৮৬ তম পর্ব-
সপ্দপদী মার্কেট শাখা ,বগুড়া —- ,স্যার কথা বলতেন ভাববাচ্যে।
স্ত্রীর কর্মস্থল বগুড়া শহরের বাংলাদেশ ব্যাংকে। আমার বগুড়া শহর থেকে একটু দুরে। কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম আমি যদি বগুড়া শহরে পোস্টিং নিতে পারতাম তা হলে ভালো হতো। একদিন সুযোগমত জোনাল হেড স্যারকে বললাম কথাটা। উনি বললেন চেষ্টা করে দেখবেন , তবে তিনি এখনই বগুড়া শহরে আমাকে ম্যানেজারি দিতে পারবেন না। সিংহের লেজ হয়ে থাকার চেয়ে বিড়ালের মাথা হয়ে থাকাটাই নাকি বেশি ভালো। কিন্তু আমি ভাবলাম ম্যানেজারি তো অনেক দিনই করলাম। এখন বিরতি দিতে পারলে ভালোই হয়। ম্যানেজারি ছাড়াই পোস্টিং নিতে আমি রাজি হয়ে গেলাম। মনে হলো জোনাল হেড স্যারও রাজি আছেন। মিয়া বিবি রাজি হলে একটা আস্ত বিয়ে হয়ে যায়। আর আমার তো সামান্য বদলি। জোনাল হেড-ই তখন ম্যানেজারদের বদলি করতে পারতেন।তো বদলি অর্ডার হয়ে গেল।বগুড়া শহরের একদম কেন্দ্রস্থল সাতমাথা সংলগ্ণ সপ্দপদী মার্কেট শাখায়।শাখাটি সপ্দপদী মার্কেট এর দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত।বড় জায়গা। এককোণে আবার “লেডিজ কর্নার” আছে।“লেডিজ কর্নার”টি আবার শুধু মহিলা গ্রাহকদের জন্য মহিলা কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত । সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার পদমর্যাদার একজন শাখার ম্যানেজার।নাম রমজান আলী।যমুনা নদীর চর এলাকার সংগ্রামী মানুষ তিনি। আর দ্বিতীয় কর্মকর্তা প্রিন্সিপাল অফিসার আনোয়ারা বেগম।সিনিয়র অফিসার পদমর্যদার আমি থার্ড না ফোর্থ অফিসার জানি না , তবে আপাতত ঋণ বিভাগের ইনচার্জ।আর আছে তালোড়া শাখার সেই রফিক সাহেব। আর রফিক সাহেবের ব্যাচমেট এবং তার খাস চামচা মিন্নাত আলী। এই মিন্নাত পরে আমারও ভক্ত হয়ে পড়ে। আজ ভাবি আমি –রফিক-মিন্নাত তিন জনের কী এক অপূর্ব জুটিই না গড়ে উঠেছিল আমাদের মধ্যে।মানুষের শরীরের ৮০% পানি , আর আমাদের জুটির৮০% কাজ ছিল ঠুনকো অছিলায় হাসাহাসি , রং-তামাশা।আড্ডা দেবার সময় আমিও বলতে চাইতাম , রফিক সাহেবও বলতে চাইতো তবে মিন্নাত শুধুই শ্রোতা ও হাসির উপকরণ সর্বোপরি হাসিতে গলে- ঢলে পড়ার ওস্থাদ।
একজন আদর্শ শ্রোতার সবগুণই ছিল মিন্নাতের মধ্যে। এখন বুঝি ভালো বক্তা হওয়ার মতো ভালো শ্রোতা হওয়াও একটা অসাধারণ গুণ। সে শুনত বেশি বলত কম।
মনে হয় এ কারনেই তার প্রতি আমরা ভরসা রাখতাম , ভালোবাসতাম, তার সাথে সুখ-দুঃখের সব কথা ভাগাভাগি করতাম।
এ শাখায় ম্যানেজার ছাড়াও জনা কুড়ি কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিল।
ম্যানেজার রমজান আলী স্যার।অমায়িক , সৎ , মিশুক এবং সব মিলিয়ে এক নিখাদ ভদ্রলোক। ভীষণ ভালো মানুষ ।শুধু ভালো মানুষ হলেই তো আর হবেনা , সবাইকে বিশ্বাস করাতে হবে যে তিনি ভালো মানুষ। সবার মনে এ বিশ্বাস জন্মাতে সাহায্য করতো স্যারের এক পাটি সাদা সাদা দাঁত।স্যার যদি নাও হাসতেন শুধু কথা বলতেন স্যারের বিস্তৃত খোলা দাঁতগুলি একটি হাসির ইমেজ তৈরী করত। সবাই ভাবতো স্যার কত ভালো মানুষ সব সময় হাসি মুখে থাকেন।
আমি দীর্ঘদিন চেষ্টা করেছি কিন্তু মুচকি হাসির কথা বাদই দিলাম, হো হো করে হাসলেও সাদা সাদা দাঁত বের হয়ে আমার বেলায় স্যারের মত হাসির ইমেজ তৈরী হয় না।
স্যারের জনপ্রিয়তা অর্জনের আর একটি উপাদান হলো তার ভাববাচ্যে কথা বলার দক্ষতা।আমরা জানি বাচ্য তিন প্রকার।কর্তৃবাচ্য , কর্মবাচ্য ও ভাববাচ্য । স্যার ভাব বাচ্যে কথা বলতেন- তাই তাঁর কথায় ক্রিয়াপদই প্রধান হয়ে উঠত , কর্তা বা কর্ম নয়।প্রায়ই স্যারের কথায় কর্তা উহ্য থাকত । যদি কেউ অফিস সময়ে বাহিরে যেতে উনার নজরে পড়ে যান উনি বলতেন - কোথায় যাওয়া হচ্ছে ? সরাসরি না বলে ইঙ্গিতে বা পরোক্ষে কথা বলার এ বিষয়টি তাকে একজন অমায়িক ভদ্রলোক হিসেবেও প্রতিষ্টিত করতে সাহায্য করে। কাকে আপনি বলবেন আর কাকে তুমি বা তুই-ভাববাচ্যে কথা বলার কারনে এ সমস্যা উনার হতো না। উনার বাচন ভঙ্গির আরো কিছু উদাহরণ মনে পড়ছে। বাসা কোথায় না বলে উনি বলতেন , কোথায় থাকা হয় ? তুমি কখন এলে না বলে উনি বলতেন -তোমার কখন আসা হল । অনুষ্ঠানে হয়তো নাচ শেষে গান শুরু করা দরকার ; উনি বলতেন , এবার একটি গান হোক। স্যারের এরুপ ভাববাচ্যে কথা বলার কত উদাহরনই না আজ মনে পড়ছে।আমি শিওর কেউ যদি স্যারের মত ভাববাচ্যে কথা বলেন তবে তার জনপ্রিয়তা অর্জনে বেশি সময় লাগবে না। সব কাজ শেষ করে অফিস শেষে বাসায় ফেরার সময় বসের নিকট থেকে বিদায় নিতে গেলে অধিকাংশ বস বলে আজকের সব কাজ শেষ করেছেন কিনা ? আর রমজান স্যার বলতেন সব কাজ শেষ তো। যেদিন একটু লেট করে অফিসে কাজ করতে হবে স্যার তখন সেই তার মুখ ভর্তি হাসি হেসে বলতেন আজ কিন্তু তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবেনা , লেট করতে হবে। কার সাধ্য তাঁর এ আহ্বান উপেক্ষা করার ? কোনদিন কারো সাথে তাঁর রাগারাগি করার প্রয়োজনই হতো না। তিনি নিজে সব সময় কাজের মধ্যে থাকতেন।লেট করে অফিসে আসা তাঁর ডিকশোনারিতে ছিল না। কারো হয়তো লেজার ব্যালান্স মিলছে না-এ কথা জানতে পারলে তিনি বলতেন , আমি না হয় একটু হেল্প করি আমার কাছে ব্যালান্স বুক আর লেজার নিয়ে আসা যায় কি? আমরা লজ্জায় পড়ে বলতাম লাগবেনা স্যার , আমরাই দেখছি।
বছর ত্রিশেক পরে আজ যখন স্যারের কথা লেখা শুরু করছি –তখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আমি এখন থেকে ভাববাচ্যে কথা বলার চেষ্টা করবো। শুরুও করেছি । যেমন- এখন কেমন আছেন? না বলে
ভাববাচ্যে বলি কি খবর বা কেমন যাচেছ দিনকাল? তেমনি , খেয়েছেন কি?- খাওয়া হযেছে কি? কফি খাবেন না কি?- কফি খাওয়া হবে কি বা কফি চলবে কি? ডিমের মামলেট দাও। ডিমের মামলেট হবে কি? অথবা একটু ডিমের মামলেট চাচিছলাম বা ডিমের মামলেট দেওয়া যাবে কি? অফিসে গিয়েছিলেন কি? অফিসে যাওয়া হয়েছিল কি? বামে যাও - বামে যেতে হবে ।
পাঠক পাঠিকারা আপনারাও ভাববাচ্যে কথা বলার চেষ্টা করতে পারেন।
স্যারের আরো কিছু গুণাবলী আমার নজর কেড়েছিল । (ক্রমশঃ)
বাংলাদেশ সময়: ৯:৩০:৪২ ৯৭২ বার পঠিত #কর্মজীবন #বাংলা সাহিত্য #সাহিত্য