বঙ্গ-নিউজঃ দু’দলের শাপমোচনের বিশ্বকাপ জয়ের অগ্নিপরীক্ষায় শরীরের সব শক্তি নিংড়ে দিয়ে, স্নায়ুর সব দুর্বলতা দূরে ঠেলে শেষ পর্যন্ত কি-না লর্ডসের আদিভিটায় সুপার ওভারের মতো আধুনিক ক্রিকেটের ফোরজি ফাইনাল! সুপার ওভারের সুপার ফাইনাল, সেখানেও আবার সেই নাটক ও মহানাটক- শেষ বলে দরকার ২ রানের। ১ রান নিয়ে গাপটিল রানআউট। দু’দলের সমান ১৫ রান হলেও ইংল্যান্ড পুরো ইনিংসে বাউন্ডারি বেশি মারে (২৬-১৭)। আর সেই গণনায় চ্যাম্পিয়ন ব্রিটিশ সিংহরা। এত এত ক্লাইমেক্স আর সাসপেন্সে ভরপুর বিশ্বকাপ ফাইনালে শেষ পর্যন্ত লর্ডসে যা রচিত হলো, তা এককথায় মহাকাব্য। শতবর্ষী ক্রিকেট-ভিটায় আরও একটি ঐতিহাসিক দলিল রচিত হলো।
ক্রিকেটের জন্মভিটায় ভূমিপুত্ররা ৪৪ বছর পর প্রথমবারের মতো শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি পেল। লর্ডসের বারান্দায় ক্রিকেট স্রষ্টা আর সৃষ্টি সরবে চূড়ান্ত মুখোমুখি হলো; আবেগ আর কৃতজ্ঞতার উন্মাদ হাওয়ায় গোটা গ্যালারিতে ভেসে গেল অতীতের সব না পাওয়ার চিহ্ন। অ্যাট লাস্ট ক্রিকেট রিটার্ন হোম- ধারাভাষ্যকারের রুম থেকেই হ্যাশট্যাগ করে নাসের হুসেইন, আথারটনদের টুইট ভেসে এলো। ম্যাচের শেষ বিন্দু পর্যন্ত লড়াই করার জন্য সান্ত্বনা পেল কিউইরা। টানা দুবারের ফাইনাল খেলেও ট্রফিটি তাদের অধরাই থেকে গেল। ম্যাচের পর কথা বলতে পারছিল না তাদের কেউ। জিতেও ভাষা বের হচ্ছিল না বেন স্টোকসদেরও। দেড় মাস ধরে চলা বিশ্বকাপ যুদ্ধের শেষ সেকেন্ড পর্যন্ত চাপ সামলে যেভাবে ফাইনাল জিততে হয়েছে, হাঁফ ছেড়ে দিয়েছিল সবাই… প্রচণ্ড একটা মানসিক ঝড়ের পর যেভাবে চারপাশ নিশ্চুপ হয়ে যায়, কিছুক্ষণের জন্য তেমন পরিবেশ হয়ে গিয়েছিল লর্ডসে। বারান্দায় উঠে ট্রফি নিয়ে উল্লাস করতে করতে কিছুটা সময় লেগেছিল তাদের।
হবে না-ই বা কেন। ইংল্যান্ডের ব্যাটিং ইনিংসে যখন অধিনায়ক ইয়ন মরগান আউট হয়ে যান- তখন চারপাশ থেকে যেভাবে কিউই ফিল্ডাররা ধেয়ে আসছিল, তাতে ঘরের মাঠেও কিছুক্ষণ অসহায় মনে হয়েছিল তাদের। দু’হাত দিয়ে মাটির কাছ থেকে মরগানের ক্যাচ ধরেছিলেন ফার্গুসন। শুরুর দিকে জেসন রয়, জো রুট আর জনি বেয়ারস্টোকে ফিরিয়ে দিয়ে ইংলিশদের মনোবলে প্রথম আঘাত হানে কিউইরা। ৭১ রানে ৩ উইকেট হারানো ইংলিশদের কাছে নিউজিল্যান্ডের দেওয়া ২৪২ অনেক দূরের পথ। তার ওপর আবার শর্ট বলে অস্বস্তিতে থাকা ইংলিশ অধিনায়কের ওই সময় ওভাবে বিদায়। হাল ধরেছিলেন এরপর জস বাটলার আর বেন স্টোকস। দু’জনের জুটি যখন একশ’ পার করে যায়, তখনও ঘুণাক্ষরে টের পাওয়া যায়নি সূর্য ঢেলে পড়ার আগে কী ভাগ্য লিখে যাচ্ছে এখানে। বাটলার ৫৯ রান করে ফার্গুসনের বলে ক্যাচ দেওয়ার পরই শরীরে জ্বর আসার মতো লর্ডসের গা ঘামতে থাকে।
একপাশে তখনও ছিলেন ইংলিশ ক্রিকেটের ‘ব্যাড বয়’ খ্যাত বেন স্টোকস। গেল বছরও তাকে আদালতে দৌড়াতে হয়েছিল। যাক সে কথা। সেই বেন স্টোকসের হাত ধরেই কি-না শেষ পর্যন্ত দশকের পর দশক ধরে চলা প্রতীক্ষার অবসান ঘটেছে ইংল্যান্ডের, তাও এই বেন স্টোকস আবার নিউজিল্যান্ড বংশোদ্ভূত। ওখানেই জন্ম তার, এখানে অকল্যান্ডে তার আত্মীয়রা আছেন। এদিন সেই স্টোকসই কি-না কিউইদের স্বপ্ন ভঙ্গ করেছেন।
বাটলার যখন আউট হয়ে যান, তখন ইংল্যান্ডের দরকার ছিল ৩১ বলে ৪৬ রানের। বোল্ট আর নিশামকে হিসাব করে বাউন্ডারি মেরেছেন তিনি। শেষ বলে সিঙ্গেলস নিয়ে পরের ওভারে স্ট্রাইক নিয়েছেন। এমনকি ৯ বলে যখন ২২ রান দরকার, তখন গিয়ে নিশামকে ছক্কা হাঁকিয়েছেন। শেষ ওভারে ৪ বলে যখন ১৫ রান দরকার, টেনশনে তখন এমসিসির টাই হ্যাট পরা ষাটোর্ধ্বরাও এদিক-ওদিকে ব্যস্ত, সারাদিন ভরে গ্যালারিতে গান বেঁধে গেয়ে যাওয়া সমর্থকরাও মাথায় দু’হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠেছেন। সে সময়ই বোল্টকে ছক্কা হাঁকিয়ে দেন স্টোকস। এদিন গোটা ম্যাচের হারকিউলিকস ছিলেন যেন স্টোকস।
ফাইনালে গুছিয়ে নেমেছিল নিউজিল্যান্ড। তারা জানত, বোলিংই তাদের শক্তি। আগেরবার মেলবোর্নের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৮৩ রানে অলআউট হয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো কিউইরা বুঝেছে, এমন ম্যাচে মাথা গরম করে ব্যাট করা যাবে না। তা ছাড়া সেমিফাইনালে ভারতের বিপক্ষে ২৩৯ রান তুলেই বাজিমাত করা গিয়েছিল। সবকিছু মিলিয়ে এদিন টস জিতে আগে ব্যাট করার অনুমতিই চেয়ে নিয়েছিলেন কিউই অধিনায়ক। দুই আম্পায়ারের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত ছাড়া প্রথম ইনিংসে তেমন কোনো নাটক ছিল না। অফফর্মে থাকা গাপটিল চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ওকসের বলে এলবিডব্লিউ হয়ে যান ১৯ রান করে। তবে ভুলটা করেন তিনি এর পরেই! ফিল্ড আম্পায়ারকে চ্যালেঞ্জ করে রিভিউ নেন। কিন্তু তাতে রক্ষা হয়নি তার উইকেট। উল্টো রিভিউ খুইয়ে বসে নিউজিল্যান্ড। যেটা পরে দামি হয়ে যায় রস টেলরের একটি ভুল আউটের সিদ্ধান্তে। ১৫ রানে থাকা টেলরকে মার্ক উডের বলে এলবিডব্লিউ দেন প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ফাইনালে আম্পায়ারিং করা দক্ষিণ আফ্রিকার মরিস এরাসমোস। রিপ্লেতে ধরা পড়ে, বল ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। আসলে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং বলতে এই বিশ্বকাপে ছিলেন কেন উইলিয়ামসন আর রস টেলর। এ দুই অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানের ওপর রাস্তা বানিয়েই তাদের এই ফাইনালে আসা। কিন্তু এদিন কেন উইলিয়ামসন ৩০ রানের বেশি করতে পারেননি। কিউইদের হয়ে একমাত্র টম লাথামই সবার চেয়ে বেশি ৪৭ রান করেন। কিন্তু যে হার্ডহিটিং ব্যাটিং নিয়ে কিউইদের বিজ্ঞাপন, তা থেকে এদিন সরে এসেছিল তারা। গোটা ইনিংসে মাত্র দুটি ছয়। শেষ পাঁচ ওভারে মাত্র ২১ রান!
১৯৯৬ বিশ্বকাপে শ্রীলংকার বিপক্ষে ঠিক এই ২৪১ রানই করেছিল অস্ট্রেলিয়া। কেউ কেউ তখনই বলছিল, লাহোরের ফলই হবে লন্ডনে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যা হলো, এতটা কেউ ভাবেনি আগে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এমন ফাইনাল কখনও দেখেনি কেউ আগে। ১৯৮৭ বিশ্বকাপে ইডেন গার্ডেনে মাত্র ৭ রানে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। লর্ডসের এই ফাইনাল দেখার আগে লয়েড, গাভাস্কারদের মতো সাবেকরা ওই ফাইনাল নিয়েই গল্প করতেন। ১৯৭৫ বিশ্বকাপে ১৭ রানে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর গল্পও করতেন তারা। কিন্তু এখন থেকে বোধ হয় নতুন করে বলতে হবে- দেখেছিলাম এক ফাইনাল, লর্ডসে। ফোরটিন জুলাই, টু থাউজেন্ড অব নাইনটিনে।
বাংলাদেশ সময়: ৯:৩১:১৭ ৫৪৪ বার পঠিত # #ক্রিকেট #বিশ্বকাপ ট্রফি