Next
ভয়ঙ্কর সেই রাত বদলে দিয়েছে বহু মানুষের জীবন, সেই রাতের বিভীষিকা নাড়িয়ে দিয়ে গেছে পুরো বাংলাদেশকে।২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় নিহত হন ২২ হন, যাদের সতের জনই বিদেশি। ১২ ঘণ্টা পর কমান্ডো অভিযানের মধ্য দিয়ে সেই সঙ্কটের রক্তাক্ত অবসান ঘটে।
‘আল্লাহু আকবর’ বলে হামলা শুরু
রোজার ঈদের তখন সপ্তাহখানেক বাকি। শুক্রবার সন্ধ্যার পর গুলশান এলাকা অনেকটাই সুনসান। এর মধ্যেই রাত পৌনে ৯টায় গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় বিদেশিদের কাছে জনপ্রিয় রোস্তারাঁ হলি আর্টিজান বেকারিতে শুরু হয় গোলাগুলি।
খবর পেয়ে টহলে থাকা এসআই রিপন কুমার দাসসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য পাঁচ মিনিটের মাথায় ঘটনাস্থলে পৌঁছান। তারা দেখতে পান, ‘আল্লাহ আকবর’ ধ্বনি দিয়ে ওই রেস্তোরাঁর ভেতরে এলোপাতাড়ি গুলি ও বোমাবাজি চলছে। পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে আতঙ্কিত মানুষ।
এক পর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে শুরু হয় হামলাকারীদের গোলাগুলি। শুরুতেই এসআই ফারুক হোসেন, কনস্টেবল প্রদীপ চন্দ্র দাস ও আলমগীর হোসেন এবং রাজ্জাক নামের এক পথচারী আহত হন। আরও পুলিশ এলে আহতদের পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেলে।
বড় কিছু ঘটছে বুঝতে পেরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য উপস্থিত হন ৭৯ নম্বর সড়কের আশপাশে। ওই এলাকায় যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঘিরে ফেলা হয় হলি আর্টিজান বেকারি এলাকা।
উপ কমিশনার এস এম মোস্তাক আহমেদের ডাকে পুলিশের গুলশান বিভাগের সব থানার ওসিরা ততক্ষণে তাদের বাহিনী নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন ঘটনাস্থলে। ঢাকার তখনকার পুলিশ কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলামও চলে এসেছেন।
হলি আর্টিজান বেকারিতে মানুষ আটকা পড়ে থাকায় রাত সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশ তাদের উদ্ধারে অগ্রসর হয়। তখন শুরু হয় ব্যাপক গোলাগুলি। হামলাকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে কয়েকটি গ্রেনেড ছোড়ে। ওই পরিস্থিতিতে জনা ত্রিশেক পুলিশ সদস্য আহত হন।
বনানী থানার ওসি মো. সালাহউদ্দিন খানকেও ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়া হয় কাছের ইউনাইটেড হাসপাতালে। রাত অনুমান সোয়া ১১টার পর তার মৃত্যুর খবর আসে। কিছুক্ষণ পর মারা যান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম।
আটকে আছে মানুষ
হামলার ভয়াবহতা তখনও পুরোপুরি আঁচ করতে পারেনি মানুষ। ৭৯ নম্বর সড়কের মাথায় পুলিশের ব্যারিকেডের কাছে ভিড় করে উৎসুক জনতা। ততক্ষণে সাংবাদিকরাও সেখানে উপস্থিতে হয়েছেন, কয়েকটি টেলিভিশন লাইভও শুরু করে দিয়েছে।
বেকারির সুপারভাইজার সুমন রেজা এক টেলিভিশন লাইভে বলেন, কয়েকজন যুবক হঠাৎ সেখানে ঢুকে পড়ে; তাদের হাতে ছিল পিস্তল, সাব মেশিনগান আর ধারালো অস্ত্র। ভেতরে অতিথিদের মধ্যে ২০ জনের বেশি বিদেশি ছিলেন। হামলাকারীরা বোমাবাজি শুরু করলে তিনি নিজে এবং ক্যাফের কয়েকজন কর্মী দোতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে পালাতে সক্ষম হন। কিন্তু ভেতরের কাউকে তিনি ফোনে পাচ্ছেন না।
র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ রাত ১১টার দিকে ঘটনাস্থলের কাছে ব্রিফিংয়ে এসে বলেন, কয়েকজন অস্ত্রধারী হলি আর্টিজান বেকারিতে প্রবেশ করেছেন। দেশি বিদেশি বেশ কয়েকজন ভেতরে আটকা পড়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের জন্য যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে।
বিভ্রান্তিকর খবর এড়াতে এবং আতঙ্ক সৃষ্টি ঠেকাতে টেলিভিশনগুলোকে গুলশান সঙ্কটের সরাসরি সম্প্রচার না করতে অনুরোধ করেন বেনজীর। এরপর টেলিভিশনগুলো ওই রাস্তায় সরাসরি সম্প্রচার থেকে সরে যায়।
কিন্তু জিম্মি সঙ্কটের খবরে সারাবিশ্বের নজর ততক্ষণে নিবদ্ধ হয়েছে গুলশানের দিকে। বিবিসি, সিএসএনসহ বিশ্বের নেতৃত্বস্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো টেলিভিশন ও ওযেবসাইটে নিয়মিত ঢাকার খবরের আপডেট দিতে শুরু করে।
হামলাকারী পাঁচ তরুণ- নিবরাজ ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল, মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল।
আইএস?
ইস্টারনেটে জঙ্গি কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি করা আন্তর্জাতিক সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ রাত ১২টার দিকে খবর দেয়, হলি আর্টিজান বেকারির হামলাকারী হিসেবে পাঁচ তরুণের ছবি প্রকাশ করে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের মুখপত্র আমাক।
হলি আর্টিজান বেকারিতে কতজন আটকা পড়েছেন তার নিশ্চিত সংখ্যা জানা না গেলেও উৎকণ্ঠা নিয়ে বেশ কয়েকজন স্বজন উপস্থিত হন ঘটনাস্থলে। ভেতরে কয়েকজন ইতালীয় ব্যবসায়ী রয়েছেন বলে ধারণার কথা জানায় ঢাকার ইতালিয়ান দূতাবাস।
গুলশান ২ নম্বর সার্কেলের দিকে যাওয়ার পথে বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে কয়েক কিলোমিটার রাস্তা আটকে দেওয়া হয় হামলার পরপরই। নিরাপত্তা কড়াকড়ির ফলে ঢাকার অভিজাত ওই এলাকার বাসিন্দাদের পাশাপাশি আশপাশের বিপণিবিতান ও রেস্তোরাঁয় আসা লোকজন ও তাদের স্বজনরা ভোগান্তিতে পড়েন। তাদের বাড়ি ফিরতে হয় উৎকণ্ঠার মধ্যে।
প্রস্তুতি শুরু
মধ্যরাতের পর থেকে গুলি ও বিস্ফোরণের ঘটনা কমে আসে এবং পরিস্থিতি থমথমে হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে রাত ১টার পর থেকে কমান্ডো অভিযানের প্রস্তুতির আঁচ পাওয়া যেতে থাকে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন নৌবাহিনীর একটি কমান্ডো দল; সেনাবাহিনীর একটি প্রতিনিধি দলকেও দেখা যায়।
এক পর্যায়ে ৭৯ নম্বর সড়কের মোড়ে পুলিশের কয়েকটি সাঁজোয়া যান এনে রাখা হয়। অ্যাম্বুলেন্সের পাশাপাশি প্রস্তুত রাখা হয় ফায়ার সার্ভিস এবং বিদ্যুৎ বিভাগের গাড়ি।
নিরাপত্তার স্বার্থে ঘটনাস্থলের পাশ থেকে গণমাধ্যমকর্মীসহ সাধারণ মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে দেওয়া হয়।
হত্যাযজ্ঞ
হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে বা গুলি করে ২০ জনকে হত্যা করে জঙ্গিরা। তাদের মধ্যে নয়জন ইতালীয়, সাতজন জাপানি এবং একজন ভারতীয় নাগরিক। বাকি তিনজন বাংলাদেশি।
বেকারির ভেতরে হত্যাযজ্ঞের রক্তাক্ত ছবিও গভীর রাতে দেখানো হয় আইএসের মুখপত্র আমাকে।
এরপর মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস এর দায় স্বীকারের খবর আসে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে।
পরে তদন্তে জানা যায়, জঙ্গিরা এক বিদেশি নাগরিকের মোবাইল ফোন নিয়ে সেখান থেকে ইন্টারনেটে যোগাযোগ রেখেছিল বাইরে থাকা জঙ্গিদের সঙ্গে। সেখান থেকেই পাঠানো হয়েছিল রক্তাক্ত লাশের ছবি।
নতুন ভোরের অপেক্ষা
গুলশানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রস্তুতির মধ্যেই অভিযানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তখনকার পুলিশ প্রধান এ কে এম শহীদুল হক, র্যাব প্রধান বেনজীর আহমেদসহ বিভিন্ন বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা কয়েক ঘণ্টা সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
ওই বৈঠক শেষে পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ফেরার পর ভোর ৫টার দিকে হ্যান্ড মাইকে সাধারণ পোশাকের সবাইকে সেখান থেকে সরে যেতে বলা হয়। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা সাদা পোশাকে সেখানে আছেন, তাদের সবাইকে বাহিনীর ভেস্ট পড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়।
ভোরের মেঘলা আকাশে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা হলি আর্টিজান বেকারির আশপাশের পুরো এলাকা ঘিরে অবস্থান নেয়।
‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’
সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে শুরু হয় সেনাবাহিনীর কমোন্ডো অভিযান ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’। প্যারা কমান্ডোদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানকেও অভিযানে অংশ নিতে দেখা যায়।
প্রথমে কিছু সময় গুলির পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বড় ধরনের বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায় দূর থেকে। এক পর্যায়ে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যান হলি আর্টিজানের দেয়াল ভেঙে ভেতরে ঢোকে। ওই কম্পাউন্ডের বাইরের দিকে থাকা পিজা কর্নার গুঁড়িয়ে যায়। এসময় লেক ভিউ ক্লিনিকের পার্কিংয়ে রাখা দুটি গাড়ি দুমড়ে যায়।
অভিযান শেষে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ফায়ার এক্সটিংগুইশার নিয়ে ওই ভবনে যায়। কিছু সময় পর একদল চিকিৎসকও স্ট্রেচার নিয়ে ওই ক্যাফের ভেতরে যান। কমাণ্ডো অভিযানে মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে আসেন কয়েকজন।
২ জুলাই দুপুর পৌনে ১২টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুলশানের ঘটনাকে জঙ্গি হামলা আখ্যায়িত করে বলেন, ঘটনাস্থল থেকে নারী-শিশুসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।
দুপুর দেড়টায় সংবাদ সম্মেলন করে অভিযানের বিস্তারিত তুলে ধরে আইএসপিআর। জানানো হয়, ২০ জনকে রাতেই হত্যা করে হামলাকারীরা। বেকারির বাইরে গুলি ও বোমায় নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। সকালে কমান্ডো অভিযানে পাঁচ জঙ্গি এবং বেকারির এক কর্মী নিহত হয়।
ঢাকার গুলশানে ক্যাফেতে জঙ্গি হামলায় হতাহতের ঘটনায় জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রেখে শোক পালিত হচ্ছে বাংলাদেশে। ছবিটি রোববার সকালে হাইকোর্ট থেকে তোলা।
জঙ্গিবাদ নির্মূলের শপথ
২ জুলাই রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিহতদের স্মরণে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেন তিনি।
সেই সঙ্গে জঙ্গিবাদ নির্মূল করে বাংলাদেশকে একটি শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রত্যয় জানান প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশ সময়: ১১:১০:০৫ ৬৫২ বার পঠিত