সামরিক বোদ্ধা বা যোদ্ধা না হওয়ায় কেতাবি যুদ্ধের আকার-আকৃতি, গতি-প্রকৃতি, রকম-ঢং এন্তার শাস্ত্রীয় আলোচনা আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে শুধু চক্ষু মুদিয়া, ইষ্ট নাম জপিয়া তরী তীরে ভেড়ানোর চেষ্টা করাও নির্বুদ্ধিতা বলে মানি। প্রচলিত যুদ্ধ, স্নায়ু যুদ্ধ, সাংকেতিক যুদ্ধ, মল্লযুদ্ধ, জাতীয় যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক যুদ্ধ, বহিঃ শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ, আভ্যন্তরীণ শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ, গেরিলা যুদ্ধ, সর্বাত্মক যুদ্ধ, সাইবার যুদ্ধ ইত্যাকার যুদ্ধের মধ্যে আমাদের নিদ্রা হরণকারী করোণার বিরুদ্ধে যুদ্ধ কোন্ মডেলের সাথে যুৎসই সামঞ্জস্যপূর্ণ তা আমার জানা নাই, বিশেষজ্ঞরা এই যুদ্ধের রূপরেখা ইতিমধ্যে দাঁড় করিয়েছেন নিশ্চয়ই। সেই রূপরেখা নিয়ে এই অর্বাচীনের কথা বলা আর আদার বেপারীর জাহাজের খবর নেয়া একই ব্যাপার। তারপরও সংবেদনশীল মনে উঁকি দেয়া কিছু কথা শেয়ার করার ইচ্ছা দমিয়ে রাখতে না পেরে এই লেখার অবতারণা।
প্রায় ফাঁকা রাস্তায় বিচ্ছিন্ন ভাবে চলাচলকারী কয়েকজন পথচারী -কে বেধড়ক লাঠিপেটা করা কিংবা চড়-থাপ্পড় মারার দৃশ্য দেখে আমরা হয়তো পুলকিত হতে পারি যাক যুদ্ধ চলছে পুরোদমে। কেউ কেউ আপ্তবাক্য উচ্চারণ করছেন- মাইরের উপর ওষুধ নাই।
কিন্তু আপনি কি ভেবে দেখেছেন? একজনের শরীরে আঘাত করার কাজে ব্যবহৃত লাঠি আরেক জনের শরীরে প্রয়োগ করার মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণ হতে পারে। ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখলাম মোবাইল কোর্ট নিজ হাতেই এক পথচারী-কে চড়-থাপ্পড় মারছেন। মনে করেন যাকে চড়-থাপ্পড় মারা হলো তিনি ইতিমধ্যেই ভাইরাসে সংক্রমিত, তাহলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে হাত ধুয়ে কি আরেকজনকে থাপ্পড় দেয়া হবে? প্রশ্নগুলো অবান্তর ঠেকছে, না? আসলেই প্রশ্নগুলো অবান্তর, উত্তরগুলো হাস্যকর এবং ঘটমান দৃশ্যগুলো বিপজ্জনক মাত্রায় বিরক্তিকর। আমাদের মনে রাখা দরকার আমরা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছি, ভাইরাসের ভিকটিম মানুষের বিরুদ্ধে নয়। মূল সমাধানের সূত্র পিটানো বা থাপ্পড় -এর মধ্যে নয় বরং সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের মধ্যে। বিবেচনাবোধ ও পরিমিতিবোধ সংকট কালে প্রবলভাবে কাম্য। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার বিষয় টি আমরা কয়েকটি ধাপে নিশ্চিত করতে পারি, সর্ব প্রথম ধাপ হলো ঘরে এবং একমাত্র ঘরে অবস্থান করে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা, পরবর্তী ধাপ হলো জরুরি প্রয়োজনে ঘর থেকে রাস্তায় বা পাবলিক প্লেসে বের হলে যথাযথ প্রটেকশন (মাস্ক, গ্লাভস ইত্যাদি) নিয়ে বের হওয়া এবং প্রয়োজনীয় কাজটি যথাসম্ভব অপর ব্যক্তির নিকট হতে নিরাপদ দূরত্ব (সম্ভবতঃ ১মিটার/ ৩ফিট) বজায় রেখে করা, তারপর অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি (সাবান দিয়ে ধুয়ে বা স্যানিটাইজার দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা) মানা। যিনি সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করবেন তিনি নিজেও যেন তা মানেন তাও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকারীর নিকট হতেও ভাইরাস সংক্রমণের আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না। আমাদের বড় সমস্যা হলো আমরা এখনো জানি না কে ভাইরাসে আক্রান্ত আর কে ভাইরাসে আক্রান্ত নয়। বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, রাজা, উজির, রাজপুত্র, চলচ্চিত্র তারকা, ক্রীড়া তারকা এবং অন্যান্য সেলিব্রিটিরা করোনা ভাইরাসে ধরাশায়ী, আমাদের ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশে ঝুঁকি আরো অনেক বেশি। তদুপরি, ভীতিকর মাত্রায় বলপ্রয়োগ করলে ভিন্ন ধরনের বিপত্তিও ঘটতে পারে যা ঘটেছে কলকাতার রাস্তায়, এক ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়- এক নারী পথচারী কলকাতা পুলিশের সাদা পোশাকে রক্ত/লিপস্টিক মিশ্রিত লাল থুতু লেপ্টে দিয়েছে!
সম্ভবতঃ এবারের যুদ্ধটি হতে যাচ্ছে মানবজাতির সবচেয়ে বহুমুখী বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা প্রয়োগ করে পৃথিবীতে টিকে থাকার যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ঢাল-তলোয়ার প্রয়োগ করার চিন্তা অর্থহীন, কারণ ঢাল-তলোয়ারের নৈপুণ্য প্রদর্শনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান নিধিরাম সর্দার নিজেই অস্তিত্বের সংকটে রয়েছে!
এই যুদ্ধের সবচেয়ে ভয়াবহ দ্বিচারিতা হচ্ছে একদিকে বিশাল জনগোষ্ঠীকে অনিশ্চিত সময়ের জন্য গৃহে অন্তরীণ করে রাখা অন্যদিকে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাবার ও পানীয় সরবাহ স্বাভাবিক রাখা। উভয় সংকটে ভারসাম্য ধরে রাখতে না পারলে এই ব-দ্বীপে ভাইরাস মহামারী -তে নয় বরং অনাহারে অপমৃত্যুর আশংকা বেশি দেখা যায়। আজ খুব প্রয়োজন ভারসাম্যপূর্ণ শিথিলতা, মানবিক দৃষ্টিতে অপরকে দেখা আর কমিউনিটি ট্রান্সমিশন রোধে যুক্তিসঙ্গত সামাজিক দূরত্ব এবং আবশ্যিক স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা।
সর্বোপরি মহান স্রষ্টার নিকট স্ব স্ব ধর্ম বিশ্বাস মতে সকলে প্রার্থনা করি- হে স্রষ্টা, হে প্রভু, সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি কে তুমি এক নিকৃষ্ট সৃষ্টির নিকট লজ্জাজনক ভাবে পরাজিত করোনা।
মোহাম্মদ দিদার হোসাইন
লেখকঃ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, ঢাকা।
বাংলাদেশ সময়: ২:৩৮:০২ ২৪৩৫ বার পঠিত #করোনা #ভাইরাস #মানবতা