##ইচ্ছেপূরণ
#অভিজিৎ_রুদ্র
স্রোতস্বিনী নদী, পশ্চিমে বয়ে যায় তার স্রোত। দুপাড়ে বেড়ে উঠে নাম না জানা কত গুল্ম, বৃক্ষ। খানেখানে মাথা উঁচু করে গড়ে উঠে মানুষের বসতি। দুপাড়ের সকল জীবনকে সঞ্জীবনী সরবরাহ করে সে আপন মহিমায়। কখনো বা দুকুল ছাপিয়ে কান্না করে সে। ভাসিয়ে নিয়ে যায় দুপাড়ের যত জঞ্জাল।
সেই স্রোতস্বিনীর পাড়েই মিষ্টি মেয়ে বিন্তিদের বাড়ি। মাথার পেছনে কাঁধভর্তি চুল, টানা টানা আঁখিপল্লব আর চপলা হরিনীর মত চালচলনে মাতিয়ে রাখে পুরো বাড়ি। তবে সেই ষোড়শী মেয়ের একটা বিশেষ স্বভাব আছে। সন্ধের আগে আগে যদি সেই স্রোতস্বিনীর পাড়ে দাঁড়ান আপনি, তবে দেখতে পাবেন বিন্তি নামের মেয়েটার হাত থেকে রংবেরঙ এর ছোট ছোট নৌকাগুলো ছুটে স্রোতের গতিতে টালমাটাল হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে পশ্চিম দিগন্তে। সেই নৌকাগুলো বয়ে নিয়ে চলে কিছু ইচ্ছে, কিছু স্বপ্ন, কিছু অনুভূতি।
বিন্তি ভাবে হয়ত স্রোতস্বিনী দেখবে, শোনবে তার কথাগুলো। আর পূরণ করবে তার ছোট্টছোট্ট ইচ্ছেগুলো। স্রোতস্বিনীর পশ্চিমের স্রোত তার ইচ্ছে গুলো বয়ে নিয়ে যাবে ইচ্ছেপূরণ দেবতার কাছে। আর তিনি পূরণ করবেন তার সকল ইচ্ছে।
এইতো সেদিন গাঁয়ের মেলা থেকে পাশের বাড়ির পাখি কতগুলো লাল,নীল বেলোয়ারী চুড়ি নিয়ে এলো। কই সে তো সেই চুড়ির জন্য বাচ্চাদের মত কত কান্না করল কিন্তু বাবা তাকে সেগুলো এনেই দিল না। তবে বাবা বলেছে আগামী চৈত্র সংক্রান্তি মেলায় তাকে চুড়ি কিনে দিবে।
কিন্তু বিন্তির কি আর এত দিন সহ্য হয়? পাশের বাড়ির পাখিটা কি সুন্দর হাতে চুড়ি পরে ঢ্যাংঢ্যাং করে নেচে বেড়ায়। দেখেই হিংসা লাগে বিন্তির।
একদিন বিকেলে সে সেই স্রোতস্বিনীর বুকে নৌকো ছুটায় চুড়ির আবদার লিখে। গালে হাত দিয়ে বসে থাকে সে সেই ছুটন্ত নৌকাগুলোর দিকে চেয়ে। আজতক তার কোন আবদার পূরণ করে নি স্রোতস্বিনী। অথচ সে কত আশা নিয়ে তার গল্পগুলো শোনায় নদীকে। প্রতিদিন সে অপেক্ষা করে তার ইচ্ছে বাস্তবের জিনিসগুলো ফিরে আসার।কিন্তু সেগুলো আসে না, একরাশ অভিমান নিয়ে মন খারাপ করে বসে থাকে বিন্তি।
কিন্তু পরদিন সক্কালবেলা নদীর ঘাটে এসে অবাক হয়ে যায় বিন্তি। বেশ বড় একটা প্লাস্টিক কাগজের নৌকোর উপর গোল লম্বামতো একটা কাগজে মোড়ানো জিনিস পরে আছে। নৌকোটা ছোট্ট একটা সুতো দিয়ে বাধা আছে। স্রোতস্বিনীর অল্প ঢেউয়ে স্বপ্নপূরনের সে নৌকো থেকে থেকে দুলছে। খুশিতে লাফ মারতে শুধু বাকি থাকে বিন্তির। প্যাকেট টা নিয়ে পরম আনন্দে খোলে সে। তার থেকে বেরোয় একরাশ ইচ্ছেপূরণের সুবাস। নীল সাদা চুড়িগুলো দেখে বিন্তির চোখে খুশির ঝিলিক দেখা যায়।
সেই সাথে চোখে থাকে স্রোতস্বিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা। এতদিনে স্রোতস্বিনী তার কথা শুনেছে।
নদীর ওপার থেকে বিন্তির চোখের হাসিটা দেখে হারান মাঝির ছেলে পরানের মুখেও ফোটে উঠে পরমানন্দের তৃপ্তি। এখান থেকে খানিক পশ্চিমে নৌকো চালায় পরান। দক্ষিণের গঞ্জ থেকে যে লোকগুলো আসে তারা স্রোতস্বিনীর স্রোত পার পরে তারই খেয়ায় চরে। প্রায় প্রতিদিনই বিন্তির ইচ্ছেনৌকো গুলো দেখে সে। গঞ্জের ইশকুল থেকে প্রবেশিকা দিয়েছে পরান। কিন্তু অভাবের সংসার, তাই বাপের অসুস্থতার জন্য কলম ছেড়ে বৈঠা ধরেছে সে। স্রোতস্বিনীর এপার ওপাড় দুইপাড়ই তার হাতের তালুর মত চেনা। তবুও মাঝে কত অচেনা লাগে। কি বিস্তৃত, দীর্ঘ তার জলরাশি, যেন দীর্ঘায়ু কামনা করা কোন বটবৃক্ষের মত আঁকাবাঁকা তার শাখাপ্রশাখা। উদাস মনে বিড়বিড় করে পরান,
“তোমার কাটা গণ্ডিতেই বন্দি আমি ভিনদেশি,
বাধ ভাঙলেই ভালোবাসা আমায় করছে ভিনদেশি। “
সকাল সন্ধে এই স্রোতস্বিনীই তার গন্তব্য, ধ্যান, জ্ঞান, সুখ। প্রায়ই সন্ধেবেলা দেখত রংবেরং এর নৌকাগুলো টালমাটাল হচ্ছে স্রোতস্বিনীর স্রোতে।
নৌকা গুলো ধরে বিন্তির ইচ্ছেগুলো পড়ে সে, ফের আবার সেগুলো ভাসিয়ে দেয় মাঝ দরিয়ায়। পরান চিনত না সেই নৌকাগুলোর মালিক কে। একদিন কৌতুহল এর বসে অনুসন্ধান করতে গিয়ে সে দেখে বিন্তিকে।
উঁহু, এ মুখ তার অপরিচিত নয়। এ মুখ যেন তার অতি পরিচিত। ঠিক যেন কোন শিল্পীর ছবি আঁকার মত। রঙিন কাগজে রংতুলিতে শিল্পীকে কখনো ছবি আঁকতে দেখেছ? একটা সাদা কাগজ আর তুলি। সেই ছবি আঁকার আগে আরেকটা ছবি আঁকা ছিল সেই সাদা কাগজে। কিন্তু সেটা কখনোই দেখবে না। কেবল শিল্পীই সেটা দেখবে। শুন্য কাগজে রংতুলি ছোঁয়াবার আগেই আরেকটা ছবি আঁকা থাকে শিল্পীর মনে। তুমি যখন ছবি আঁকতে দেখো, তখন সে কেবল মনে আঁকা সেই ছবি অনুযায়ী হাত ঘুরিয়ে যায়।
পরানের কাছে বিন্তিও তেমন। এই মুখ, ঠোঁট, নাক সব যেন কল্পনায় দেখা।
বিন্তির চুড়ির ইচ্ছে দেখে সেদিন রাতেই গঞ্জ থেকে চুড়ি কিনে আনে পরান।
তারপর থেকে আর কখনো বিন্তির আবদার ফেলেনি সেই স্রোতস্বিনী। কতই না কালো টিপ, লাল লাল ফিতে, আলতা চেয়েছে বিন্তি। তার সব আবদার পূরণ করেছে স্রোতস্বিনী। একবার তো সকালবেলা বিন্তি দেখে ঘাটে বাধা ছোট্ট নৌকাটা বিন্তির পছন্দের লাল বেনারসি নিয়ে ডুবো ডুবো। বিন্তি লাফিয়ে পরে সেটা নিয়ে বাড়িসুদ্ধ সবাইকে দেখিয়ে বেড়িয়েছে। বাড়িসুদ্ধ সবাই তাকে পাগল ঠাউরেছে। যখন তার যা ইচ্ছে করেছে তাই লিখেই নৌকা ভাসিয়েছে স্রোতস্বিনীর স্রোতে আর ওপাড় থেকে তার ইচ্ছে পূরণ করে বিন্তির অজান্তে মুচকি হেসেছে পরান।
কখনো সে সামনে যেতে পারে নি বিন্তির। বিন্তিরা উঁচু জাত, আর সে মাঝি। সমাজে সবাই তাদের ছোট জাত বলে গণ্য করে। মাঝি হয়ে বড় জাতের দিকে হাত বাড়ালে সমাজ তাকে কখনো রেহাই দিবে না। বর্ণপ্রথার যাঁতাকলে সে বলিদান দিয়েছে তার সুখটুকু।
কখনো সে নদীর উজানে বয়ে যাওয়া সমীরণে গান ধরে,
কখনো বা জোর কন্ঠে উচ্চারণ করে,
“ওগো ও স্রোতস্বিনী,
তোমারই মোহনায় দেখিয়াছি প্রেম,
আনিয়াছি কাছে টানি;
টলমল হৃদে জড়াইয়া ধরিয়াছি,
প্রেমের অমর কবিতা খানি।”
*
বিন্তিদের বাড়িতে সাজসাজ রব। রাজ্যের লোক, আত্মীয়স্বজন আনাগোনা করছে বিন্তিদের বাড়িতে। বিন্তির যে বিয়ে ঠিক হয়েছে। কিন্তু যে বয়স গাছেচড়া আর পুতুলখেলার বয়স, সে বয়সে বিয়ের কি বুঝে বিন্তি।
অথচ কাল তার বিয়ে। বিন্তু ছুটে যায় সেই স্রোতস্বিনীর পাড়ে। আবার সে নৌকো ছুটায় ইচ্ছেপূরন দেবতার উদ্দেশ্য। বিয়ে সে করবে না। হয় তাকে মুক্তি দেয়া হোক কিংবা শেকল। মুক্তি চায় বিন্তি। স্বস্তি পায় এই ভেবে যে নিশ্চই স্রোতস্বিনী তার ইচ্ছে পূরণ করবে। নিশ্চিন্ত মনে সে ফিরে যায় ঘরে।
পরদিন ভোরবেলা সে ছুটে আসে স্রোতস্বিনীর ঘাটে।
কিন্তু এ কি!! ঘাট যে শুন্য। তবে কি স্রোতস্বিনী তার ইচ্ছে পূরণ করে নি? স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে সে।
রাত গভীর হয়। মশালের আলোতে ঝলমল করে উঠে বিন্তিদের বাড়ি। ঘরে ভীর করে আছে মেয়েরা। সবাই মিলে আজ বিন্তিকে বধূর বেশে সাজাচ্ছে। অথচ কি অদ্ভুত!
স্রোতস্বিনীর এপাড়ে আলো ঝলমলে ঘরে কাঁদছে বিন্তি আর ওপাড়ে সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে চোখ মুছছে তার ইচ্ছেপূরণের দেবতা।
দেবতা ভাবছে, আজ তার নদীর ওই পাড়ে থাকার কথা ছিল আর বিন্তি ভাবছে,
” আজ বোধহয় স্রোত পশ্চিমদিকে বইছিল,,,//।।”
বাংলাদেশ সময়: ১৩:৩০:৩৪ ৯২৪ বার পঠিত