বঙ্গ- নিউজ ডটকমঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ফিরে: ফজলি আমের ভারে গাছটি এমন ন্যূব্জ হয়ে পড়েছে যে, ঘাসের ওপর শুয়েও আম মুখে নেওয়া যাবে। আর আমবাগানে বসে যদি আমের রসে দু’হাত লেপ্টে মুখ ভরিয়ে নেওয়া যায়, তবে ফলের রাজার সত্যিকারের স্বাদ পাওয়া যায়।ফলের রাজার রাজ্য ঘুরতেই চাপাইনবাবগঞ্জে যাওয়া। চাঁপাইনবাবগঞ্জের হাটবাজারগুলোতে এখন আমের জমজমাট ব্যবসা। বিভিন্ন জাতের ও বিভিন্ন স্বাদের রসালো আমের গন্ধে ভরে আছে এ সব বাজার।
আমবাগানে গেলেই যে আম কুড়োনো যাবে, সেটা কিন্তু সত্যি নয়। বাগান মালিকের অনুমতি না নিয়ে আম ছেঁড়াটা ভয়ানক অপরাধ!
আর এ জন্যই বাগানগুলোতে সাধ্যমতো দেওয়া হয়েছে কাঁটাতারের প্রাচীর। পাহারাও দিচ্ছে নিয়োগ দেওয়া প্রহরীরা।
বাগানের ভিন্ন ভিন্ন দিকে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির আম। শিবগঞ্জ বাজারের পশ্চিমের একটি বাগানে প্রবেশ করে দেখা যায়, গাছগুলো ঝুঁকে পড়েছে আমের ভারে। বিভিন্ন ওজনের ও আকৃতির আম রয়েছে বাগানে। বাঁশ দিয়ে ঠেলা দিয়ে রাখা হয়েছে বেশি নুয়ে পড়া ডালগুলোকে।
কত রকম আর প্রকারের আম! বাগানের চাষী রফিক জানান, ইতোমধ্যে, গোপালভোগ আম শেষ হয়ে এসেছে। ল্যাংড়া আর হিমসাগরও শেষের দিকে। এখন ফজলি আর সুরমা ফজলি আমের মৌসুম।
বছরের এ সময়ে লাখ মানুষের কর্মব্যস্ততা আর প্রাণচঞ্চলতায় মুখরিত গোটা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। আম কিনতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ক্রেতাদের ভিড়ে মুখরিত কানসাট।
এলকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেলার শিবগঞ্জ, সদর, গোমস্তাপুর ও ভোলাহাট এবং নাচোল উপজেলার আমবাগান থেকে শুরু করে হাট পর্যন্ত আমের উৎসব লেগেই আছে। ল্যাংড়া, লণভোগ, রিসাপাত, মিছরিদানা, কালীভোগ, বৃন্দাবনীসহ বিভিন্ন স্বাদের গুটি আম পুরোদমে কেনাবেচা হচ্ছে।
ট্রাক, যাত্রীবাহী বাস ও কুরিয়ার সার্ভিসে করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম চলে যাচ্ছে দূর-দূরান্তে। রাজশাহী থেকে ঢাকার উদ্দেশে যে সব ট্রেন ছেড়ে আসছে, সেগুলোতেও ঝাঁপিভর্তি আম।
কানসাট বাজারের আম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখন সারা বছরই আমের বেচাকেনা চলে। আমের লাভও ভালো।
মুরিদপুরের আম ব্যবসায়ী জিহাদ বলেন, “অন্যান্য ফসল আবাদে যে পরিমাণ খরচ হয়, আম ফলাতে সে তুলনায় খরচ কম। গাছ ও আমবাগানের পরিচর্যাসহ রোগবালাই দমনেও খরচ পড়ে কম।”
আমের আড়ৎদার আফতাবউদ্দিন বলেন, “আমের উৎপাদন এখন আর মৌসুমের ওপর নির্ভর করে না। কারণ, আগের তুলনায় আমের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সারাবছর আমগাছ ও আমবাগানের পরিচর্যা করেন ব্যবসায়ীরা। বাগানের ক্রেতাদের পরিচর্যায় ফল উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েক গুণ।”
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমবাগান মালিক, আম চাষী, ব্যবসায়ী, ক্রেতা-বিক্রেতারা আম বেচাকেনাকে কেন্দ্র করে ব্যস্ত সময় পার করছেন এখন।
ব্যাংক থেকে শুরু করে অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও ব্যস্ত হয়ে পড়ে এ সময়টায়। আমের মৌসুমে তাদের বাড়তি পরিশ্রম করতে হয়।
আমের ব্যবসাকে কেন্দ্র করে দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় পণ্যসহ অন্যান্য পণ্য-সামগ্রীর ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানগুলোও চাঙা হয়ে ওঠে। নিয়মিত হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোর পাশাপাশি গড়ে ওঠে নতুন নতুন অস্থায়ী খাবার দোকান।
এখনকার পুরো অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু এখন আম। গাছ থেকে আম পেড়ে আড়তে নিয়ে এসে টুকরিজাত (বাঁশের ঝুড়ি) করে ট্রাকে লোড দেয় নির্দিষ্ট শ্রমিকেরা। আরেক শ্রেণীর শ্রমিক টুকরি বানান। আবার এসব টুকরির জন্য জেলার বাইরে থেকে বাঁশ সংগ্রহ করে টুকরির মালিকদের কাছে বিক্রি করেন অনেকেই।
তবে বর্তমানে টুকরির বদলে ক্যারেটও ব্যবহৃত হচ্ছে। গোটা মৌসুম জুড়ে আমবাগান মালিক ও আম চাষীদের পাশাপাশি এক শ্রেণীর মানুষ আম বেচাকেনা করে রোজগারের পথ সৃষ্টি করেন।
সে সঙ্গে ফড়িয়ারাও এ সময় দু’পয়সা ইনকাম করেন। বাগান থেকে আম পরিবহন করে বাজারে বা আড়তে পৌঁছে দিতে রিকশা-ভ্যানচালকেরা এ সময় বেকার থাকেন না। বাস-ট্রাকগুলো বেশি ভাড়ায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ভিন্ন জেলায় আম পৌঁছে দেয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের সাধুরঘাট, পৌর মার্কেট, রাণীহাটি, মহারাজপুর, মল্লিকপুরসহ বিভিন্ন হাটবাজারে গড়ে উঠেছে অসংখ্য আমের আড়ৎ।
কানসাটে আম ব্যবসায়ী ফরিদুল আলম, আব্দুল খালেকসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ল্যাংড়া প্রতি মণ আম বিক্রি হচ্ছে, দুই হাজার পাঁচশ টাকা থেকে তিন হাজার টাকায় ও গুটি আম এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকায় পর্যন্ত। ফজলি আর সুরমা ফজলি বিক্রি হচ্ছে, প্রতি মণ এক হাজার পাঁচশ থেকে দুই হাজার টাকায়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে ২৩ হাজার ৭০ হেক্টর আমবাগান গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে চাঁপাই সদর উপজেলায় তিন হাজার সাতশ ৮০ হেক্টর, গোমস্তাপুর উপজেলায় দুই হাজার আটশ ৫৫ হেক্টর, শিবগঞ্জ উপজেলায় ১২ হাজার সাতশ ৮৫ হেক্টর, ভোলাহাট উপজেলায় দুই হাজার হেক্টর এবং নাচোল উপজেলায় এক হাজার ছয়শ ৫০ হেক্টর এবং আম গাছ রয়েছে প্রায় ১৬ লাখ ১৪ হাজার নয়শটি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫:১৫:২৫ ১৪৩৩ বার পঠিত