বঙ্গ-নিউজঃ সম্প্রতি শাহাজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোড়দার করা হয়েছে। লেবাননসহ কয়েকটি দেশ থেকে আসা প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকরা গত কিছুদিন ধরেই বাড়ি ফেরার পথে ঢাকায় এসে আটকা পড়ছেন বিমানবন্দরে। চলছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা, নানা সংস্থার জিজ্ঞাসাবাদ।
বিভিন্ন দেশ থেকে আসা এসব প্রবাসীদের এলাকার জনপ্রতিনিধিদের সার্টিফিকেট কিংবা ফোনের পর বিমানবন্দর ছাড়ার অনুমতি মিলছে ইমিগ্রেশন বিভাগের কাছ থেকে। এমন খবর প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক সংবাদ সংস্থা বিবিসি।
নিজের দেশে এসে এভাবে দীর্ঘ সময় বিমানবন্দরে আটকে থাকতে হবে বা হেনস্থার শিকার হতে হবে তারা এটি কল্পনাও করেননি বলে জানান প্রবাসীদের কয়েকজন।
লেবানন থেকে বুধবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে প্রায় ৩৫ জনের একটি দলে। তাদের সাথে দেশে ফেরেন ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার জান্নাত বেগম। শ্রমিক হিসেবে গিয়ে দালাল আর প্রতারকের কারণে নিজের পাসপোর্ট আর পাননি সেখানে গিয়ে। দু’বছর ওই অবস্থায় থাকতে পারলেও শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরতে বাধ্যহন তিনি।
এ বিষয়ে জান্নাত বেগম বলেন, ‘কাগজ নিয়া (ট্রাভেল পাস) ফিরছি। কোনো জায়গায় কোনো ঝামেলা হইলো না। বিপদে পড়লাম নিজের দেশে আইসা। পরে আমার ভাই চেয়ারম্যানের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নিয়া ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ছুটায়া আনছে আমারে।‘
তিনি আরো বলেন, ‘এয়ারপোর্টে নামার পরপরই তাদের দলটিকে আটকে দেয় ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তারা। আমরা নাকি রোহিঙ্গা। কত সালে গেছি। কেনো গেছি। এমন সব উল্টাপাল্টা কথা। এতো যন্ত্রণা লেবানন, দুবাই এয়ারপোর্টেও দেয় নাই। রাত তিনটায় নাইমা পরদিন রাত নয়টায় ছাড়া পাইছি।‘
শেষ পর্যন্ত সারাদিন আটকে থাকার পর তার ভাই ও স্বজনরা এলাকার চেয়ারম্যানের সার্টিফিকেট সহ বিভিন্ন কাগজপত্র জমা দিয়ে পরদিন রাত নয়টায় তাকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
ফরিদপুরের নগরকান্দার হাসি বেগম ছয় বছর লেবাননে থাকার পর গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় দেশে ফিরেছেন। লেবাননে বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তা দেশে ফিরে ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে বিপাকে পড়েছেন। শনিবার সকাল নয়টায় প্রায় ৪০ জনের একটি দলের সাথে ঢাকায় নামার পর তাকে বিমানবন্দরে থাকতে হয়েছে রাত প্রায় ১০টা পর্যন্ত।
এ বিষয়ে হাসি বেগম বলেন, ‘এয়ারপোর্টে নামার পর আমাদের দাঁড় করায়া রাখে। এভাবে কয়েক ঘণ্টা দাঁড় করায়া রাখলেও কেউ কিছু বলেনা। কয়েক ঘণ্টা পর এসে জিগায় পাসপোর্ট কই, পরিচয়পত্র কই। এলাকার চেয়ারম্যান কে। তারে ফোন দেন। সে চিনলে ছাড়া পাবেন। এমন সব কথাবার্তা।‘
হাসি বেগম ও জান্নাত বেগমের মতো এমন অনেকে প্রতিদিনই আসেন যাদের কার্যত কোনো পাসপোর্ট নেই। কারণ দালালের মাধ্যমে বিদেশে যাওয়ার পর তাদেরকে দালালরা আর পাসপোর্ট ফেরত দেয়নি। ফলে তারা সেখানে কাজ করতে পেরেছেন কিন্তু একই মালিকের কাজ করতে হয়েছে।
হাসি বেগম আবারো বলেন, ‘এভাবেই বহু বাংলাদেশী কাজ করে সেখানে এবং প্রতিদিন আবার অনেকে ফেরতও আসে। অনেকে যখন মনে করে আর থাকবেনা তখন দূতাবাসে গিয়া বলে আমি দেশে যেতে চাই। তখন একটা জরিমানা দিতে হয় ও পরে দূতাবাস ট্রাভেল পাস দেয় যা দেখিয়ে তারা দেশে ফিরে আসে।‘
তিনি আরো বলেন, ‘তিনি অপারেশনের রোগী। এর মধ্যেও এমন হয়রানিতে পড়তে হয়েছে তাকে, অথচ বৈধ ট্রাভেল পাস নিয়েই তিনি এসেছিলেন।‘
দূতাবাসের সেই ট্রাভেল পাস নিয়ে এসেও গত কিছুদিন ধরে বিমানবন্দরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমনকি কখনো কখনো একদিনও প্রবাসী কর্মীদের বিমানবন্দরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন ব্র্যাক মাইগ্রেশন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান।
এ বিষয়ে শরিফুল হাসান বলেন, সম্প্রতি নিরাপত্তা তল্লাশি বা নিরাপত্তা জোরদারের নামে বিমানবন্দরের ঢুকতেবিদেশগামীদের দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। আর বিদেশ ফেরতদের এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এতে করে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন প্রবাসী নারী কর্মীরা। দীর্ঘ ভ্রমণের পর গোসল খাবার ছাড়া দীর্ঘ সময় অপেক্ষা কঠিন।
তিনি আরো বলেন, ‘গত কয়েকদিনে বহু প্রবাসী পাসপোর্ট বা যথাথয ট্রাভেল পাস নিয়ে এসেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা, এমনকি গোটা একদিনও বিমানবন্দরে অসহনীয় পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন। নানা ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ, খাবার পানির সংকট, ভ্রমণ ক্লান্তি—সব মিলিয়েই একটা বাজে পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে।‘
তিনি আরো বলেন, ‘শ্রমিক হিসেবে কোন জঙ্গিও যেনও না আসতে পারে বা ট্রাভেল পাস পেতে না পারে সেটাও যাচাই হোক, কিন্তু অযথা বিদেশ ফেরতদের হয়রানি বন্ধ হওয়া জরুরি।‘
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনের একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘যারা ফেরত আসছেন তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে একটু বিমানবন্দর থেকে ছাড় দেযার ক্ষেত্রে একটু বিলম্ব হচ্ছে। যেসব দেশ নিয়ে উদ্বেগ আছে সেখান থেকে যারা আসছে আমরা দেখছি তারা আর কোনো দেশে গিয়েছিলো কি-না। এ কারণেই একটু বিলম্ব হচ্ছে।‘
কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগের উপ পুলিশ কমিশনার মহিবুল ইসলাম খান বলছেন, ‘তারা একটি তালিকা ইমিগ্রেশন বিভাগে দিয়েছেন। ফলে তারা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করলেই আমরা জানতে পারবো।‘
যদিও ওই তালিকার অনেকেই সিরিয়া বা ইরাকে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা গেছেন বলে বাংলাদেশের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ধারণা করছেন।
সিরিয়া ফেরত একজন সন্দেহভাজন জঙ্গি সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডেও নিয়েছিলো ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। ওই ব্যক্তি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে প্রবেশের পর জঙ্গি তৎপরতার পরিকল্পনা করছিল বলে জানায় পুলিশ।
এ বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এরকম অন্তত ৫০জন বিভিন্ন দেশ থেকে গিয়ে সিরিয়া আর ইরাকে আইএসের সঙ্গে জড়িত হয়েছিল, যাদের ফরেন টেরোরিস্ট ফাইটার বলে বর্ণনা করছেন কর্মকর্তারা।
ইমিগ্রেশন পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, ‘ উক্ত কারণেই মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ বিশেষ করে সিরিয়ার আশেপাশের দেশগুলো থেকে আসা প্রবাসীদের বিষয়ে এজন্যই বিস্তারিত তথ্য যাচাই করা হচ্ছে।‘
বাংলাদেশ সময়: ১৪:১২:৪৬ ৬১৫ বার পঠিত