বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃবিক্ষোভ-প্রতিবাদের মুখে ৩৪তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি)।বুধবার বিকালে পিএসসি এই সিদ্ধান্তের কথা জানায়, তার আগে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত শাহবাগ মোড় অবরোধ করে রাখে অনুত্তীর্ণ হাজার খানেক পরীক্ষার্থী।
সরকারি চাকরিতে নিয়োগের এই পরীক্ষার প্রাথমিক বাছাই বা প্রিলিমিনারির ফল গত সোমবার প্রকাশের পর থেকে তা নিয়ে অসন্তোষ দেখা যাচ্ছিল।
প্রিলিমিনারিতেই কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করে ফল প্রকাশ করায় মেধাবী অনেকে শুরুতেই বাদ পড়েছে বলে অভিযোগ বিক্ষুব্ধদের। আগে চূড়ান্ত পরীক্ষার সময়ই কোটা অনুসরণ করে ফল প্রকাশ হতো।
বিক্ষুব্ধ পরীক্ষার্থীরা ফল বাতিলের পাশাপাশি কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিও তোলে, যদিও এই বিষয়ে পিএসসির কোনো স্পষ্ট ভাষ্য পাওয়া যাচ্ছিলো না।
দুপুরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আব্দুস সোবহান সিকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সরকারের পক্ষ থেকে প্রিলিমিনারিতে কোটা সংরক্ষণের কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি।
এরপর বিকালে পিএসসির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ফল পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আ ই ম নেছার উদ্দিন স্বাক্ষরিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “৩৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারির ফলাফল নিয়ে কিছু সংখ্যক প্রার্থীর মধ্যে সৃষ্ট ভুল বোঝাবুঝির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি কর্মকমিশন বিষয়টি পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
এবার প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় ২ লাখ ২১ হাজার পরীক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল, যার মধ্যে উত্তীর্ণ হয় ১২ হাজার ৩৩ জন।
আগে লিখিত পরীক্ষার পর কোটার ভিত্তিতে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ হলেও এবার প্রাথমিক বাছাইয়েই কোটার ভিত্তিতে ফল দেয়া হয়।
৩৪তম বিসিএসের দায়িত্বে থাকা পিএসসির সদস্য মুহম্মদ লিয়াকত আলী খান মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, “এবার প্রিলিমিনারি পর্যায় থেকেই যে কোটায় যতগুলো পদ আছে, তার বিপরীতে প্রার্থী নেয়া হয়েছে।”
এতে বেশি নম্বর পেয়েও অনেকে বাদ পড়েন এবং তুলনামূলক কম নম্বর পেয়েও অনেকে উত্তীর্ণ হন বলে পরীক্ষার্থীরা দাবি করেন, যা স্বীকার করেন পিএসসি কর্মকর্তারাও।
মঙ্গলবার বিক্ষোভ মিছিলের পর বুধবার সকালে অবরোধ শুরু করে অনুত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীরা।
এরপর সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পিএসসির শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা হলেও কারো সাড়া পাওয়া যায়নি।
এরপর দুপুরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব কথা বলেন। সরকারের কোনো নির্দেশনা ছিল না জানানোর পাশাপাশি তিনি বলেন, পিএসপি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
বিকালে পিএসসির সিদ্ধান্ত আসে।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেয়। তখন গুরুত্বপূর্ণ ওই সড়কে চার দিকেই যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
ধীরে ধীরে বিক্ষোভে অংশ নেয়াদের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং দুপুরে তা হাজার ছাড়িয়ে যায়।
‘বঞ্চিত শিক্ষার্থী’ ব্যানারে এই বিক্ষোভে অধিকাংশই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
অবরোধের খবর শুনে শাহবাগে গিয়ে আন্দোলনকারীদের দাবির প্রতি সমর্থন জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আমজাদ আলী।
বিক্ষোভে অংশ নেয়া মাহাবুব রহমান বলেন, “এই বিসিএস (৩৪তম) সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেখানে ৭৮/৭৯ পেয়েও সুযোগ পাচ্ছেন না, সেখানে কোটাধারীরা ৬০/৬১ পেয়েও সুযোগ পেয়েছে।”
আন্দোলনে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের অনেকেও ছিলেন, যাদের জন্য কোটা সংরক্ষিত রয়েছে।
তাদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহেদুল ইসলাম বলেন, “কোটার একটা সহনীয় মাত্রা থাকতে হবে। কোটাকে যেন এমন মাত্রায় নিয়ে যাওয়া না হয়, যাতে জাতি মেধাশূন্য হয়।”
প্রক্টর আমজাদ আলী দুপুর ১২টার দিকে শাহবাগে যান।
তিনি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেন, “আমার ছাত্রদের দাবির সঙ্গে অামি একমত। কেউ ৮০ পেয়ে ফেল করবে, আর কেউ ৫০ পেয়ে পাস করবে, এই বৈষম্য চলতে পারে না।”
পিএসসির কিছু ‘অতি উৎসাহী’ ব্যক্তি সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য কোটার ভিত্তিতে প্রিলিমিনারির ফল দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক আমজাদ।
বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীরা পরীক্ষার ফল বাতিল এবং কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবি জানান।
শিক্ষার্থীদের পক্ষে দাবি উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. শাহীন আলম।
তাদের প্রথম দাবি হচ্ছে- সরকারি চাকরির পরীক্ষায় সব ধরনের কোটা বাতিল করে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিশ্চিত করা। সেই সঙ্গে ৩৪তম বিসিএসের ফলাফল পুনঃমূল্যায়ন।
শাহীন আলম জানান, বুধবার রাত ১০টা পর্যন্ত শাহবাগে অবস্থানের পর বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা থেকে পুনরায় অবস্থান নেবেন তারা।
‘৮৯টি সঠিক উত্তর দিয়েও চান্স পাইনি’
প্রিলিমিনারিতে ১০০টির মধ্যে ৯৩টি প্রশ্নের ঠিক উত্তর দেয়ার দাবি করে মাহাতাব নামে একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি উত্তীর্ণ না হলেও ৬৪ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন তারই এক বন্ধু।
শুভ, আরিফ ও জাকিয়া নামের তিন প্রার্থীও বলেন, নব্বইয়ের বেশি নম্বর পেয়েও বাদ পড়েছেন তারা।
৩১ ও ৩৩তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিলেও ৩৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারিতে ঠাঁই পাননি নূর।
তিনি , “একশ’র মধ্যে ৮৯ পেয়েও প্রিলিতে চান্স পাইনি। ঠিকমতো রেজাল্ট দেয়া হয়নি বলেই মনে হচ্ছে।”
৩১তম বিসিএসে চাকরি পেলেও পছন্দের ক্যাডার পেতে ৩৪তমের প্রিলিমিনারিতে অংশ নেন সমীর, তবে উত্তীর্ণ হতে পারেননি।
তিনি ক্ষোভের সঙ্গেই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই বিসিএসে অংশ নেয়া আমার অন্য বন্ধুরাও বলছে এবারের ফল প্রকাশে কোনো একটা ঝামেলা হয়েছে। আমারও তাই মনে হচ্ছে। আমরা এর একটা বিহিত চাই।”
প্রিলিমিনারির নম্বর কখনোই প্রকাশ করে না পিএসসি এবং এই নম্বর নিয়ে চাকরি প্রার্থীরা চ্যালেঞ্জও করতে পারেন না।
৩৩তম বিসিএসের প্রিলিমিনারির ফল পরীক্ষা নেয়ার ২১ দিন পর দেয়া হলেও এবার তা দেয়া হয়েছে ৪৫ দিনের মাথায়।
পিএসসির ওই কর্মকর্তা বলেন, “প্রিলির ফল প্রকাশ নিয়ে পিএসসি কর্মকর্তারা চার দফা সভা করেন। এতেও কিভাবে ফল দেয়া হবে তা ঠিক না হওয়ায় গত ৩ জুলাই সর্বশেষ সভায় ‘বিশেষভাবে’ প্রিলিমিনারির ফল দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।”
‘কোটা নিয়ে কোনো নির্দেশনা ছিল না’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আব্দুস সোবহান সিকদার দুপুরে বলেন, “৩৪তম বিসিএসের প্রিলির ফল প্রকাশে সরকারের পক্ষ থেকে নতুন কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। পিএসসি সচিবের সঙ্গে সকালে আমার কথা হয়েছে তিনি বলেছেন, আগের নিয়মেই ফল দেয়া হয়েছে।”
এছাড়া সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি ‘সংস্কার’ সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে আপাতত কোনো উদ্যোগ নেই।”
পিএসসি সদস্য লিয়াকত আলীর এই বক্তব্য জানানো হলে আব্দুস সোবহান বলেন, “তারা তো সম্পূর্ণ স্বাধীন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে নতুন করে কোনো ডিরেকশন দেয়া হয়নি।”
পিএসসির মুখে কুলুপ
৩৪তম বিসিএসের ফল নিয়ে বুধবার সকাল থেকে সরকারি কর্ম কমিশনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কেউই এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। কমিশনে গিয়েও কর্মকর্তাদের ‘অনুমতি’ না মেলায় পিএসসিতে ঢোকা যায়নি।
কমিশনের চেয়ারম্যান এটি আহমেদুল হক চৌধুরীর সঙ্গে সকাল ৯টা থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়।
এক সময় তার ব্যক্তিগত সহকারী বলেন, “স্যার মিটিংয়ে আছেন।”
পরে আবার যোগাযোগ করা হলে চেয়ারম্যানের দপ্তর থেকে বলা হয়, “স্যার ভাইবা বোর্ডে গেছেন।”
দুপুরে আবারো যোগাযোগ করা হলে কর্মকর্তারা বলেন, “এ বিষয়ে স্যার পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে কথা বলতে বলেছেন।”
পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ক্যাডার) আ ই ম নেছার উদ্দিনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা তাকে উদ্ধৃত করে বলেন, “১১টার পর ফোন দিতে বলবেন। আমি কথা বলব।”
কিন্তু ১১টার পর থেকে নেছারের মোবাইল ও টিঅ্যান্ডটি নম্বরে একাধিকবার ফোন করলেও কেউ তা ধরেননি।
পরে পিএসসির সচিব চৌধুরী মো. বাবুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার দপ্তর থেকে বলা হয়, “এ বিষয়ে কমিশনের যুগ্ম-সচিব মো. ইউসুফ আলীর সঙ্গে কথা বলেন। স্যার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন না।”
ইউসুফ আলীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তার মাধ্যমে জানান, “এ বিষয়ে কথা বলার আমি কেউ না। আমি শুধু প্রশাসনিক দিকগুলো দেখি।”
৩৪তম বিসিএসের দায়িত্বে থাকা পিএসসির সদস্য মুহম্মদ লিয়াকত আলী খানের সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
পরে দুপুরে পুরাতন বিমানবন্দরে কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে চেয়ারম্যান অথবা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে অভ্যর্ত্থনা কক্ষ থেকে বলা হয়, “ভেতরে যেতে কারো না কারো অনুমতি লাগবে। আমরা অনুমতি ছাড়া কাউকেই যেতে দেব না।”
পিএসসির কোনো কর্মকর্তার অনুমতি না মেলায় কমিশনের ভেতরে যাওয়াও সম্ভব হয়নি।
অবশ্য বছরের অন্য সময়ও পিএসসিতে সাংবাদিকরা প্রবেশ করতে পারেন না। এ নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে ক্ষোভও রয়েছে।
পিএসসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পাঁচ দফা সভা করে ৩৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারির ফল কিভাবে দেয়া হবে তা ঠিক করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ২২:০৫:৪১ ৪০০ বার পঠিত