি জানতে চায় আমি তাকে যতদুর সম্ভব বুঝিয়ে বলি আর বাকী অন্ধের হাতি দর্শনের মত করে ব্যালান্সিং বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করে।
চার অন্ধের হস্তী দর্শনের গল্পটি আপনাদের সবারই জানা। তবু অতি সংক্ষেপে বলছি। হাতি কেমন দেখতে তা জানার জন্য চার অন্ধ গেল একটা হাতির কাছে। চোখে তারা দেখতে পায় না। সুতরাং হাত দিয়ে হাতির শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ স্পর্শ করে তারা জেনে নিল হাতি দেখতে কেমন। যে অন্ধ হাতির শরীর স্পর্শ করেছিল সে বলল, হাতি দেখতে একটা গাছের মোটা গুঁড়ির মতো। যে পা স্পর্শ করেছিল সে বলল, হাতি দেখতে হুবহু ঢেঁকির মতো । যে কান স্পর্শ করেছিল, সে বলল, দূর বোকার দল, হাতি হচ্ছে বিরাট কুলোর মতো।
যা হোক আমি বাকীকে বললাম প্রথমে আপনার নামে অফিস অর্ডারকৃত লেজারের গ্রাহকের সব একাউন্টের সর্বশেষ স্থিতি টুকে রাখবেন। একে ইংরেজীতে জটিং নেয়া বলে। এর পর ঐ একাউন্টের স্থিতি গুলি যোগ দিয়ে যদি অ্যাবস্ট্রাকট নামক একটা হিসাবের বইয়ের সাথে মিলে যায় তবে বোঝা যাবে আপনার ঐ লেজারের ব্যালেন্স হয়েছে। তখন আপনি ব্যালান্স বুকে মোট টাকার পরিমান অংকে এবং কথায় লিখে নিজে স্বাক্ষর করে সেকেন্ড অফিসারের স্বাক্ষর নিবেন। পাশাপাশি মোট হিসাব সংখ্যাও লিখবেন। তাকে আমি পানিতে না নেমে সাঁতার শেখানোর চেস্টা করলাম , কিন্তু শিখাতে পারলাম বলে মনে হলো না। তাই বাকীকে এ কাজে সাহায্য করার জন্য আমি শাহজাহান নামের অন্য একজন পুরানো গোডাউন কিপারকে খুব করে বলে দিলাম।
তিন কি চারদিন পর একদিন বাকীকে জিজ্ঞেস করলাম -কি বাকী আপনার লেজার ব্যালান্সিং হয়েছে ? বাকী বলল , শাহজাহান ভাইয়ের সাহায্য নিয়ে প্রায় মিলিয়ে ফেলেছি। মাত্র ১ টাকা মিলছে না। শাজাহান ভাই মিলিয়ে দিবে বলেছে। ধরে নেন ওটা হয়ে গেছে স্যার। আমি বললাম ভালো করে দেখেন। সামনে আবার নতুন ব্যালান্সিং অর্ডার আসছে। তার আগেই মিলাতে হবে। বাকী অবজ্ঞার ভঙ্গিতে বললো মাত্র ১ টাকার মামলা তো স্যার। চিন্তুার কিছু নেই। শাহজাহান ভাই মিলিয়ে দেবার সময় পাচ্ছে না। সে নিজের ব্যালান্সিং নিয়েই বেশি ব্যস্ত। তিনটা লেজার মেলাতে হবে তার। আমি নিজে নিজেই এখন চেস্টা করছি।
কয়েক দিন পরের ঘটনা। দেখি বাকী ব্যাংকের এক কোনায় ব্যালান্সের রেজিস্টার হাতে নিয়ে ফোঁপায়ে ফোঁপায়ে কাঁদছে। নজর পড়া মাত্র আমি তার কাছে ছুটে গেলাম।
- কাঁদছেন কেন বাকী? পরম মমতার সুরে বললাম আমি।
- মনের দুঃখে কাঁদছি স্যার।
- কি হয়েছে একটু খুলে বলেন তো।
- ম্যাডাম মানে সেকেন্ড অফিসার আনোয়ারা ম্যাডাম আমার ব্যালান্স হয়নি শুনে ব্যালান্সের খাতাটা আমার মুখের উপর ছুঁড়ে ফেলে দিল। আমি যতবারই বলি মাত্র ১ টাকা তো মেলে নাই। উনি ততবারই আরো রেগে যান।
- রেগে যাবারই কথা। আমি বললাম।
- মাত্র ১ টাকার জন্য রেগে যাবে স্যার। ও রকম কত দু’চার, পাঁচ দশ টাকা আমরা ভিক্ষুককে দান করে দেই। আমাকে বললেই তো আমি এক টাকা দিতে পারতাম। সামান্য এ কারণে এত বকাবকি করল স্যার।
- শুধু বকাবকি করা ঠিক হয় নাই। আরো বেশি কিছু করা উচিৎ ছিল। কত দিন ধরে আমি ব্যালান্স করার জন্য আপনাকে নিজে তাগাদা দিচ্ছি। গায়ে লাগে না ? আপনাকে অবশ্য কাজের সিস্টেম টা বুঝিয়ে বলা হয়নি –এটা ব্যাংকের দোষ। আপনি নিজেও তো শেখার চেস্টা করতে পারতেন । তবে আমি সেকেন্ড অফিসার হলে বকাবকি না করে আপনাকে মেমো দিতাম।
- কি দিতেন স্যার?
- মেমো।
-আপনি ভালো মানুষ স্যার মেমো দিবেনই।
-এই মিঞা ,আমি যে ভাল মানুষ তা কেমনে বুঝলেন।
-বুঝি ,বুঝি স্যার বুঝি ভাল মানুষ সব সময় অন্যকে কিছু দিয়ে শান্তি পায়।
- ব্যালান্সের রেজিষ্টারটা আমার কাছে নিয়ে বসেন। লেজার ও ভাউচারও আনেন। আমি মিলায়ে দিব। কথা যেন আর না বাড়ে তাই আমি অর্ডারের সুরে বললাম।
- আপনি অনেক ভালো মানুষ স্যার। আমি ব্যালান্সের রেজিষ্টারটা আনছি।
-যান যান এত তোষামোদ করার দরকার নাই , যা বলেছি তাই করেন।
তোষামোদ কথাটি বললাম বটে তবে বাকী তোষামোদ না প্রশংসা করেছিল তা বোঝা বড় মুশকিল ছিল। মনে হয় প্রশংসাই করেছিল। প্রাপ্য হলে প্রশংসা করা অবশ্য খারাপ কিছু না। অনার্থিক প্রেষনার একটি উপায় এই প্রশংসা। তবে তোষামোদ অপবিত্র এবং কলুষিত বিষয়। কিন্তু প্রশংসা পবিত্র একটি বিষয়। তবুও মানুষ তোষামোদ পছন্দ করে। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান নাকি একবার তার এক সহকারীকে বলেছিলেন, ‘আমাকে কেউ তোষামোদ করতে পারবে না।’ প্রত্যুত্তরে সহকারী বলেছিলেন, ‘আমি আগামীকাল এসে আপনার কথার জবাব দেব।’ পরদিন সহকারীটি এসে বললেন, ‘স্যার আমি কাল সারা রাত চিন্তা করে দেখলাম, আপনার মতো লোককে সত্যিই কেউ তোষামোদ করতে পারবে না। আপনি তোষামোদ একদমই পছন্দ করেন না।” সহকারীর এ কথাটিকে অনেকেই পৃথিবীর সোরা তোষামোদ বলে অভিহিত করে থাকেন। কে যেন বলেছিলেন ‘তোষামোদ হচ্ছে সুগন্ধির মতো, আপনাকে ওটার ঘ্রাণ নিতে হবে, গলাধঃকরণ করা চলবে না।’
আমার চিন্তার জাল ছিন্ন হলো। বাকী সাহেব মাথায় করে গোটা লেজার এবং হাতে করে রেজিস্টার ও ভাউচার আমার সামনের টেবিলে রাখল ।
ভাউচার ধরে ধরে পোষ্টিং চেক করে ব্যালান্স মিলে দিলাম। কে যেন ১৩০১/- টাকা জমা দিয়েছিল। লেজার কিপার পোষ্টিং দিয়েছেন ১৩০০/- টাকা এভাবেই ১ টাকার গড়মিলের সৃষ্টি হয়। মনে হয় এরকম কিছু একটা হয়েছিল। আমি মিলিয়ে দেয়াতে বাকী খুব খুশী।
আমি বললাম- বাকী, টাকা মাত্র একটা, তাই -ই আপনাকে মিলাতে হবে। কোথায় ভুল তা আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে। পকেট থেকে ১ টাকা জমা দিলে হবে না। ব্যাংকে এটাই নিয়ম। এবার বুঝেছেন তো।
-এখন বুঝেছি স্যার। আমার মাথার উপর থেকে বিশাল একটা চাপ নেমে গেল স্যার। কিন্তু আমাকে কি যেন দিতে চাইলেন তা দিবেন না স্যার। শেষের লাইনটি বাকী হাসতে হাসতে বলল।
- কি আবার দিতে চাইলাম?
- ঐ যে মমো না কি?
-মমো? তখন অবশ্য আমি হালের জনপ্রিয় মমো নামের খাবারটার নাম জানতাম না।
-না মেম বোধ হয় ।
- মেম মানে মেম সাহেব ? কি যা-তা বলছেন ? মাথা খারাপ না পাগল ? অ্যাঁ ? মেম পাব কোথায় ? ইউরোপীয় নারীদের বা অভিজাত পরিবারের কর্ত্রীকে যে মেম বলা হয় বাকী বোধ হয় তা জানত না।
-মনে পড়েছে , মনে পড়েছে –মেমো , মেমো । বয়সে একদম তরুণ বাকী যেন নাচের তালে তালে বলল।
- ও মেমো।
- হু, মেমো।
- দুর মিঞা। যান এখন। বাকীর সাথে অসম বন্ধুত্বের বাঁধন ছিঁড়ে ধমকটা জোরেই দিয়ে ফেললাম।
বাকী মন খারাপ করে আমার সামনে থেকে চলে গেল। আমি কাজে মন দিলাম।
কদিন পর বাকী আবার জিজ্ঞাসা করল ঐ যে মেম না মেমো তো দিতে চাইলেন ওটা আর দিবেন না স্যার। গরীব মানুষকে কেউ কিছু দেয় না। তবে ওয়াদা করলে তা দিতে হয়। বাকির মুখে কৃত্রিম হাসি।
কোন কর্মচারীকে মেমো দেয়া হয় কোন অপকর্ম বা কর্তব্যে অবহেলা করলে। কাউকে সতর্কীকরণ মূলক চিঠি প্রদান করা হলে ঐ চিঠিকে মেমো বলা হতো। এটা এক প্রকার শাস্তি। মেমো প্রাপ্ত কর্মকর্তার ব্যাক্তিগত ফাইলে এটা সংরক্ষন করা হতো। ম্যানেজারগণই তখন মেমো দিতে পারত। তবে মেমো প্রদানের চেয়ে মেমো দেবার হুঁমকীই বেশি দেখান হতো। এ হুমকীতে সে যুগে বেশ কাজও হতো। নেগেটিভ মোটিভেশন আর কি।
বাকী আজ না বুঝে স্বেচ্ছায় তা দাবী করছে। রবীন্দ্র নাথের মতো করে ভাবলাম -আজ নেবার জন্য যা সাধছে বুঝতে পারলে তা না নেয়ার জন্য সাধবে। সত্যিই এরুপ শাস্তিমূলক কিছু না নেবার জন্য তাকে একদিন সাধতে হয়েছিল। সে কথা একটু পরে বলব।
এ ঘটনার পর বাকীর ব্যাংকের কাজ শেখার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এর কয়েক মাস পরে দেখেছি বাকী তার নিজের নামে বরাদ্দকৃত লেজার ব্যালান্সের সময় মত করা ছাড়াও অন্যের কাজেও সহায়তা করছে।
বলে রাখি , চিন্তা-ভাবনা-কথা-বার্তায় –কাজে –কর্মে বাকী অসম্ভব রকমের সৎ ছিল। (ক্রমশঃ)
*************************************************************************************************
বাংলাদেশ সময়: ৮:০৫:৪১ ৭৩৮ বার পঠিত #জালাল উদ্দীন মাহমুদের লেখা #রঙ্গে ভরা ব্যাংকিং #সাহিত্য #স্মৃতি চারণ