৮৭ তম পর্ব–
সপ্তপদী মার্কেট শাখা ,বগুড়া —- জীবনের ধ্রবতারা রমজান স্যার।
ম্যানেজার রমজান স্যারের আরো কিছু গুণাবলী আমার নজর কেড়েছিল । আমাদের উপর একগাদা কাজ চাপিয়ে দিয়ে তিনি নিজে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াতেন না। নিজে অনেক কাজ করতেন। সবার ব্যক্তিগত জীবনের গুরুত্ব তিনি বুঝতেন। সামাজিক অনুষ্ঠানে শরিক হতেন। যদি কেউ অসুস্থ বোধ করতেন তাহলে তাঁকে ছুটি দিতে কার্পণ্য করতেন না। খুব একটা প্রয়োজন না হলে অফিস আওয়ারের পর কাউকে অফিসে ব্যস্ত রাখতেন না বা অযথা কাউকে অফিসে আটকে রাখতেন না। অলস/অযোগ্য/অথর্ব- সহকর্মীদের নিয়ে এমন নোংরা মন্তব্য তিনি কখনই করতেন না। সবার মন জয় করতে হলে একজন ম্যানেজারকে অবশ্যই অত্যন্ত নৈতিক এবং সত্ হতে হবে। এটি তিনি ভালোভাবেই বুঝতেন।
সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের এক অতি আশ্চার্য ক্ষমতা ছিল তাঁর।
কাজের গতি নষ্ট করতে পারে—এমন উপাদান স্যার চটজলদি ধরে ফেলতে পারতেন এবং সাথে সাথে সরেজমিনে যেয়ে সমাধান বাতলে দিতেন।
বিভিন্ন স্তরের ম্যানেজারদের মধ্যে আমরা “মুড সুইং বা মেজাজ পরিবর্তন ” বিষয়টি দেখতে পাই। এ ধরনের ম্যানেজার একদিন খোশমেজাজে থাকেন তো, অন্যদিন থাকেন চরমভাবে ক্ষিপ্ত । মেজাজ বিগড়ে বসে থাকবেন এমন মানেজার তিনি ছিলেন না। অবশ্য এখন আমিও বুঝি যে হঠাৎ হঠাৎ মেজাজ বিগড়ে যাওয়া মানসিক অপরিপক্কতার লক্ষণ।
রমজান স্যার ১৯৭৩ সালে অফিসার হিসেবে ব্যাংকে যোগদান করেছিলেন। ডি জি এম হিসেবে রিটায়ার্ডমেন্টে যান। এক সময় বগুড়ায় জোনাল হেড হিসেবেও স্যারকে আমি পেয়েছিলাম। সে কথা পরে হবে।
তার সাথে কাজ করার সূচনা লগ্নে আমার মনে দানা বাঁধে যে আমাকে তাঁর মত ভালো মানুষ হতে হবে। আমি তাঁর মত ভালো হতে পারি নাই তবুও কিছুটা চেষ্টা যে করেছি তার সূচনা এই রমজান স্যারই করে দিয়েছিলেন। আমার মনে হয় চাকুরির ঊষালগ্ণে ভালো বস না পেলে-অনুকরনীয় কাউকে না পেলে সে অভাব সারা জীবনে আর দুর হয় না। ভালো মানুষ সেজে বসে আছেন এমন অনেকের দেখা পেয়েছি এ জীবনে । কিন্তু প্রকৃত ভালো মানুষ খুব বেশি পাইনি।
জানি, অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে তার সাথে আমার চাকুরির ঊষালগ্ণে কখন দেখা হলো ? আমি তো ১৯৮৯ সালে যখন সপ্তপদী মার্কেট শাখায় যোগদান করি তখন তো আমার চাকুরির বয়স ৬ বছর পার হয়ে গেছে। আসলে স্যারকে প্রথম আমি পেয়েছিলাম ১৯৮৪ সালে থানা রোড শাখায়। উনি তখন ওখানকার সাব-ম্যানেজার। কাছাকাছি বসার কারণে স্যারকে তখনই ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছিল আমার।
আগেই বলেছি রমজান স্যার ব্যাংকে যোগদান করেছিলেন ১৯৭৩ সালে । স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ব্যাংক বি আর সি- এর মাধ্যমে স্বাধীন দেশের প্রথম ব্যাচে তাদের সরাসরি কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগ প্রদান করে। অগ্রণী ব্যাকে জানা মতে ২৫০ জনের মত নিয়োগ দেয়া হয়। শিক্ষানবিশ সময়ে ( দুই বৎসর ) তাদের বেতন স্কেল না দিয়ে কেবলমাত্র subsistence allowance ১ম বছরে ৩০০/-ও পরের বছরে ৩৫০/- টাকা করে প্রদান করা হয়, যার মাধ্যমে দিন অতিবাহিত করা সে সময়েও বেশ কষ্টকর ছিল। এস পি ও লেভেল এর কর্মকর্তারা তখন রিজিওনাল (জোনাল)হেড ছিলেন। সে সময় ব্যাংক আরো অনেক সমস্যার সাথে কর্মী স্বল্পতায় ভুগছিল। সকাল ৯টার আগে ব্যাংকে ঢুকতে হত কিন্তু রাত ১০টার আগে বের হওয়া যেত না। এখনও ঢোকার সময় ব্যাংকে নিদির্ষ্ষ্ট থাকলেও বের হবার সময় নিদির্ষ্ষ্ট নয়।
যা হোক কয়েক মাস পরেই রমজান স্যার সপ্তপদী মার্কেট শাখা থেকে বদলি হয়ে মেইন ব্রাঞ্চের ম্যানেজার হয়ে গেলেন । তবে বদলি হয়ে যাবার পরও বহুবার রমজান স্যারের সাথে আমার দেখা হয়েছে। দেখা হলেই মনে বাজত-
”তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,
এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা॥….”
শোনা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাত্র ১৮ বছর বয়সে এ গানখানি নাকি বড় ভ্রাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পত্নী কাদম্বরী দেবী কে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন । কিন্তু আমার কেবলই মনে হয় কয়েকটি লাইন বোধ হয রমজান স্যারের উদ্দেশ্য আমাকে দিয়ে গাওয়ানোর জন্য লিখেছিলেন।
একদিন অফিস শেষে বন্ধুদের চাপে সিগারেট মুখে নিয়েছি হঠাৎ মনে হলো রমজান স্যার বোধ হয় আমাকে দুর হতে দেখছেন, সিগারেট ফেলে দিলাম। মনে হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ গানের নীচের লাইন দুটি ও বোধ হয় আমাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন ?
”কখনো বিপথে যদি ভ্রমিতে চাহে এ হৃদি
অমনি ও মুখ হেরি শরমে সে হয় সারা।”
বছর তিনেক আগে হঠাৎ একদিন শুনলাম আমার ব্যাংকিং জীবনের এ ধ্রবতারা রমজান স্যার বগুড়ায় মারা গেছেন। আমি তখন ঢাকায় ।কয়েকদিন যাবৎ মনটা বিষন্নতায় ভরে ছিল। পরপারে স্যার যেখানেই থাকুন তার সততার মূল্য পাবেন এ বিশ্বাস আমি রাখি। স্যারের বেহেশত প্রাপ্তি নিশ্চিত হোক এ দোয়া করি । এক সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল অথচ এ ধরাধামে এখন আর নাই তাদের জন্য –সবার জন্য দোয়া করি। আপনারাও দোয়া করুন।
বুঝি নাই জায়েজ , বুঝি নাই নাজায়েজ
দেশের ডাকে , পেটের দায়ে করে গেছি -করে যাচ্ছি কাজ,
হে দয়াময়, দয়ার সাগর,তোমার অসীম কুদরতে ক্ষমা করে দিও সবারে তুমি আজ।
রমজান আলী স্যারের পরিবর্তে শাখায় যে নতুন ম্যানেজার এলেন তার নাম মোজাহার হোসেন।
(ক্রমশঃ)
(ডিসক্লেইমারঃ-রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন অনেক পুরানো স্মৃতি নির্ভর আত্মজিবনীমূলক লেখা। স্মৃতি-বিভ্রাট তো ঘটতেই পারে , তাছাড়া মূল ঘটনা বর্ণনা করতে কাল্পনিক সংলাপ বা ঘটনা ইত্যাদি সন্নিবেশিত হয়ে থাকতে পারে। তাই একে সত্যাশ্রয়ী উপন্যাসধর্মী আত্মজীবনী হিসেবে গণ্য করাই উত্তম।)
বাংলাদেশ সময়: ২০:১৮:৪৫ ৭৬২ বার পঠিত # #জলাল উদ্দীন মাহমুদের স্মৃতি #রঙ্গে ভরা ব্যাংকিং জীবন #সাহিত্য