বঙ্গ-নিউজঃআজ ১২ সেপ্টেম্বর বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের মৃত্যু বার্ষিকী। দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগে ২০০৯ সালের এই দিনে তিনি সিলেটের নুরজাহান জেনারেল হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। শাহ আব্দুল করিমের ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁকে উজান ধল গ্রামে তার স্ত্রীর কবরের পাশে সমাহিত করা হয়।তিনি তার গানে জীবন এবং মৃত্যু সম্পর্কে এভাবে বলেন,
কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু
ছেড়ে যাইবা যদি?
কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু
ছেড়ে যাইবা যদি?
কেমনে রাখবি তোর মন
আমার আপন ঘরে বাধিরে বন্ধু
ছেড়ে যাইবা যদি…
কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু
ছেড়ে যাইবা যদি?
“
দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের জন্য বিভিন্ন কর্মমূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। বাউল সম্রাটের একমাত্র পুত্র নূর জালাল জানান, মঙ্গলবার বাদ জোহর মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। বিকেলে বাউল সম্রাটের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা সভা করা হবে।এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক আব্দুল আহাদ, বিশেষ অতিথি দিরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার শরিফুল ইসলাম। বাদ এশা থেকে ফজর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত করিম ভক্তরা করিমগীতের আসর বসাবেন।ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নের ধল আশ্রম গ্রামে ১৯১৬ ইংরেজীর ১৫ ফেব্রুয়ারী শাহ আব্দুল করিম জন্ম গ্রহণ করেন। শাহ আব্দুল করিমের জন্মের সময় তখনকার সমাজ, পরিবেশ, পরিস্থিতি ইংরেজদের আনুকূল্যে বেড়ে উঠেছেন। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন মারা যান মখন শাহ আব্দুল করিমের বয়স ২৫। সে সময়টায় বেঁচে ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। শাহ আব্দুল করিম বেড়ে ওঠার সময় লোক সাহিত্যের একটি উজ্জল পরিবেশ ছিল।শাহ আব্দুল করিমের জন্ম এক দিনমজুর পরিবারে। পিতা ইব্রাহীর আলী মা নাইওরজান বিবি। জন্মের পর থেকে অভাবের মধ্যেই তিনি বেড়ে উঠেন। অভাবের কারণে শিক্ষা লাভের সুযোগ আসেনি তার জীবনে। তাই গ্রামের মড়লের বাড়িতে গরু রাখালের চাকরী নিলেন তিনি। সাড়া দিন মাঠে গরু ছড়াতেন আর গান গাইতেন। এ গানই রাখাল বালককে বাউল সম্রাটে পরিণত করেছে।১৯৫৪ সারে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে মৌলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বৃহত্তর সিলেটে গণসংযোগে আসতেন তখন তাদের সফরসঙ্গী হতেন বাউল আব্দুল করিম।১৯৬৭ সালে শেখ মুজিব পাকিস্তানের দুর্নীতি দমন মন্ত্রী থাকা অবস্থায় সুনামগঞ্জে প্রথম সরকারী সফরে আসেন। কোন এক কারণে সেদিন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর জনসভা বর্জন করেছিলেন। তখন শাহ আব্দুল করিম জনসভাস্থলে এসে গান ধরেন তখন জনসভাস্থল লোকে লোকারন্ন হযে উঠে। ১৯৬৯ সালে সুনামগঞ্জের জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে করিমের গণসঙ্গীত শুনে আবেগে আল্পুত হয়ে শেখ মুজিব মাইকে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন , শেখ মুজিব বেঁচে থাকলে করিম ভাইও বেঁচে থাকবেন, করিম ভাই যেখানে শেখ মুজিব সেখানে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবের ভাটি অঞ্চল নির্বাচনী প্রচারাভিযানে একমাত্র মধ্য মনি ছিলেন শাহ আব্দুল করিম। ১৯৮৬ সালে শেখ হাসিনা যখন এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান চালাতে ভাটি অঞ্চলে আসেন তখন তার সফর সঙ্গী ছিলেন শাহ আব্দুল করিম। ১৯৯৫ সালে শেখ হাসিনা সুনামগঞ্জের দিরাই বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের জনসভায় শাহ আব্দুল করিমকে বলেছিলেন, ’আমার বাবা যার গানের ভক্ত ছিলেন, আমি তাকে উপযুক্ত সম্মান দেব। ২০০১ সালে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ সুনামগঞ্জ সার্কিট হাউসে এক কর্মী সভায় বলেছিলেন, সুনামগঞ্জে আওয়ামীলীগ প্রতিষ্ঠাতায় শাহ আব্দুল করিমের ভূমিকা অন্যতম।শাহ আব্দুল করিম ৫৪’র নির্বাচন ৬৯,এর গণ আন্দোলন, ৭১’এর মুক্তিযুদ্ধ, ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি পর্যায়ে স্বরচিত গনসঙ্গীত পরিবেশন করে জনতাকে দেশ মার্তৃকার টানে উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করেছেন। তাঁর গণসঙ্গীতে মুগ্ধ হয়ে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তাঁর পিটে হাত রেখে বলেছিলেন-বেটা, গানের একাগ্রতা ছাড়িও না, তুমি একদিন গণ মানুষের শিল্পী হবে।হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গণসঙ্গীত শুনে একশ পঁচাশি টাকা দেন, শেখ মুজিব ১১ টাকা দিয়ে বলেন, তোমার মতো শিল্পীকে উপযুক্ত মর্যাদা দেয়া হবে। শাহ আব্দুল করিমের গানের বিভিন্ন বই প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় আফতাব সঙ্গীত, ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত হয় গণসঙ্গীত, ১৯৮১ সালে কালনীর ঢেউ, ১৯৯০ সালে ধলমেলা, ১৯৯৮ সালে ভাটির চিঠি, ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয় শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্র।
বাংলাদেশ সময়: ১৯:২৪:৩৩ ৬১৭ বার পঠিত