বঙ্গ-নিউজ: ২৬ বছর আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চনকে হারানোর যন্ত্রণা বুকে চেপে তারকা খ্যাতির মোহ ছেড়ে পর্দা থেকে বেরিয়ে নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে রাজপথে নেমেছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন।
সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর কাকরাইলে নিরাপদ সড়ক চাই-এর কার্যালয়ে আলাপকালে স্মৃতিকাতর হয়ে উঠলেন দেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র নায়ক।
স্ত্রীকে হারানোর ২৬ বছর পরও স্মৃতি হাতড়ে তাকে খুঁজে ফেরেন সাড়ে ৩ শ’রও বেশি চলচ্চিত্রের এ অভিনেতা।
কান্না আটকে রাখা কণ্ঠে তিনি বললেন, “স্ত্রী আমাকে এতো ভালোবাসত। অনেক সময় আমি বলতাম, আমি যদি তাকে না ভালোবাসি তাহলে আমি মানুষ নামের যোগ্য হতে পারি না।…সেই মানুষটা এতো অল্প সময়ে চলে গেলে। আমি এখনও কিন্তু স্মৃতি হাতড়ে তাকে খুঁজে বেড়াই। এতো অল্প বয়সে সে কোথায় হারিয়ে গেল।”
১৯৯৩ সালে ২২ অক্টোবর নিজ হাতে বিস্কুট বানিয়ে দুই সন্তানকে নিয়ে বান্দরবানে স্বামীর শুটিং সেটে যাওয়ার পথে চট্টগ্রামের পটিয়া এলাকায় বিপরীত দিক থেকে আসা এক ট্রাকের ধাক্কায় অকালে প্রাণ হারান জাহানারা কাঞ্চন।
স্ত্রীকে হারানোর পর তার মনস্তত্বে বেশ পরিবর্তন আসে; এফডিসির লাইট-ক্যামেরা আর অ্যাকশনের চিরচেনা রঙিন ভূবন ছেড়ে রাজপথে নেমে নিরাপদ সড়কের আন্দোলন শুরু করেন।
“নিজের স্ত্রীকে বাঁচাতে না পারলেও দেশের হাজারো মানুষকে সচেতন করে তুলতে সংগঠনটির কাজ শুরু করি।”
তারকা হয়ে উঠার আগেই পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী আবদুল হাফিজ ও গৃহিনী মা নুরবানুর মেয়ে জাহানারার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয় কিশোরগঞ্জের ছেলে ইলিয়াস কাঞ্চনের। ঢাকা সেন্ট্রাল গার্লস স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন ১৯৭৯ সালে পারিবারিকভাবে বিয়ের পিঁড়িতে বসে জাহানারা।
বিয়ের পর ১৯৮০ সালে মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হলেও সংসার-সন্তান সামলিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেনি। সংসারের ১৪ বছরের মাথায় মাত্র ২৯ বছর বয়সে এক মেয়ে ও এক ছেলেকে রেখে অকালে পরপারে পাড়ি জমান জাহানারা।
স্ত্রীকে হারানোর যন্ত্রণা এখনও কুড়ে কুড়ে খায় ইলিয়াস কাঞ্চনকে। তিনি স্ত্রীকে বাঁচাতে না পারলেও জাহানারা কাঞ্চন একবার তাকে পঙ্গুত্বের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন বলে জানালেন তিনি।
আলাপকালে শোনালেন সেই ঘটনা, “আমি একবার ভয়ানক সড়ক দুর্ঘটনায় পড়েছিলাম। হাত-পা পঙ্গু হওয়ার মতো দুর্ঘটনা। দেশের ডাক্তাররা বলেছিলেন, হাত-পা কেটে ফেলতে হবে। কিন্তু আমার স্ত্রী বলেছিলেন, হাত-পা কাটা যাবে না। পঙ্গু হয়ে প্রতিদিন কষ্ট পাওয়ার চেয়ে আমার মৃত্যুই ভালো।
“স্ত্রীর বিচক্ষণতার কারণে সেদিন আমার হাত-পা কাটা থেকে রেহাই পেয়েছিলাম আমি। সিঙ্গাপুরে গিয়ে সেইবার সুস্থ হয়ে ফিলে এসেছিলাম। স্ত্রীর বিচক্ষণতার কারণেই পঙ্গুত্বের হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলাম। সেই মানুষটাই সড়ক দুর্ঘটনায় আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেল।”
দুর্ঘটনার সময় মেয়ে ইসরাত জাহান ইমা ও ছেলে মিরাজুল মইন জয় মায়ের সঙ্গে থাকলেও ভাগ্যক্রমে তারা বেঁচে যান।ইমা এখন বিয়ে করে স্বামী-সন্তান নিয়ে যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। পাঁচ বছরে মাকে হারানো জয় ২০১৪ সালের দিকে যুক্তরাজ্য থেকে অর্থনীতিতে পড়াশোনা শেষ করে এখন বাবার ব্যবসায় মনোযোগ দিয়েছেন। বাবার সঙ্গে তিনি নিরাপদ সড়ক চাই-এর সঙ্গে যুক্ত আছেন; তিনি আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন।
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের ৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ঘোষণা করা হয়।
সামাজিক এ আন্দোলনের মাধ্যমে পথচারী, চালক, হেল্পারদের সচেতন করে তোলার স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৮ সালে একুশে পদক পেয়েছেন ইলিয়াস কাঞ্চন।
বাংলাদেশ সময়: ১০:৪৫:৫৩ ৭২৬ বার পঠিত #বিনোদন.সিনেমা.সিনমা জগৎ. সংস্কৃতি জগৎ