বঙ্গ-নিউজঃ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে অনিয়ম, দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত ‘দুষ্টু কয়েদি’দের (কারাগার কর্তৃপক্ষের ভাষায়) কাশিমপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ব্রাহ্মবাড়িয়া জেলা কারাগারে শাস্তিমূলক বদলি করে দিলেও তদবির করে তারা বারবার ফিরে আসছেন।
মাদক ব্যবসা, পানি বাণিজ্য, সিট বাণিজ্যসহ ‘দুষ্টু’দের বিরুদ্ধে রয়েছে বহু অভিযোগ। আছে কারাগারে মোবাইল ব্যবহারের অভিযোগও। কিন্তু সরকারের প্রভাবশালী মহলের তদবির ও সুপারিশে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ফিরে আসছেন তারা।
এসব ‘অবাধ্য কয়েদি’রা সাধারণ বন্দিদের ওপর অত্যাচার চালানোয় টেনশন বেড়েছে কারা কর্তৃপক্ষের। সম্প্রতি দিদারুল আলম মাসুম কারাগারে গেলে এই অবাধ্য ‘দুষ্টু’ কয়েদিরা মাসুমকে দিয়ে কারাগারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেন বলে কারা সূত্রে জানা গেছে।
৪৪ লাখ টাকাসহ চট্টগ্রামের জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস গ্রেফতারের পর অনিময় ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে নতুন কারা প্রশাসন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি দীপক দত্ত ভোলা ও কয়েদি মো. শামীম উদ্দিনকে শাস্তিমূলক বদলি হিসেবে গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে পাঠান।
শাস্তিমূলক বদলি হিসেবে শিবিরের দুর্ধর্ষ ক্যাডার নাছিরকে চট্টগ্রাম থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। বিএনপির ক্যাডার বিধান বড়ূয়াকে নোয়াখালী জেলা কারাগারে এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীকে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে বদলি করা হয়। ইয়াবা গডফাদার ‘ডাইল করিম’ ওরফে রেজাউল করিমকে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। এছাড়া আরও বেশ কয়েকজন অবাধ্য বন্দিকে ধাপে ধাপে চট্টগ্রাম থেকে বিভাগের অন্য কারাগারে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়।
তবে ছয় মাসের মাথায় ‘দুষ্ট’ কয়েদি যুবলীগ ক্যাডার দীপক দত্ত ভোলা ও তার সহযোগী কয়েদি মো. শামীম উদ্দিন গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে ফের চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ফিরে আসেন। তাদের চট্টগ্রাম কারাগারে ফিরিয়ে আনার পেছনে চট্টগ্রামের সরকারদলীয় এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা উচ্চ পর্যায়ের তদবির করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কারণ এ দুই কয়েদি ৮০ লাখ টাকাসহ ধরা পড়া চট্টগ্রামের সাবেক ডিআইজি (প্রিজন্স) কারাবন্দি ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিকের দুর্নীতির সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন।
ডিআইজির কল্যাণে কারাগারে কর্ণফুলী ভবনের ১৭ নম্বর ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের মালিক বনে গিয়েছিলেন ভোলা ও শামীম। ওয়ার্ডে কোন আসামি কতটুকু জায়গায় থাকবেন তা ঠিক করতেন তারা, কে কোন জায়গায় ঘুমাবেন, কে কতটুকু খাবার পাবেন, গোসল করার জন্য কতটুকু পানি পাবেন তাও নির্ধারণ করে দিতেন তারা।
কারাগারের অন্য ওয়ার্ডে দেড়শ’ থেকে দুইশ’ বন্দি থাকলেও তাদের এ দুই ওয়ার্ডে সব সময় ৭০ থেকে ৮০ জনের বেশি বন্দি তারা রাখতেন না। দুই ওয়ার্ডে তারা প্রকাশ্যে রান্নাবান্নাও করতেন। মাদক, ওয়ার্ডে সিট ও পানি বাণিজ্য করতেন প্রকাশ্যে। কারাগারের কাউকেই তারা মানতেন না। তাদের কথায়ই ছিল শেষ কথা। যদিও চট্টগ্রামে ফেরত আসার পর তাদের কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।
শিবির ক্যাডার নাছির চট্টগ্রামে ফেরত আসার জন্য তদবির করলেও তার এখনো ফেরা হয়নি। অন্যদিকে হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে বিধান বড়ূয়া নোয়াখালী জেলা কারাগার ও গিয়াস কাদের কুমিল্লা কারাগার থেকে বের হয়ে যান।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে কাজ শুরু করি। এ পর্যন্ত কোর্ট ফেরত ২৩ বন্দির কাছ থেকে ইয়াবা উদ্ধার করার পর ২০টি ফৌজদারি মামলা রুজু করেছি। মাদকের গডফাদারদের নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। কেউ ঝামেলা করলে তাকে কারা বিধি অনুযায়ী শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। প্রয়োজন হলে বাইরের কারাগারেও বদলি করে দেওয়া হচ্ছে।’
কামাল হোসেন আরও বলেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার পর কারাগারে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য অবাধ্য কয়েকজন কয়েদি ও হাজতিকে চট্টগ্রাম থেকে অন্য কারাগারে বদলি করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার ফেরত এসেছে। ফেরত এলেও তাদের আর ওয়ার্ডে না রেখে সেলে রেখে নজরদারির মধ্যে রেখেছি আমরা। যাতে তার কেউ আর আগের মতো কোনো ঝামেলা সৃষ্টি করতে না পারেন।’
কারাগার সূত্রে জানা যায়, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি দীপক দত্ত ভোলা ও মো. শামিম উদ্দিনকে গত ১৪ ফেরুয়ারি চট্টগ্রাম কারাগার থেকে গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে বদলি করা হয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি শিবির ক্যাডার নাছির উদ্দিন ওরফে শিবির নাছিরকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগার, বিএনপির ক্যাডার বিধান বড়ূয়াকে নোয়াখালী জেলা কারাগার এবং গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীকে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে চট্টগ্রাম থেকে বদলি করা হয়।
১৩ এপ্রিল ইয়াবা গডফাদার ডাইল করিমকে কুমিল্লা কারাগারসহ আরও বেশ কয়েকজন দুষ্টু বন্দিকে বিভিন্ন কারাগারে বদলি করা হয়। এদের মধ্যে কয়েকজন ‘দুষ্টু কয়েদি’ সম্প্রতি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ফিরে আসেন। এর আগে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে মোবাইল ব্যবহার ও বাইরের মানুষকে হুমকির অভিযোগ কারাবিধি অনুযায়ী একাধিকবার সাজাও ভোগ করেছেন দুর্ধর্ষ বন্দি ভোলা, শামীম ও শিবির নাছির।
কারাগারে বিশৃঙ্খলার কারণে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে সাবেক জেলার মাহবুবুর রহমান তাদের দুই দফায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠান। তিনি বদলি হয়ে যাওয়ার পর কুমিল্লা থেকে ফের তারা চট্টগ্রাম কারাগারে ফিরে আসেন।
এর আগে ২০১৪ সালের ২০ জুন দীপক দত্ত ভোলাসহ ৯ দুর্ধর্ষ বন্দির সেলে অভিযান চালিয়ে মোবাইল উদ্ধার করেন তৎকালীন চট্টগ্রাম সিনিয়র জেল সুপার (বর্তমানে ডিআইজি) মো. ছগির মিয়া। মোবাইল উদ্ধারের ঘটনায় কারাবিধি ও পেনাল কোড অনুযায়ী কয়েদি ভোলাকে ৩০ দিন ডাণ্ডাবেড়ি ও শামীমকে ৪৫ দিন ডাণ্ডাবেড়ি পরে থাকার শাস্তিও দেওয়া হয়েছিল।
আদালতে হাজিরা দিতে আনা হত্যা মামলার এক আসামি এ প্রতিবেদককে জানান, ভোলা ও শামীম কারাগারে সবসময় উত্তর চট্টগ্রামের এক প্রভাবশালী সরকারদলীয় নেতার ক্ষমতা দেখান। কেউ তাদের কথার বাইরে গেলে তাকে চড়-থাপ্পড় মেরে দেন। আগে ঘুষ দিয়ে তারা মাদকের ব্যবসাও করতেন। আরেক কারাগারে পাঠানোর পর এখন ফিরে এলেও তাদের চরিত্র আগের মতোই রয়ে গেছে। ভয়ে তাদের সঙ্গে কেউ কথা বলেন না।
বাংলাদেশ সময়: ১০:২৭:১৬ ৮৬৬ বার পঠিত # #কাশিমপুর #কুমিল্লা #কেন্দ্রীয় কারাগারে #চট্টগ্রাম #নোয়াখালী #ব্রাহ্মবাড়িয়া জেলা