Next
স্বপন চক্রবর্তী, বঙ্গ-নিউজ: ফাঁসির রায় হয়েছে, নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কারাগারের কনডেম সেলে; সেই অবস্থায়ই গুলশান হামলার চেয়ে ভয়াবহ হামলা চালানোর হুমকি দিচ্ছিলেন আসলাম হোসেন সরদার ওরফে র্যাশ। তার পাশে থাকা জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধীর মুখেও ছিল আস্ফালন।
তিন বছর আগে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ হামলা চালিয়ে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে গলা কেটে হত্যার জন্য বিন্দুমাত্র অনুশোচনাও দেখা যায়নি আসলাম, জাহাঙ্গীরসহ সাত আসামির চোখে-মুখে।
বরং তাদের মুখে ছিল হাসি। দুজনের মাথায় ছিল আইএসের চিহ্ন সম্বলিত টুপি; মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক যে জঙ্গি সংগঠনের ভাবাদর্শে পরিচালিত হয়ে গুলশানের হামলা ঘটানোয় জড়িত ছিলেন নব্য জেএমবির এই সদস্যরা।
আইনি লড়াইয়ে তাদের আদালতে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টাকারী এক আইনজীবীও জঙ্গিদের উদ্ধত আচরণের এক পর্যায়ে স্বীকার করে নেন, তার মক্কেল আইএস সমর্থক হতেও পারে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম জঙ্গি হামলার ঘটনায় বুধবার দুপুরে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে রায়ের আগে সকালে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আদালতে আনা হয় আট আসামিকে।
রায়ে আট আসামির মধ্যে জাহাঙ্গীর হোসেন রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন র্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, মামুনুর রশিদ রিপন, শরিফুল ইসলাম খালেদ ও আব্দুস সবুর খান সোহেল মাহফুজকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। খালাস পান অন্য আসামি মিজানুর রহমান মিজান।
হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী পাঁচ তরুণ সেদিনই নিরাপত্তা বাহিনীর কমান্ডো অভিযান মারা পড়েছিলেন। এরপর ধারাবাহিক অভিযানে নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতারাও মারা পড়েন।
নিরীহ মানুষকে হত্যার উদ্দেশ্যে ওই হামলার পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ, বিস্ফোরক ও অস্ত্র সরবরাহ, হামলাকারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগে সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে সাতজনের।
আসামিদের সকালে কারাগার থেকে আনার পর রাখা হয়েছিল ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনের কোর্ট হাজতখানায়।
রায় দিতে দুপুরে বিচারক এজলাসে ওঠার আগে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় জজ আদালত ভবনের পঞ্চম তলায় সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে।
আদালত কক্ষে যখন নেওয়া হচ্ছিল, আসামি রাকিবুল হাসান রিগ্যান প্রথমে আঙুল তুলে ‘ভি’ চিহ্ন দেখান। কালো পাঞ্জাবি পড়া জাহাঙ্গীরের মুখে ছিল হাসি। মামুনুর রশীদ রিপনকে কিছুটা গম্ভীর মনে হলেও বাকিদের হাসতে ও আঙুল তুলে কথা বলতে দেখা যায়।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা জানান, কাঠগড়ায় তোলার পরও আসামিরা বেশ ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করছিলেন। ‘নারায়ে তাকবির’ স্লোগান দিয়ে বলছিলেন, ‘বিচার হবে হাসরের ময়দানে’।
সাতজনের ফাঁসির রায় ঘোষণার পর তাদের একজন উচ্চস্বরে বলতে থাকেন, “আমরা কোনো অন্যায় করিনি।”
তার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে অন্যরাও বলতে থাকেন একই কথা।
ফাঁসির রায় দেওয়ার শেষ হলে আসামিদের এজলাসের কাঠগড়া থেকে নামিয়ে আনার সময় রিগ্যানের মাথায় দেখা যায় একটি কালো টুপি, সেখানে আইএস এর পতাকার ঢঙে আরবি লেখা।
তার পাশে পুলিশ সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। তবে কাউকে এ বিষয়ে ভ্রুক্ষেপ করতে দেখা যায়নি।
কারাগারে নেওয়ার সময় প্রিজন ভ্যানে তোলা হলে জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধীর মাথাতেও একই ধরনের টুপি দেখা যায়। অথচ আদালতে নেওয়ার সময় ওই দুজনের মাথায় কোনো টুপি দেখা যায়নি।
আদালত থেকে তাদেরকে একে একে এনে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়।
প্রিজন ভ্যান থেকে মামুনুর রশীদ রিপন চিৎকার করে বলতে থাকেন, “উই আর সোলজার্স অব আল্লাহ, উই আর সোলজার্স অব খেলাফত। আমরা আল্লাহর পথে মুজাহিদিন। মুজাহিদরা কখনো ফাঁসিকে ভয় পায় না। ক্রস ফায়ারকে ভয় পায় না। আমরা আল্লাহর পথে জিহাদ ঘোষণা করতে চাই।”
কড়া লাগানো হাত উঁচু করে সে এই কথাগুলো বলতে থাকেন তিনি।
রাজীব গান্ধী বলেন, “হে আল্লাহর সৈনিকরা, তোমরা বসে আছ কেন?”
তখন একজন উচ্চস্বরে বলেন, “তোমরা কারা?”; পরক্ষণেই জবাবে বলেন, “আমরা আইএস।”
একজন নাম জিজ্ঞেস করলে জাহাঙ্গীর হোসেন রাজীব গান্ধী বলেন, “আমি উমর। আমি উমর।”
এ সময় তার মাথায় আইএসের পতাকা চিহ্নের সেই টুপি পরা ছিল।
এ সময় আসলাম হোসেন র্যাশতে শোনা যায়, “আমরা এই ফাঁসিকে পরোয়া করি না।”
রাজীব গান্ধী বলেন, “হে আল্লাহর সৈনিকগণ, তোমরা বসে আছ কেন? তোমাদের সাথী বন্ধুরা বিপদে পড়েছে। আমাদের বিজয়ী হতে হবে “
এ সময় র্যাশ বলেন, “ভাইয়েরা টেনশন করবেন না। আপনারা যেভাবে আছেন, অ্যাটাক চালিয়ে যান আপনারা। ….শান্তিতে থাকতে দেবেন না। গুলশানের চেয়েও ভালো ভালো অ্যাটাক চাই। গুলশানের অ্যাটাকের চেয়েও ভয়ঙ্কর অ্যাটাক চাই আমরা। আমরা ফাঁসি ঝুলতেছি তো কী হয়েছে, আপনারা টেনশন করবেন না।”
হলি আর্টিজান বেকারিতে বিদেশি ও দেশি নাগরিকদের জিম্মি করে রাতভর যে বীভৎস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল জঙ্গিরা, তা উঠে এসেছে আদালতের রায়েও।
রায়ের পর্যবেক্ষণ বিচারক বলেছেন, এই হামলার মধ্য দিয়ে আসামিরা জঙ্গিবাদের ‘উন্মত্ততা, নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার’ যে ‘জঘন্য বহিঃপ্রকাশ’ ঘটিয়েছে, তাতে তারা কোনো অনুকম্পা বা সহানুভূতি পেতে পারে না।
ওই হামলায় জড়িত থাকায় দণ্ডিত জঙ্গিদের যে আইনজীবীরাই আদালতে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করেছেন; তাদের একজন মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন।
তিনি আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাদিসুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদের পক্ষে আইনি লড়াই চালিয়েছিলেন।
রায়ের পর এই আইনজীবীর কাছে প্রশ্ন রাখা হয়, তার মক্কেলরা আসলে জঙ্গিদলের সদস্য কি না?
জবাবে তিনি বলেন, “তারা জড়িত ছিলেন না, এটাই আমরা বিজ্ঞ আদালতে সাক্ষ্য প্রমাণ ও যুক্তিতর্কে উপস্থাপন করেছি। যেহেতু আমরা ইতিমধ্যে আপিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা বিচারের চলমান প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি। তাই এর চেয়ে বেশি কিছু বলা সমীচীন হবে না।
তার মক্কেল র্যাশের আইএসের চিহ্ন সম্বলিত টুপি পরার বিষয়টিতে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে এই আইনজীবী বলেন, “এ ব্যাপারটি আমি অবগত নাই। আমাদের যা রেকর্ডে আছে, তাতে এ রকম কিছু পাই নাই।”
কয়েক বছর আগে সিরিয়া ও ইরাকের বড় অংশ দখল করে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা দিয়েছিল আইএস; এখন তারা পর্যুদস্ত হয়ে ছিন্নভিন্ন।
হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী পাঁচ তরুণও আইএসের পতাকা পেছনে রেখে ছবি দিয়েছিল ইন্টারনেটে। তবে আইএসের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগ ছিল না বলে বাংলাদেশের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা দাবি করে আসছেন।
আসামিদের আইনজীবী দেলোয়ার আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, তার মক্কেলরা আইএস সমর্থক হতেও পারেন।
আইএস টুপি এল কোত্থেকে, গেল কোথায়?
কারাগার থেকে আদালতে- পুরো সময়টি পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্যে দুই জঙ্গির মাথায় আইএসের চিহ্ন সম্বলিত টুপি কীভাবে এল, তা আবার কোথায় গেল, তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন; ফলে একটি তদন্ত কমিটি করেছে কারা কর্তৃপক্ষ।
ঢাকার জেলার মাহবুব আলম বলেছেন, রায়ের আগে কারাগার থেকে যাওয়ার সময় আসামিদের কারও মাথায় ওই রকম কালো টুপি ছিল না। রায়ের পর তারা ফিরলে তল্লাশি করা হয়েছিল, তখনও ওই রকম টুপি পাওয়া যায়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়োন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রায় ঘোষণার পরে রিগ্যান আদালতের কক্ষ থেকে বের হওয়ার সময় আদালত ভবনের পঞ্চম তলারই কেউ একজন তাকে গেইটের কাছে টুপি সরবরাহ করে।
আসামি পক্ষের আইনজীবী দেলোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, “আসামিরা দীর্ঘদিন ধরে পুলিশের হাতে ছিল …. এটা পুলিশের বিষয়।”
জানতে চাইলে পুলিশের উপ-কমিশনার (প্রসিকিউশন) জাফর আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা আমরা খেয়াল করতে পারিনি। ধর্মীয় টুপি বলেই মনে করেছিলাম। পরে বিষয়টি নজরে আসে। তবে আদালত থেকে এ ধরনের টুপি আসামিদের হাতে যাওয়ার সুযোগ নেই।”
আসামিদের মাথায় আইএসের পতাকার চিহ্ন সম্বলিত টুপি নিয়ে আলোচনার মধ্যে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বিষয়টির তদন্ত হওয়া উচিৎ।
প্রিজন ভ্যানে তোলার সময়ও টুপি দেখা গিয়েছিল আসামিদের মাথায়; কিন্তু তাদের কারাগারে নেওয়ার সময় তা পাওয়া যায়নি। পুলিশ কর্মকর্তারাও টুপিটি পাননি বলে জানিয়েছেন।
উপকমিশনার জাফর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছেন। ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ওই টুপি আসামিরা সঙ্গে করে এনেছেন, না আদালত চত্বরে কেউ তাকে দিয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এ মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, “এখনও আলামত হিসাবে টুপিটি পাওয়া যায়নি। পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।”
তবে তিনি বলেন, ওই টুপিটি আইএসের নয়, নব্য জেএমবির টুপি হতে পারে।
এদিকে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তফা কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, আদালতে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে দণ্ডিত আসামির মাথায় ওই টুপি কীভাবে এল, তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি করেছেন তারা।
একজন অতিরিক্ত আইজিকে প্রধান করে তিন সদস্যের এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাঁচ দিনের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
“কমিটি কারাগারের বিষয়টি খতিয়ে দেখবে,” বলেন কারা মহাপরিদর্শক মোস্তফা কামাল।
বাংলাদেশ সময়: ৯:৫৩:২৮ ৬১২ বার পঠিত #আদালত ফাঁসির রায় #জঙ্গিবাদ