বঙ্গ-নিউজঃ সারাদেশে ডেঙ্গু অনেকটা মহামারী আকার নিয়েছে। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। আক্রান্তদের অনেকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১ হাজার ৭০৬ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ডেঙ্গু রোগী এক দিন বাড়ছে, আরেক দিন কমলেও প্রকোপ এখনো কমেনি। ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবায় সুস্থ করার চেষ্টা অব্যাহত থাকলেও এডিস মশা নিধন নিয়ে তেমন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে দেশজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
সরকারের রোগ তত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডেঙ্গু খুব দ্রুত বাড়ছে। গত ৫০ বছর ধরে যা প্রায় ৩০ গুণ বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) তথ্যমতে, বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত এলাকায় বাস করছে। এশিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, আমেরিকা, আফ্রিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের প্রায় ১০০টি দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর ৫ থেকে ১০ কোটি লোক এ রোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ৫ লাখ লোক হেমোরেজিক ডেঙ্গুতে ভোগে এবং ২২ হাজার মারা যায়। মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে বেশিরভাগই শিশু।
আশার খবর হচ্ছে এডিস ভাইরাস ছড়ানোর বাহক ইজিপ্টি মশার দেহে ওলবাকিয়া ব্যাক্টেরিয়া ঢুকিয়ে ডেঙ্গু সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব বলে জানিয়েছে সরকারের রোগ তত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। প্রতিষ্ঠান গবেষকরা এটি নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। এ ছাড়া স্টেরাইল ইনসেক্ট টেকনিক (এসটিআই) পদ্ধতিতে পুরুষ এডিস মশাকে গামা রশ্মি প্রয়োগ করে বন্ধ্যত্বকরণের মাধ্যমেও ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির বিশেষজ্ঞরা। আইইডিসিআরের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ডেঙ্গু সংক্রমণে বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে মানুষকে আক্রমণকারী মশাবাহিত ভাইরাস প্রতিরোধে ওলবাকিয়া ব্যাক্টেরিয়া নিয়ে কাজ করছেন। এ ব্যাক্টেরিয়া নিরাপদ। যদি এটি ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তাহলে ওলবাকিয়া মানুষের মাঝে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ লাঘবে সক্ষম হবে। এটি দুভাবে মশার দেহে কাজ করে। প্রথমত ভাইরাসের বিরুদ্ধে মশার শরীরে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়ায়; দ্বিতীয়ত ভাইরাস বৃদ্ধি ব্যাহত করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ওলবাকিয়া ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমিত পুরুষ মশা স্ত্রী মশাতে অপরিস্ফুটনযোগ্য ডিম উৎপাদন করে বলে মশার বংশবৃদ্ধি হ্রাস পায়। আর স্ত্রী মশা সংক্রমিত হলে তার থেকে জন্ম নেওয়া মশাগুলো ওলবাকিয়া ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমিত হয়েই জন্ম নেয়। ফলে ধীরে ধীরে সব মশাতেই ওলবাকিয়া ব্যাক্টেরিয়ায় সংক্রমণ হয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ডেঙ্গু ও অন্য রোগ কমানো সম্ভব।
আইইডিসিআরের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বন্ধ্যা পুরুষ মশাকে কাজে লাগিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করার স্টেরাইল ইনসেক্ট টেকনিক (এসটিআই) পদ্ধতির প্রায়োগিক বিষয় নিয়ে সাভারে পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণা সম্পন্ন করেছেন। এ পদ্ধতিতে পুরুষ এডিস মশাকে গামা রশ্মি প্রয়োগের মাধ্যমে বন্ধ্যা করা হয়। পরে পুরুষ মশাকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব রয়েছে এমন এলাকায় ছেড়ে দেওয়া হয়। এতে পুরুষ মশা স্ত্রী মশার সঙ্গে মিলিত হলে স্ত্রী এডিস যে ডিম বা লার্ভা নির্গত করবে তা থেকে বংশবিস্তার হবে না। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে এটি কার্যকর। পাশাপাশি এটি পরিবেশবান্ধব। এ পদ্ধতির মাধ্যমে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটার কোনো সম্ভাবনা নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরাজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা আমাদের সময়কে বলেছেন, এডিস মশার দেহে ওলবাকিয়া ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণের মাধ্যমে ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব। আমাদের দেশে ওলবাকিয়া ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণ ডেঙ্গু প্রতিরোধ কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গবেষণা সম্পন্ন হওয়ার পর বলা যাবে এটি কার্যকর কিনা। এরপরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রোগ নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ওলবাকিয়া ব্যাক্টেরিয়া এডিস মশার নিয়ন্ত্রণ গবেষণা পর্যায়ে। এটি এই মৌসুমে প্রয়োগ করতে পারবে না। এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এটি দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল পদ্ধতি। বাংলাদেশে এটি কতটা কার্যকর এবং এর পেছনে যে বিশাল অর্থ ব্যয়, তার জোগান দেওয়া সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে চিন্তা করার দরকার কাছে। এরপরই এটি প্রয়োগ করা সম্ভব। তবে বাংলাদেশে যেহেতু ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব রয়েছে, তাই এ পদ্ধতি প্রয়োগের দরকার আছে। তবে এর আগে এখন যে প্রাদুর্ভাব চলছে সেটি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় আগের দিনের তুলনায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হন ১ হাজার ৭০৬ জন মানুষ। আগের দিনের তুলনায় রোগী বেড়েছে ২৪৬ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন ও কন্ট্রোল রুম ঢাকার ১১টি সরকারি ও ৩০টি বেসরকারি হাসপাতালসহ মোট ৪১ প্রতিষ্ঠান থেকে এ তথ্য সংগ্রহ করে। এসব হাসপাতালের বাইরে সারাদেশের ৬৪টি জেলা সিভিল সার্জনদের অফিস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে কন্ট্রোল রুম। কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় (শনিবার সকাল ৮টা থেকে রবিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) সারাদেশে ১ হাজার ৭০৬ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এর মধ্যে রাজধানীর ৭৩৪ জন এবং রাজধানীর বাইরের ৯৭২ জন রয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ৫৩ হাজার ১৮২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৩৮, ফেব্রুয়ারিতে ১৮, মার্চে ১৭, এপ্রিলে ৫৮, মে মাসে ১৯৩, জুনে ১ হাজার ৮৮৪, জুলাইয়ে ১৬ হাজার ২৫৩ এবং আগস্টে ৩৪ হাজার ৭২১ জন। এসব রোগীর ৪৫ হাজার ৯৭৪ জন চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন এবং বাকি ৭ হাজার ১৬৮ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। সরকারি হিসাবে এই পর্যন্ত ৪০ জন মারা গেছেন।
কন্ট্রোল রুমের তথ্যানুযায়ী, রাজধানীর বাইরে ৮টি বিভাগের ৬৪ জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত ৯৭২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ২৫২, চট্টগ্রামে ১৮৮, খুলনায় ১৩৩, রংপুরে ৬৩, রাজশাহীতে ১২০, বরিশাল ১৪০, সিলেটে ১৯ এবং ময়মনসিংহে ৫৭ জন। রাজধানীর বাইরের জেলাগুলোয় এ পর্যন্ত ১৯ হাজার ৪৪৩ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে চিকিৎসা শেষে ১৬ হাজার ৯১৪ জন বাড়ি ফিরেছেন এবং বর্তমানে ৩ হাজার ৫০০ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
এদিকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও চিকিৎসা মনিটরিং সেলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। গতকাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এই বৈঠক হয়। বৈঠকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয় ও জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রচারণা বিষয়ে আলোচনা হয়। সভায় ডেঙ্গু রোগের বিস্তার রোধে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন ও এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। পাশাপাশি এডিস মশার বংশবিস্তার কমাতে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচারণা বৃদ্ধি করার বিষয়েও আলোচনা করা হয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সভাপতিত্বে সভায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও চিকিৎসা মনিটরিং সেলের আহ্বায়ক ও সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক ডা. রোকেয়া সুলতানা, বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়–য়া, স্বাচিপ মহাসচিব ডা. এমএ আজিজ, বিপিএসপিএর মহাসচিব ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরী, অধ্যাপক ডা. এহসানুল কবীর জগলুল, ডা. রউফ সরদার, ডা. কামরুল হাসান মিলন, ডা. পুরবী রানী দেবনাথ, ডা. আবু ইউসুফ ফকির, ডা. মো. জাবেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ১১:১৭:১৪ ৬৩৮ বার পঠিত #এডিস #ডেঙ্গু #মশা