বঙ্গ-নিউজঃ ২০১৯ সালের ২৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি)-সংলগ্ন ধরমপুর আমজাদের মোড়ে ‘রাজু ছাত্রাবাসে’র নিজ কক্ষ থেকে ফলিত গণিত তৃতীয় বর্ষের মেধাবী শিক্ষার্থী ফিরোজ কবিরের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নগরীর মতিহার থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়। গাইবান্ধা সদর থানার নারায়ণপুর গ্রামের মৃত সাজু মিয়ার ছেলে ফিরোজ কবির বিভাগের মেধাক্রম অনুসারে দ্বিতীয় ছিলেন। তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার আগের দিন মানসিক চাপে আত্মহত্যা করেন বলে পুলিশি তদন্ত এবং এক বন্ধুর ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে জানা যায়। শুধু ফিরোজ কবিরই নন, রাবিতে বিজ্ঞানের অনেক শিক্ষার্থী মানসিক চাপে ভোগেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগীরা স্বীকার করেছেন। তারা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও বিজ্ঞানের অসংখ্য শিক্ষার্থীর স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাবির পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, রসায়ন, ফলিত গণিত, ফলিত রসায়ন ও রসায়ন প্রকৌশল বিভাগ, ফলিত পদার্থবিজ্ঞান ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (বর্তমানে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ) বিভাগে শিক্ষার্থীরা উদ্বেগজনক হারে ফেল করছেন। এ ছয়টি বিভাগে প্রথম বর্ষে যত জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন, তার অর্ধেকেরও কম শিক্ষার্থী নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে স্নাতক শেষ করতে পারেন। বিজ্ঞানের এ বিভাগগুলোর ফল পর্যালোচনা করে এই করুণ চিত্র উঠে আসে। শুধু তাই নই, বিভিন্ন বর্ষে বারবার অকৃতকার্য হওয়ায় স্নাতক (সম্মান) শেষ করতে পারছেন না অনেক শিক্ষার্থী। এ কারণে প্রতি বছর বিজ্ঞানের উল্লেখিত বিভাগগুলোতে ড্রপআউট শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে।
ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায়, পদার্থবিজ্ঞানে ২০০৭-০৮ থেকে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ৭২০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন। কিন্তু নিয়মিত হিসেবে পাশ করেন ৩১১ জন; এ সংখ্যা ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর অর্ধেকের কম। গণিত বিভাগে ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ৬৮০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন। কিন্তু নিয়মিত হিসেবে স্নাতক পাশ করেন ৩৪৩ জন, যা ভর্তির প্রায় অর্ধেক। রসায়ন বিভাগে ২০১১-১২ থেকে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ৪৪০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন। কিন্তু নিয়মিত হিসেবে স্নাতক পাশ করেন ২৩৭ জন। ফলিত গণিত বিভাগে ২০১২-১৩ থেকে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ২৪০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন। স্নাতক পাশ করেন ১২৪ জন। ফলিত রসায়ন ও রসায়ন প্রকৌশল বিভাগে ২০১২-১৩ থেকে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন ২১০ জন, কিন্তু স্নাতক পাশ করেন ১৩৭ জন। ফলিত পদার্থবিজ্ঞান ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (বর্তমানে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং) বিভাগের ২০১০-১১ থেকে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া ২৫০ জনের মধ্যে স্নাতক পাশ করেন ১৮৩ জন। এছাড়া বিজ্ঞানের অধিকাংশ বিভাগের চিত্র প্রায় একই বলে জানা যায়।
অন্যদিকে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের বিভিন্ন বিভাগে নিয়মিত স্নাতক পাশ শিক্ষার্থীদের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, পরিসংখ্যান বিভাগে ৯০ জনের মধ্যে ৬৩, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগে ৫০ জনের মধ্যে ৩৯, ফার্মেসি বিভাগে ৫০ জনের মধ্যে ৩৯, পপুলেশন সায়েন্স অ্যান্ড হিউমেন রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট বিভাগে ৬০ জনের মধ্যে ৩৪ জন পাশ করেন। উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ৮৮ জনের মধ্যে ৭৩, প্রাণিবিদ্যা বিভাগে ৮০ জনের মধ্যে ৬৮, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের ৬০ জনের মধ্যে ৪৫, ক্রপ সায়েন্স বিভাগের ৫৬ জনের মধ্যে ৩৮ এবং অ্যাগ্রোনোমি অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগের ৫৬ জনের মধ্যে ৪৬ জন শিক্ষার্থী স্নাতক পাশ করেন।
বিভিন্ন বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাস্টার্সের শিক্ষার্থীরা বলেন, প্রথম বর্ষেই বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো কীভাবে শেষ করতে হবে, অনেক শিক্ষার্থীই তা বুঝতে পারেন না। বিভাগগুলোর সিলেবাস অনেক বড়ো, এমনকি যুগোপযোগী নয়। উন্নত বিশ্বে অনেক আগেই যেগুলো পড়ানো বন্ধ করে দিয়েছে, এমন অনেক বিষয় এখানে পড়ানো হয়, যার কার্যকারিতা নেই। বিভাগে শিক্ষক-শিক্ষার্থী আন্তঃসম্পর্ক খুব একটা ভালো না হওয়ায় অনেক সময় শিক্ষার্থীরা সঠিক নির্দেশনা পান না। শিক্ষার্থীরা তাদের সমস্যা নিয়ে শিক্ষকদের কাছে যেতেও পারেন না। এছাড়া শিক্ষকদের কঠোরভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়নও দায়ী।
এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক এম খলিলুর রহমান খান বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে এমন হতে পারে। শিক্ষার্থীরা হয়তো নিয়মিত পড়াশোনা করে না এমনকি ক্লাসেও আসে না। এমনটাও হতে পারে, হয়তো শিক্ষকরা ঠিকমতো পাঠদান করছেন না। বর্তমান শিক্ষার্থীরা নোট-শিটনির্ভর হয়ে পড়ছে। না বুঝে মুখস্থ করে পরীক্ষায় বসছে। ফলে অকৃতকার্য অনেকে পরবর্তী বর্ষে চলে যায়।’ তিনি স্বীকার করেন, সিলেবাসটাও ভারী, যা শিক্ষার্থীদের জন্য আয়ত্ত করা কষ্টসাধ্য। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রতিটি বিভাগকে উদ্যোগ নিতে হবে।
পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ফেল করার পেছনের কারণ তিনটি। প্রথমত, শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজে যে পদ্ধতিতে পড়ালেখা করছে, তা মুখস্থনির্ভর। ঐ মানসিকতা নিয়েই তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার পদ্ধতি ভিন্ন হওয়ায় তাল মেলাতে পারে না। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকেরা ছাত্রদের মোটিভেট করতে পারছেন না। তৃতীয়ত, শিক্ষকেরা ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে বোঝাতে পারছেন না। এছাড়া জ্ঞান ও শেখার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহও কম, অল্প পরিশ্রমে ভালো ফলের আগ্রহ এখন প্রায় সবার।’
রাবির ইমেরিটাস অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাক বলেন, ‘মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা সংক্ষিপ্ত সাজেশনের প্রশ্ন মুখস্থ করে ভালো ফল করে। সংক্ষিপ্ত পড়াশোনা শেষে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হচ্ছে, কিন্তু তাদের ভিতটা শক্তিশালী হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর অনেকে সিলেবাসের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না।’
বাংলাদেশ সময়: ১০:১৮:২৫ ৫৯৮ বার পঠিত # #রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়