বঙ্গ-নিউজঃ বেতন-বৈষম্য নিরসনের এক দফা দাবিতে সর্বাত্মক আন্দোলনে যাচ্ছেন সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাড়ে তিন লাখ শিক্ষক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকদের মোট ১৪টি সংগঠন মিলে সম্প্রতি গঠিত হয়েছে ‘বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক ঐক্য পরিষদ’। এই পরিষদের মাধ্যমে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রধান শিক্ষকদের জাতীয় বেতন স্কেলের দশম গ্রেডে ও সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডে বেতন দেওয়ার দাবিতে আগামী ১৪ অক্টোবর সারাদেশের প্রায় ৬৬ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করা হবে। পরদিন ১৫ অক্টোবর পালন করা হবে দুই ঘণ্টার কর্মবিরতি। তার পরের দিন ১৬ অক্টোবর এসব বিদ্যালয়ে অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করবেন শিক্ষকরা। ১৭ অক্টোবর পূর্ণ দিবস কর্মবিরতিতে যাবেন তারা। এরপরও দাবি আদায় না হলে ২৭ অক্টোবর রাজধানী ঢাকায় মহাসমাবেশ করা হবে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার কর্মসূচি চলবে।
১৪টি সংগঠনের সম্মিলিত মোর্চা বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ সমকালকে বলেন, আমাদের (প্রাথমিক শিক্ষকদের) পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। বাধ্য হয়ে তারা সর্বাত্মক আন্দোলনে যাচ্ছেন। ৬ অক্টোবর জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবেন। মন্ত্রণালয়ে লিখিত আবেদনের মাধ্যমে তাদের দাবির বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে আবারও চূড়ান্তভাবে অবহিত করা হবে বলে তিনি জানান।
প্রাথমিক শিক্ষকদের আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সাধারণ অভিভাবকরা। তারা বলেন, আগামী মাসে (১৭ নভেম্বর) শুরু হতে যাচ্ছে চলতি বছরের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও ইবতেদায়ি পরীক্ষা। ইংরেজি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে শুরু হবে এ পরীক্ষা। ২৪ নভেম্বর গণিত পরীক্ষা আয়োজনের মাধ্যমে শেষ হবে এ পরীক্ষা। পরীক্ষার আর দেড় মাস মাত্র বাকি। এ মুহূর্তে শিক্ষকরা বিদ্যালয় বন্ধ করে লাগাতার ধর্মঘটে গেলে শিশু শিক্ষার্থীদের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। তাই দ্রুত সরকারকে শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনায় বসে সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আকরাম আল হোসেন সমকালকে বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন-বৈষম্য কমাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তারা আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা শতভাগ আন্তরিক এ বিষয়ে। তবে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের কোনো ক্ষতি হয়, এমন কোনো কর্মসূচি শিক্ষকদের না দেওয়ার জন্য তিনি আহ্বান জানান।
এর আগে গত ২৯ জুলাই এই শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর এই প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। ৮ সেপ্টেম্বর তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। এরপর সারাদেশের শিক্ষকরা ক্ষুব্ধ হয়ে এই আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা বর্তমানে জাতীয় বেতন স্কেলের ১১তম গ্রেডে বেতন পান। তাদের দশম গ্রেডে উন্নীত করার প্রস্তাব করেছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। সহকারী শিক্ষকরা পান ১৪তম গ্রেডে। তারা ১২তম গ্রেডে উন্নীত হবেন বলে প্রস্তাবে ছিল। প্রাথমিক শিক্ষকরা জানান, আগে প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে সহকারী শিক্ষকদের বেতনের পার্থক্য ছিল এক গ্রেড। প্রধান শিক্ষকদের পদমর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার সমান করায় এখন সে পার্থক্য দাঁড়িয়েছে তিন গ্রেড। এটি নিঃসন্দেহে বৈষম্য। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেওয়া প্রস্তাবে এ বৈষম্য কমানোর প্রচেষ্টা ছিল।
বর্তমানে সারাদেশে ৬৫ হাজার ৯০২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোকে তিন লাখ ২৫ হাজার সহকারী শিক্ষক ও ৪২ হাজার প্রধান শিক্ষক রয়েছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরেই তাদের বেতন স্কেল দশম গ্রেডে নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। বেতন নিয়ে অসন্তুষ্টি রয়েছে সহকারী শিক্ষকদের ভেতরেও।
জানা গেছে, বর্তমানে একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জাতীয় বেতন স্কেলের ১১তম গ্রেডে (১২,৫০০/-) এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকরা জাতীয় বেতন স্কেলের ১৪তম গ্রেডে (১০,২০০/-) বেতন পান। ১৬ বছর চাকরির পর একজন প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে সহকারী শিক্ষকের বেতনে ব্যবধান হবে ভাতাসহ প্রায় ২০ হাজার টাকা। শিক্ষক নেতা শামছুদ্দীন মাসুদ বলেন, বর্তমানে একজন প্রধান শিক্ষক যে স্কেলে চাকরি শুরু করেন, একজন সহকারী শিক্ষক সেই স্কেলের এক গ্রেড নিচে চাকরি শেষ করেন, যা সহকারী শিক্ষকদের জন্য চরম বৈষম্য। তিনি বলেন, আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা যে শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে চাকরিতে যোগদান করি, একই যোগ্যতায় অন্য ডিপার্টমেন্টে যারা সরকারি চাকরি করেন, তাদের বেতন গ্রেডও আমাদের তুলনায় তিন থেকে চার ধাপ ওপরে। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষকদের চেয়ে কম শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে অন্য ডিপার্টমেন্টে সহকারী শিক্ষকদের তুলনায় বেশি বেতনে চাকরি করেন। আমরা সম্মানজনক বেতন স্কেল প্রত্যাশা করি, যা আমাদের সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
জানা গেছে, ১৯৭৭ সালে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বেতন পেতেন ১৫তম গ্রেডে ৩২৫ টাকা। তখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক পেতেন ১৬তম গ্রেডে ৩০০ টাকা। প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের মধ্যে গ্রেডের ব্যবধান ছিল এক ধাপ। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বেতন পেতেন ১৬তম গ্রেডে ৭৫০ টাকা এবং একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক বেতন পেতেন ১৭তম গ্রেডে ৬৫০ টাকা। ব্যবধান ছিল ১০০ টাকা। ২০০৬ সাল পর্যন্ত একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ১৬তম গ্রেডে তিন হাজার ১০০ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক ১৭তম গ্রেডে তিন হাজার টাকা বেতন পেতেন। ব্যবধান ১০০ টাকাই ছিল। কিন্তু ২০০৬ সালের ২৯ আগস্ট বেতন আপগ্রেডের নামে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকদের ১৩তম গ্রেডে তিন হাজার ৫০০ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকদের ১৫তম গ্রেডে তিন হাজার ১০০ টাকা বেতন নির্ধারণ করা হয়। এ সময় দুই ধাপ বেতন-বৈষম্যের সৃষ্টি হয় এবং বেতনের ব্যবধান হয় ৪০০ টাকা।
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন ও পদমর্যাদা বৃদ্ধির ঘোষণা দেন। তখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের বেতন স্কেল নির্ধারণ করা হয় দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদাসহ ১১তম গ্রেডে ছয় হাজার ৪০০ এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকের বেতন স্কেল নির্ধারণ করা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে ১৪তম গ্রেডে পাঁচ হাজার ২০০ টাকা। বেতন গ্রেডের পার্থক্য হয় তিন ধাপ। তৃতীয় শ্রেণি থেকে প্রধান শিক্ষকরা দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত হলেও সহকারী শিক্ষকরা তৃতীয় শ্রেণির পদেই থেকে যান। বেতন আপগ্রেডের সময় মূল বেতনের ব্যবধান হয় এক হাজার ২০০ টাকা এবং ২০১৫ সালের অষ্টম জাতীয় পে স্কেলে সে ব্যবধান দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৩০০ টাকা।
বাংলাদেশ সময়: ১:৩৮:০৩ ৪৯৩ বার পঠিত # #শিক্ষক #সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে