গ্রাম-বাংলার অবারিত প্রান্তর, দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ শস্যক্ষেত, রাখালের সুমিষ্ট বাঁশির সুর, উত্তাল নদীর বুকে ভেসে চলা রং-বেরঙের পাল তোলা নৌকা, প্রকৃতির অসীমতায়, মধুমতি আর বাঘিয়ার নদীর তীরে হাওর-বাঁওড়ের অবারিত প্রাকৃতিক পরিবেশে আমি সদা খুঁজে ফিরি বাঙালির রাখাল রাজা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আমার কাছে বঙ্গবন্ধু মানে একটি মহাকাব্য, একটি স্বাধীনতা, একটি সার্বভৌম বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু মানেই কোনো অপশক্তির কাছে মাথানত না করা। বঙ্গবন্ধু মানেই জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া। বঙ্গবন্ধু মানেই ৭ মার্চের উত্তাল জনসমুদ্র। বঙ্গবন্ধু মানেই একাত্তরে গর্জে ওঠা মুক্তিবাহিনীর হাতিয়ার। বঙ্গবন্ধু মানেই সুদূর টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। বঙ্গবন্ধু মানেই গোপালগঞ্জ, টুঙ্গিপাড়া।
শৈশব থেকেই আমার মনোজগতের পুরোটা জুড়ে ছিল বঙ্গবন্ধুর একচ্ছত্র আধিপত্য। তিনি আমার মননে, চিন্তা-চেতনায় আর অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে রয়েছেন। ক্ষণজন্মা এই মহাপুরুষের জন্ম না হলে বাঙালি জাতিকে হাজার বছরের পরাধীনতার গ্লানি বয়ে বেড়াতে হতো। তিনি ঔপনিবেশিক শাসনামলে জন্মে ছিলেন, তবে পরাজয় মানেননি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি দেশের মানুষের কল্যাণে যুদ্ধ করে গেছেন। শোকাবহ এই আগস্টে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি বিশ্বনন্দিত সেই নেতাকে, যাঁর ডাকে পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনগণ জীবন বাজি রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, প্রতিষ্ঠা করেছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
বাঙালি জাতির হাজার বছরের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে রাতের অজস প্রহর আর দিনের রৌদ্রছায়ার হাজারো ক্ষণ কারাগারে নিঃসঙ্গ সময় পার করতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো, যৌবন ও তারুণ্যের মূল্যবান সময়গুলো তাঁকে কাটাতে হয়েছে কারাবন্দি হিসেবেই। জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়েই তাঁর জীবনে বারবার এই দুঃসহ নিঃসঙ্গ কারাজীবন নেমে আসে। তবে তিনি কখনও আপস করেননি। ফাঁসির দড়িকেও ভয় করেননি।
একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলি হেলনে বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে বাঙালির আবেগ, স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষাকে একসূত্রে গেঁথে তিনি বজ কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই ভাষণটি ছিল দুনিয়া কাঁপানো এক অনন্য শ্রেষ্ঠ ভাষণ। ঐতিহাসিক এই ভাষণটি শুধু বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়কেই নাড়া দেয়নি, এটি সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। গ্রেট ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বলেছেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চির জাগরূক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির অস্তিত্বের স্বপ্নের পুরোধা, প্রবাদ পুরুষ। তিনি বাঙালির স্বপ্নের মানব। তিনি খোকাবাবু থেকে কখনো হয়ে উঠেছেন মহাপুরুষ, কারো কাছে তিনি মহামানব, কেউ ডেকেছেন মহাপ্রাণ নামে, কারো কাছে মনে হয়েছে তিনি কিংবদন্তির জীবন্ত নায়ক, কেউ চিনেছেন তাঁকে দানবীর হিসেবে। সর্বশেষ তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভ‚ষিত হন।
বঙ্গবন্ধুর অসামান্য অবদান কোনো বিনিময় ছাড়াই, সামনে-পিছনে না তাকিয়ে কেবল মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে। বঙ্গবন্ধুর এই অসামান্য হয়ে ওঠার একটা কারণও আছে, তা হলো এই যে, আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষই ভীরু, বীরের সংখ্যা অতি অল্প। তাই যে-কোনো ক্ষেত্রে হোক বীরত্ব যিনি দেখান, সাহস করেন, এগিয়ে যান; তাঁর প্রতি ভেতর থেকেই সকলের শ্রদ্ধা ও ভক্তি জেগে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটেছে। শৈশবকাল থেকে গ্রামের মানুষের দুঃখে তাঁর দুচোখ অশ্রুসজল হতো। অসহায় মানুষের প্রতি তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন পরম মমতায়। ছোটবেলায় গ্রামের গরিব অসহায় পরিবারগুলোকে নিজের বাড়ির ধান দিয়ে, টাকা দিয়ে সাহায্য করতেন। বর্ষাকালে বৃষ্টিতে ভিজে বন্ধুদের স্কুলে আসতে দেখে তিনি নিজের ছাতা দিয়ে দিতেন। বই কেনার অভাবে বন্ধুরা যখন পড়াশোনা করতে পারতেন না, তখন নিজের বাড়ির ধান বিক্রি করে ঐসব বন্ধুকে বই কিনে দিতেন।
বঙ্গবন্ধু তখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র। স্কুলের শিক্ষক বসুরঞ্জন সেনগুপ্তের বাসায় তিনি প্রাইভেট পড়তেন। একদিন সকালে তাঁর বাড়ি থেকে পড়া শেষ করে আসার পথে খালি গায়ে এক বালককে দেখলেন। জিজ্ঞেস করলে ছেলেটি বলল, তার গায়ে দেয়ার মতো কিছু নেই। সঙ্গে সঙ্গে মুজিব গায়ের গেঞ্জি খুলে ওই ছেলেকে দিয়ে দেন। বাড়ি ফিরে আসেন চাদর গায়ে, আদুড় গায়ে। বালকের কষ্ট সেদিন মুজিব সহ্য করতে পারেননি।
ছোটবেলা থেকেই মানুষের দুঃখে তাঁর মন কাঁদত। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবেন, সোনার বাংলা গড়বেন এটাই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এই মৌলিক অধিকারগুলো পূরণের মাধ্যমে মানুষ উন্নত জীবন পাবে, দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্তি পাবে, সেই চিন্তাই ছিল প্রতিনিয়ত তাঁর মনে। যে কারণে তিনি নিজের জীবনের সব সুখ, আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে জনগণের দাবি আদায়ের জন্য এক আদর্শবাদী ও আত্মত্যাগী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি বাঙালি জাতিকে দিয়েছেন স্বাধীনতা, জন্ম দিয়েছেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্র; হয়েছেন জাতির পিতা এবং বিশ্বে বাঙালি জাতিকে বীর হিসেবে দিয়েছেন অনন্য মর্যাদা। তাঁর ব্যক্তিত্বে ছিল চুম্বকের মতো আকর্ষণ যা মানুষকে টেনে আনত এবং ধরে রাখত। নিজের আদর্শ ও উদ্দীপনাকে তিনি অনায়াসে সংক্রমিত করতে পারতেন অন্যদের মধ্যে। তিনি বিশ্ববরেণ্য একমাত্র বাঙালি নেতা যিনি ‘ভয়েস অব বেঙ্গল’ এবং ‘রাজনীতির কবি’ পরিচয়ে ভূষিত।
বাংলার মানুষের মুক্তির এই মহানায়ক স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষে যখন জাতীয় পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন নিশ্চিত করেছিলেন, তখনই ঘাতকের নির্মম বুলেট তাঁকে জনগণের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। স্বাধীন বাংলার মাটি তাঁর রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। বাঙালি জাতির ললাটে চিরদিনের জন্য কলঙ্কের টিকা এঁকে দিয়েছে জান্তব খুনিরা।
জাতির পিতাকে হারিয়ে ৭৫-পরবর্তী দিশেহারা বাঙালি জাতির হাল ধরেছেন বঙ্গবন্ধু-তনয়া শেখ হাসিনা। পিতা-মাতা ও পরিবার-পরিজন হারিয়ে নিঃস্ব গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার অতি সাধারণ মেয়েটি আজ সারা বিশ্বের কাছে হয়ে উঠেছেন অনন্য অসাধারণ। দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র, শত বাধা-বিপত্তি, হত্যার হুমকিসহ নানা প্রতিকুলতা উপেক্ষা করে শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উন্নয়নের অপার বিস্ময়। পিতার মতোই ব্যক্তিগত ঔদার্য, অসীম সাহসিকতা, অবিচল দৃঢ়তা, দেশপ্রেম ও মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন একজন আদর্শবাদী নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। বিচ্যুত হননি কাংখিত লক্ষ্য থেকে। নেতৃত্বের এক অসম সাহসিকতা ও প্রজ্ঞায় তিনি আজ গণমানুষের নেতা। দেশের যে-কোনো সঙ্কটে নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কাছে তিনিই একমাত্র গ্রহণযোগ্য।
বঙ্গবন্ধুর কন্যার হাত ধরে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। অগ্রগতির মহাসড়ক ধরে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে উন্নয়ন। বিশ্বের বুকে বীরদর্পে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এই অবস্থান গণমানুষের মধ্যে একদিকে যেমন নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছে, অন্যদিকে তেমনি বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছে বাঙালির সক্ষমতা। আশার আলো কোথায় নেই? কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, রাজনীতি, নতুন জ্ঞান ও গবেষণা, তথ্য, গণমাধ্যম, মানব সম্পদ সব ক্ষেত্রেই রয়েছে বাংলাদেশের অগ্রগতি। অন্যরকম এই বাংলাদেশের স্বপ্নই দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির পিতার অধরা সেই স্বপ্নই আজ ধরা দিয়েছে তাঁরই সুযোগ্য কন্যার হাত ধরে। শেখ হাসিনার বুদ্ধিদীপ্ত ও দূরদর্শী নেতৃত্বে অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর, ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বারতা আজ চারদিকে। বাংলাদেশের এই অদম্য অগ্রযাত্রা রুখবে এমন সাধ্য কার?
লেখক: সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন
সুত্রঃ মানবকন্ঠ
বাংলাদেশ সময়: ২৩:৩৯:০২ ৯২৯ বার পঠিত #বঙ্গবন্ধু #বাংলাদেশ #বাঙ্গালী #শরীফ এনামুল কবির