আজ বিশ্ব যখন সর্বগ্রাসী সার্স কোভিড-২ বা করোনা ভাইরাস মহামারী-তে আক্রান্ত তখন প্রশ্ন উঠেছে শুধু নিজে সুরক্ষিত থেকে এর ভয়াল থাবা হতে বাঁচা যাবে কি না? উত্তরটি সহজেই অনুমেয়। কোভিড মহামারীর দুটি দিক রয়েছে, একটি ‘সাধারণ’ দিক যার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও আইনগত বিষয় এবং অন্য দিকটি শুধুমাত্র ‘বিশেষ’ যা বিজ্ঞান ভিত্তিক পর্যবেক্ষণ, চিকিৎসা ও নিরাময় ব্যবস্থাকেন্দ্রিক। আমি যেহেতু ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞ কিংবা ডাক্তার নই, সেহেতু আমাদের ভালো রাখা বা থাকার সাধারণ ব্যবস্থা, পদক্ষেপ ও চিন্তা-ভাবনা এই লেখায় তুলে ধরতে চাই। বিশ্ব পরিস্থিতিতে চোখ বুলিয়ে দেখুন মৃত্যুর সংখ্যায় ইতালি-কে ছাড়িয়ে শীর্ষে উঠতে যাচ্ছে স্পেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো বিশ্ব পরাশক্তিগুলো কোভিড-১৯ মোকাবিলায় দিশেহারা। উন্নত বিশ্বে ব্যক্তি নিজেকে সুরক্ষিত রাখার কোন উপকরণের অভাব না থাকা স্বত্ত্বেও কেন তারা সংকট মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে। কারণ একটাই এই পেন্ডামিক/অতিমারি (কেউ কেউ ‘পেন্ডামিক’-এর বাংলা প্রতিশব্দ দাঁড় করাচ্ছেন ‘অতিমারি’, ‘মহামারি’ উল্লেখেও আমি দোষের কিছু দেখি না) ঠেকাতে নিজে ভালো থাকার চেয়ে অপরকে ভালো রাখা বা সুরক্ষিত রাখার গুরুত্ব কোন অংশেই কম নয়। সংক্রমণের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সিংহভাগ রোগীই অপরের নিকট হতে সংক্রমিত হয়েছে। মহামারির ধরণও তাই, মহামারি প্রথম পর্যায়ে গুটি কয়েক রোগী থেকে ক্রমশঃ জ্যামিতিক হারে বাড়তে বাড়তে গোটা কমিউনিটি-তে ছড়িয়ে পড়ে, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়ে গেলেই বিপর্যয় শুরু হয়, কারণ তখন সব রোগীকে একসাথে চিকিৎসা সেবা দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, আতংকিত হয়ে মানুষ সংক্রমিত এলাকা ছেড়ে নিরাপদ এলাকা ভেবে সুস্থ-স্বাভাবিক এলাকায় চলে যায়, নতুন নতুন জনপদে সংক্রমণ ছড়িয়ে বৈশ্বিক মাত্রা লাভ করে। তাই মহামারি রোধে প্রথম জরুরি পদক্ষেপ হলো ডিস্-কানেকশন বা বিচ্ছিন্নকরণ। পরবর্তী পদক্ষেপ হলো সুরক্ষা নিশ্চিত করণ। পূর্বোক্ত পদক্ষেপ দুটি সংক্রমণ রোধ বা কমাতে পারে। কিন্তু যিনি বা যারা ইতিমধ্যে সংক্রমিত হয়ে পড়েছেন তাকে বা তাদেরকে আমরা চিকিৎসা বা প্রয়োজনীয় সেবা দেব না? আক্রান্তরা কি বিনা চিকিৎসায় মারা যাবেন? আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির লাশ কি সৎকার হবে না? আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান বলে আক্রান্ত ও মৃত-কে সর্বাগ্রে এবং দ্রুততম সময়ে চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করতে হবে। তা না হলে পরিবেশ ও পরিস্থিতির অবনতি হবে মারাত্মকভাবে।
এখন দেখা যাক্ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ সমূহ। বাংলাদেশের মননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৫ মার্চ ২০২০ ইং তারিখ সন্ধ্যা ৭.৩০ টায় বর্তমান করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি ও করণীয় বিষয়ে জাতির উদ্দেশ্যে দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ প্রদান করেন। উক্ত ভাষণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে যে সকল পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেন তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রীয় সকল সমাবেশ ও অনুষ্ঠান স্থগিত করেন, জনগণকে স্বাস্থ্য বিধি মান্য করা সহ হোমকোয়ারিন্টিনে থাকার আহবান জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহ সরকারি অফিস ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা করেন, পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থার আশ্বাস দেন এবং জরুরি চিকিৎসা সেবার জন্য হটলাইন ঘোষণা করেন, দরিদ্র ও দুস্থ মানুষের খাদ্য সহ বেঁচে থাকার অতি প্রয়োজনীয় পণ্য-সামগ্রী বিতরণের সু-ব্যবস্থা ঘোষণা করেন এবং জনগণের জরুরি সেবা কিভাবে নিশ্চিত করা হবে তার সুনির্দিষ্ট তথ্যাদী ও প্রক্রিয়া তুলে ধরেন, খাদ্য এবং ওষুধ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার কথা উল্লেখ করেন, জনগণকে খাদ্যসামগ্রী মজুদ না করতে এবং আতঙ্কিত না হতে অনুরোধ করেন। সরকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সময়োপযোগী ও মানবিক কর্মসূচী বাস্তবায়নে সরকারি অফিস-আদালত বন্ধ ঘোষণা করলেও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থল ত্যাগে নিষেদাজ্ঞা আরোপ করেন। বরাবরের মতো দেশের এই দুর্যোগকালে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হয়।
এবার দেখা যাক্, গত এক সপ্তাহে দেশের পরিস্থিতি কি দাঁড়ালো? সরকারের এতো এতো পদক্ষেপেও দেশের জনগণের হুজুগে একটি অংশ সামাজিক দূরত্বের সীমা ব্যপকভাবে লঙ্ঘন করে জলপথে, স্থলপথে গা ঘেঁষাঘেঁষি আর রেষারেষি চরমে তুলে শহর ছেড়ে গ্রামে গেলেন, জনগণ অপরের স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা দূরে থাক নিজের কথাও বেমালুম ভুলে গেলেন। এমন অভিনব একটি সংকট মোকাবেলায় পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রশাসনিক বিভিন্ন পদক্ষেপে প্রথমদিকে দেখা দিল সমন্বয়হীনতা, ডাক্তার দের চিকিৎসা প্রদানে বাধ্যবাধকতা আরোপের একটি প্রজ্ঞাপন জারী করা নিয়ে সরকারী ক্যাডার অফিসারদের কাদা ছোঁড়াছুড়ি কাম্য ছিল না কারো, প্রজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য মহৎ হলেও ভাষা ছিল সংশ্লিষ্টদের আত্মমর্যাদায় আঘাত হানার মতো। তারপর দেখা দিল পেটানো ও কানধরা বিতর্ক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী মহোদয় গণের সার্বক্ষণিক নজরদারি ও নির্দেশনা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের উদ্ধতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছার পর পরিস্থিতির উন্নতি ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। সিভিল প্রশাসন, মিলিটারি প্রশাসন, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সংস্থা, সামাজিক-রাজনৈতিক বিভিন্ন সংগঠন ইতিমধ্যে দরিদ্র ও অসহায় জনগোষ্ঠীর মধ্যে খাদ্য সামগ্রী, সুরক্ষা সামগ্রী (মাস্ক, স্যানিটাইজার, গ্লাভস্ ইত্যাদি) বিতরণ শুরু করেছেন। মানুষের ঘর থেকে বেরোনোর প্রয়োজন হ্রাস করার জন্য সরকারী ব্যবস্থাপনা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
কিন্ত আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন সংকট মোকাবেলার দায়িত্ব সরকারের একার নয় বরং সকলের। যারা শুধু সমালোচনা করেন তাদের সমালোচনা অত্যাবশ্যকীয় কোন পদক্ষেপ গ্রহণে বিঘ্ন কিংবা বিলম্ব সৃষ্টি করলে অবনতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য তারা দায়ী হবেন, গুজব ছড়ানোর জন্য গুজব রটনাকারী দায়ী হবেন, দায়িত্বে অবহেলার জন্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তি দায়ী হবেন, অতি উৎসাহী কর্মকাণ্ডের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দায়ী হবেন সরকার তার দায় নিতে বাধ্য নন, আইন ও বিধি লঙ্ঘনের দায় সংশ্লিষ্ট লঙ্গনকারী বহন করবেন।
মোট কথা, কোন্ পরিস্থিতিতে কে কি করবেন তা সেই পরিস্থিতি-ই নির্দেশ করবে, আপনার করণীয় আইন ঠিক করে দেবে না তা ঠিক করবে আপনার কমনসেন্স, জানেন তো আইন হলো কমন সেন্সের সমষ্টি। পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে ভেবে ঘর ছেড়ে বেরোনোর হিড়িক পরিস্থিতিকে দ্রুতই অবনতিশীল করতে পারে। এতো পদক্ষেপ, এতো প্রচারণার পরও মানুষ ঘরে থাকতে চাচ্ছে না, মানুষ লক্ ডাউন ভাঙ্গতে চাচ্ছে এই পরিস্থিতিতেও অনেকে বলেন লক্ ডাউনে দেরী করা হয়েছে। সঠিক সময়েই লক্ ডাউন হয়েছে দেশ, দেরী করা হলে লাশের সারিতে ভরে যেত দেশ। লক্ ডাউন কিন্তু অনিবার্য করে তুলেছি আমরা, লক্ ডাউন অনির্দিষ্ট বা চিরস্থায়ী কোন ব্যবস্থা নয়। ভাইরাস বিশেষজ্ঞ মতামত অনুযায়ী করোনা ভাইরাসের তান্ডব শুরু হতে সংক্রমণের পর ১৪ দিন সময় লাগে। প্রচার মাধ্যম হতে যতটুকু জেনেছি ৮মার্চ থেকে আমাদের দেশে গণ-সংক্রমণের শঙ্কা শুরু হয়েছে, সেই হিসেবে এত দিনে আমাদের পরিস্থিতি ইতালি-স্পেন ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা। একই হিসেবে লক্ ডাউন শুরুর দিন (২৫ মার্চ,২০২০) থেকে ১৪ দিন পর বোঝা যাবে আমাদের দেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন কতটুকু হয়েছে। আশার কথা হলো আই.ই.ডি.সি.আর. গতকাল পর্যন্ত কমিউনিটি ট্রান্সমিশন সীমিত আকারে হয়েছে বলে তথ্য-উপাত্ত সহ প্রকাশ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউ.এইচ.ও.) এর বরাত দিয়ে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ আমাদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক সময় চিহ্নিত করে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। আমাদের সদাশয় সরকার পরিস্থিতি ও তথ্য প্রবাহের উপর সুতীক্ষ্ণ নজর রেখে সরকারি ছুটি ১১ মার্চ পর্যন্ত বর্ধিত করেছেন মর্মে ইতিমধ্যে অবগত হয়েছি। পরিস্থিতির উন্নতি বা অবনতি দেশের মানুষের কর্মকাণ্ড ও আচরণের উপর নির্ভর করছে, ১১ মার্চের মধ্যে যদি মানুষজন সামাজিক দূরত্বের যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ বেপরোয়া ভাবে লঙ্ঘন না করে হয়তো এ সময়সীমা আর বাড়ানো লাগবেনা যদি না সুপ্ত করোনা ভাইরাসে ইতিমধ্যে প্রাণহানির সংখ্যা ব্যপকভাবে বৃদ্ধি পায়। সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতি দেখা দেবে লক্ ডাউন দীর্ঘতর হলে। তাই আমাদের আচরণ শতভাগ নিয়ন্ত্রণে রেখে আমরা লক্ ডাউন দীর্ঘতর না করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারি। লক্ ডাউন অবশ্য এক বারেই প্রত্যাহার করা যাবে তা নয়, ধাপে ধাপে সীমিত কর্মকাণ্ডের অনুমতি দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার কৌশল প্রয়োগ করা লাগতে পারে। তাই সংকট উত্তরণে সকলের যুক্তিসঙ্গত আচরণ বা চিন্তার বাস্তব প্রতিফলন ঘটানোর কোন বিকল্প নাই।
এতসব আশাব্যঞ্জক কার্যক্রম ও তথ্য উপাত্ত হাজির করার পরও কোন নেতিবাচক ঘটনা বা ভূমিকা না রাখার বিষয়ে আমরা কেউই নিশ্চয়তা দিতে পারি না, এখানেই আমাদের সমস্যার অন্তর্নিহিত গভীরতা! লক্ ডাউনের প্রথমদিকে না হয় লোকজন হতবিহ্বল ছিল, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, বাহিরে তাদের জরুরী কাজগুলো তখনো গুছিয়ে ওঠা হয়নি তা বলে কি এখনো তারা একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে? মোটেই তা হওয়ার কথা নয়, বাস্তবতা ও প্রেক্ষাপটে ভিন্নতা থাকার কথা, তাই জাতির সবচেয়ে সংকটকালে বিনা প্রয়োজনে বা প্রয়োজনের অজুহাত তৈরি করে সচেতনভাবে বা অসচেতনভাবে যারা ঘর থেকে রাস্তা-ঘাটে, হাটে-বাজারে, দোকান-পাটে, অলিতে-গলিতে গাদাগাদি ভীড় করে সংকটকে গভীর রূপ দিচ্ছেন তাদেরকে গণশত্রু আখ্যা দেয়া সময়ের দাবী। কথায় গণশত্রুদের চিড়ে না ভিজলে তাদের বেলায় ভিন্ন ব্যবস্থা অনিবার্য, ব্যবস্থা হিসেবে রাস্তাঘাটে যেসব স্যানিটাইজার স্প্রে করা হচ্ছে সেগুলো মব্ গেদারিং-এ স্প্রে করা, হোম কোয়ারিন্টিন না মানলে আশেপাশের কোন ক্লাব, কমিউনিটি সেন্টার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিত্যক্ত ভবন বা বদ্ধ জায়গায় বাধ্যতামূলক কোয়ারিন্টিনে আবদ্ধ রাখা যেতে পারে (পটুয়াখালীতে একটি লঞ্চকে যেভাবে কোয়ারান্টাইন সেন্টারে পরিণত করা হয়েছে তা মডেল হতে পারে)। প্রশ্ন আসতে পারে তাদের খাওয়া-পরার কি ব্যবস্থা হবে? সাথে সাথে হোম কোয়ারান্টাইন-এ যাওয়া যাবে এমর্মে অপশন দিতে হবে, প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারান্টাইন খুব সহজে কেউ চুজ করবে বলে মনে হয় না। যদি প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারান্টাইন -এর সীমাবদ্ধতা সমূহ জেনে বুঝে কেউ তা গ্রহণ করেও সংখ্যাটা হবে অতি নগন্য! রাস্তার পাশে থাকা ছিন্নমূল মানুষদের জন্যও এধরণের কোয়ারান্টাইন এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভাষাণচরে ছিন্নমূল ও আশ্রয়হীনদের রাখার কথা বলেছেন, মাঠে তৎপর প্রশাসন এই ব্যবস্থাটি কার্যকর করতে পারেন। চাঁদপুরে কর্মরত থাকাকালে মেঘনায় লঞ্চডুবির একটি করুণ কাহিনী শুনে বেশ কিছুদিন বিমর্ষ ছিলাম, দুটি তথ্য আমাকে খুবই হতবাক করেছে এর একটি হলো লঞ্চ ডুবির আগমুহূর্তে যাত্রীদের আতঙ্কে ছুটাছুটি লঞ্চডুবি তরান্বিত করে এবং অপরটি হলো লঞ্চ ডুবিতে অনেক মানুষ নাকি সহযাত্রীর পিছন থেকে টেনে ধরার কারণে মারা যায়। আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি ডুবে যাওয়ায় সম্ভাবনা নিয়ে টলমটল করে এগিয়ে যাওয়া লঞ্চের মতো, তাই যাত্রী গণের উপরে লঞ্চের ভাগ্য ও ক্ষয়ক্ষতি নির্ভর করছে।
এবার আসা যাক চিকিৎসা ব্যবস্থার কথায়, চিকিৎসা হলো এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি সেবা এবং চিকিৎসকগণ হচ্ছেন করোনা মহামারীতে সবচেয়ে বড় যোদ্ধা। কিন্তু যখন শুনি কোন হাসপাতাল বা চিকিৎসক চিকিৎসা না দেয়ায় কোন লোকের মৃত্যু হয়েছে তখন খুব কষ্ট পাই। গবেষণা বলছে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর ৮০% সুস্থ হয়, তাহলে চিকিৎসা না দিয়ে (যদি এমন ঘটনা ঘটে থাকে) তো চিকিৎসকরা মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন যা হত্যার শামিল! আবার সব রোগী তো করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত নন, অন্য কোন সাধারণ বা জটিল বা যেকোন রোগের চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার যেকোন রোগীর আছে, এধরণের অধিকার মৌলিক মানবাধিকার অলঙ্ঘনীয়। মনে রাখা দরকার মানুষজন এখন ঠুনকো রোগ নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে না, মানুষের সচেতনতা আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, ছোটখাটো অসুখের ওষুধ পথ্য মানুষ ঘরে বসেই গ্রহণ করছে, পরিস্থিতির কারণে এমনিতেই মানুষ হাসপাতালে যেতে ভয় পাচ্ছে, এ অবস্থায় কেউ হাসপাতালে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে বড় বিপদে পড়েই তার এই যাওয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দেখাচ্ছে বড় বড় পাবলিক ও প্রাইভেট হাসপাতাল গুলোতে তেমন রোগী নেই বরং হাসপাতাল ছেড়ে সাধারণ রোগীরা পালিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে, এই অবস্থায় ডাক্তারদের চিকিৎসা
চিকিৎসা প্রদানে অস্বীকৃতি বা শিথিলতা অগ্রহণযোগ্য। আমি বলছি না সকল ডাক্তার দায়িত্বে অবহেলা করছেন, আমাদের বীর ডাক্তারদের কেউ কেউ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজেরাই করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন, আমরা তাদের সুস্থতার জন্য সর্বোচ্চ শুভ কামনা করি, তাদের চিকিৎসা যেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থাপনায় হয় সেই দাবি করি। কিন্তু যারা কর্তব্যে অবহেলা করেন তাদের ব্যাপারে যেন তাদের কর্তৃপক্ষ-ই নজরদারি বাড়ান, জাতির জন্য ত্যাগ স্বীকার করার সুযোগ সবাই পান না, যারা পেয়েছেন তারা নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবান এবং তারা এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশ ও দেশের মানুষের মণিকোঠায় স্থান করে নেবেন এই প্রত্যাশা সকলের।
যারা এখনো করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারছেন না তাদের জন্য একটি তথ্য জানিয়ে রাখি করোনা ভাইরাসটি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস সদৃশ লক্ষণ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে যে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১৯১৮ থেকে ১৯১৯ সাল সময়ে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫ কোটি মানুষ মারা যায়। আর মার্কিন এক গবেষণা সংস্থার আশঙ্কা মতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বব্যপী সাড়ে ০৬ কোটি মানুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে- এই মৃত্যু মাত্র শুরু হয়েছে। করোনায় মৃত্যুর সারি আমাদের দেশে কতটা দীর্ঘ হবে তা বলার সময় এখনো আাসেনি তবে ঝুঁকি বিবেচনায় তা নেহায়েত কম হওয়ার কথা নয়! তাই আসুন নিজে ভালো থাকার স্বার্থে অপরকে ভালো রাখার বিষয়ে প্রায়োরিটি নির্ধারণ করি, কারণ চাইলেও আমরা কেউই ব্যক্তিগতভাবে বাঁচতে পারবনা যদি না সমষ্টিগত ভাবে বাঁচি।
জীবনানন্দ দাশের ‘সুচেতনা’ কবিতার নিন্মোক্ত স্তবক যেন বর্তমান বৈশ্বিক ও দেশীয় পরিস্থিতির প্রতিচ্ছবি -
“আজকে অনেক রূঢ় রৌদ্রে ঘুরে প্রাণ
পৃথিবীর মানুষকে মানুষের মতো
ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু
দেখেছি আমারি হাতে হয়তো নিহত
ভাই বোন বন্ধু পরিজন প’ড়ে আছে;
পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন;
মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।
লেখকঃ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, ঢাকা।
জাজে’স কোয়ার্টার,
আজিমপুর, ঢাকা।
বাংলাদেশ সময়: ২৩:৫০:১৮ ২১০০ বার পঠিত