জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে- তাহমিনা বেগম

Home Page » সাহিত্য » জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে- তাহমিনা বেগম
বৃহস্পতিবার, ২৩ মে ২০১৯



তাহমিনা বেগম

আবিদ সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে।এটা এখন ওর নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।কে বলবে আজকের এই আবিদ বছর দুয়েক আগেও কুঁড়ের বাদশা ছিল? মা ওকে ঘুম ভাঙানোর জন্য বেড টি এনে
অনেক ডাকাডাকি করলেও ও মোচড় দিয়ে মায়ের দিকে না তাকিয়ে উল্টোদিকে কানে বালিশ চাপা দিত।
মা শেষে বিরক্ত হয়ে ওর চোখেমুখে পানির ছিটা দিয়ে
ঘুম ভাঙাতেন।কারণ ও একটা বড় কোম্পানিতে জব
করছে এসিস্টেন্ট ম্যানেজার হিসেবে বেশিদিন হয়নি।
চাকরীটা যেন ওর নয়।মায়ের যতো মাথাব্যথা।

নতুন চাকরি ।সময়মত না পৌঁছুলে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার
তকমা লেগে যেতে পারে।ওর মাও একটি প্রাইভেট
ব্যাংকে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে চাকরি থেকে
অবসরে গেছেন বেশিদিন হয়নি।আবিদ যখন পঞ্চম
শ্রেণীর ছাত্র ওর বাবা গাড়ী এক্সিডেন্ট করে স্পট ডেথ হন। আবিরের মা এবং তার জীবন যেন থমকে দাঁড়ায়।
যদিও মা চাকরি করতেন তারপরও বেশ মুসড়ে পড়েছিলেন।এই শোক সামাল দিতে সময় লেগেছিল।

নতুন করে ভাবনায় পড়লেন মা।সংসারের যতো ঝক্কি
ঝামেলা সব ওর বাবাই দেখভাল করতেন।সেজন্য বাবার অনুপস্থিতি মা এবং ওকে বড্ড পীড়া দিয়েছিল।
বাবা ছিলেন বি সি এস ক্যাডার।মাত্র ডেপুটি ডাইরেক্টর
পর্যন্ত হয়েছিলেন।এরি মধ্যে গাড়ী এক্সিডেন্ট নিভিয়ে
দিল বাবার জীবন প্রদীপ।আবিরের দাদাবাড়ীতে থাকার মধ্যে ছিল একমাত্র ফুপ্পি।দাদা -দাদী আগেই গত হয়েছেন।এদিকে নানীর বাড়ীতে বিধবা নানী ছাড়া
কেউ ছিল না।আবিরের মা ওর নানা-নানীর একমাত্র
সন্তান।তিনি আবিরদের সাথে থাকেন।আবিরের বাবাই
জোর করে শাশুড়ী মাকে নিয়ে এসেছিলেন।কারণ তিনি
বাবা- মা হারা সন্তান।মা কি জিনিস তিনি সেটা অনুভব
করতেন।

আবিরের বাবার যেহেতু বেশিদিন চাকরীর মেয়াদ ছিল
না তাই অফিস থেকে নাম মাত্র টাকা পেয়েছিলেন।
মা একমাত্র ভরসা।বাবার নিজের পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া একটা দোতলা বাড়ি ছিল শহরে তাই রক্ষা।মা মোটামুটি
ভালোই বেতন পেতেন।তা দিয়ে ভদ্রভাবেই তিনজন প্রাণীর চলে যাচ্ছিল।আবির শহরের নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র।পড়ালেখায় বেশ ভালো।পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে ট্যলেন্টপুলে বৃত্তিসহ এস এস সি ও এইচ
এস সিতে ভালো রেজাল্ট করে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে
ইকোনোমিক্স নিয়ে ভর্তি হয়ে পাশ করে বের হলো।

ভার্সিটিতে যখন তৃতীয় বর্ষ তখন ও প্রমে পড়লো
ওদের ডিপার্টমেন্টের প্রথম বর্ষের ছাত্রী অস্পরার।নামটি যেমন রূপ গুণেও তেমন ছিল অস্পরা।মাকে আবির ওর মনের কথা বলতে মা বললেন ঠিক আছে
ওকে বাসায় নিয়ে এসো একদিন।সত্যি একদিন আবির
অস্পরাকে বাসায় নিয়ে আসলো।কথায় কথায় জানতে
পারলেন ওর বাবা ব্যবসায়ী।ওদের বাসা বারিধারা।ওরা
একবোন,একভাই।ভাই বুয়েট থেকেসিভিলইঞ্জিনিয়ারিং
পাশ করেছে ঠিকই কিন্তু বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করেন।সব শুনে মা শুধু বললেন ওকে তুমি ভেবে দেখ
আমরা সাধারণ মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি।তোমার বাবা ধনী মানুষ।কখনো তিনি আমাদের সাথে আত্মীয়তা করবেন না।

অস্পরা মায়ের কথা শুনে কিছুসময় চুপ থেকে বললো
আন্টি আমি আপনার ছেলেকে অনেক বেশি ভালোবাসি।আমি বাবাকে বুঝাবো।না মেনে নিলে আমি
সোজা আপনার বাসায় চলে আসবো।একথা শুনে মা
বললেন এ কাজটি মোটেও করতে যেওনা।কে শোনে
কার কথা! সে জেদ ধরে বসলো।অগত্যা মা বললেন
আবির পাস করে একটা চাকরি পাক তুমিও পড়তে থাকো।দেখা যাক।এভাবেই আবির আর অস্পরা লেখা
পড়ার পাশাপাশি তাদের অনাগত সুন্দর দিনের অপেক্ষায় স্বপ্নে বিভোর।দিন যায়।বছর যায়।আবির
পাশ করে বের হয়।এবং প্রথমেই একটা মাল্টিন্যাশনাল
কোম্পানিতে এসিসট্যান্ট ম্যানেজারের চাকরিটা পেয়ে
যায়।

এর মধ্যে অস্পরাও ফাইনাল ইয়ারে।আবিরদের বাসায়
নিয়মিত যাতায়াত ছিল ওর এবং আবিরের নানী ও মায়ের সাথে ভালো সখ্যতা গড়ে ওঠে।বাসায় এসে মা-নানীর ওপর সে কি খবরদারি !আহ্লাদি!এটা করোনি ওটা খাওনি।আবার মাঝে মাঝে মাকে না পেলে নানীর হাতের দুলোকমা ভাতমাখা হলেও তার খাওয়া চাইই চাই।বেশ সুন্দর দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল।গণ্ডগোল বাধলো তখন
যখন অস্পরার বাবা ওকে না জানিয়ে ওর বাবার বন্ধুর
ছেলে যে কিনা ব্যবসা করে তার সাথে বিয়ে ঠিক করে
ফেলেছে।অস্পরা বেঁকে বসে।সে আবিরের কথা বলে
বাবাকে।শুনেই তেলেবেগুণে জ্বলে ওঠেন ওর বাবা।বলেন এসব মিডেলক্লাস সেন্টিমেন্ট বাদ দাও।অস্পরার মা ওর বাবাকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন তোমার
একমাত্র মেয়ে যেখানে সুখি হবে তাই করো।বাবা- মাকে
ধমক দিয়ে বললেন একদম চুপ! আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওটাই ফাইনাল।মাকে আর কথা বলার সুযোগ
দিলেন না।

পরিস্থিতি বুঝে অস্পরা এককাপড়ে আবিরদের বাসায়
এসে আবিরের মাকে বলে আন্টি আজই আমাকে তোমার ছেলের সাথে বিয়ে দাও।না হয় বিষ এনে দাও।
মা অনেক বুঝালেন দেখো তোমার বাবা পুলিশ কেস করে আমাদের ফাঁসিয়ে দেবেন।মাথা ঠাণ্ডা কর।এখন
বাসায় যাও।পরে ভেবে চিন্তে একটা উপায় বের করা
যাবে।অস্পরার এক কথা।আমি একেবারে চলে এসেছি
ফিরে যাবো বলে নয়। মা ভীষণ চিন্তায় পড়লেন।কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না।শেষে মা-ছেলে ও নানী সিদ্ধান্ত নিলেন যা হয় হবে।কাজী ডেকে সে রাতেই বিয়ে পড়ানো হলো।অতি সাদামাটাভাবে বিয়েটা হয়ে
গেল।মা তার আদরের বৌমাকে নিজের বিয়ের শাড়ী
গহনা পরিয়ে দিলেন।আনন্দে আটখানা অস্পরা।এদিকে আবিরও আনন্দিত বাট কিছুটা শঙ্কিতও এই
ভেবে অস্পরার বাবা কি করেন খবরটা জানতে পেরে।

বাসর ঘরে দুজনের সেকি আনন্দ।আবির অস্পরার
কপালে আলতো করে ঠোঁট স্পর্শ করে আবেগে জড়িয়ে ধরে বললো আমি তোমাকে হারাতে দেব না।
যে কোনো মূল্যে আজ থেকে আমরা দুজনে একপথের
পথিক।মরলেও একসাথে বাঁচলেও একসাথে।কি আদর
সোহাগে পার করলো সারারাত।এদিকে অস্পরা বাসায়
নেই জেনে ওর বাবা বুঝলো কি ঘটেছে? তিনি আবিরের নামে মামলা করে পুলিশ দিয়ে আবিরকে থানায় নিয়ে গেলেন।কিন্তু অস্পরা ও ওর মা উকিল
নিয়োগ করে আবিরকে হাজতবাস করার আগেই ছাড়িয়ে নিয়ে এলো।মামলা কোর্টে উঠলে বাদী পক্ষের
উকিলের কৌশলগত যৌক্তিক উপস্থাপনের ফলে কেস
ডিসমিস হয়ে যায়।উকিল এককথায় বলে দেন ছেলে
মেয়ে উভয়ে সাবালক এবং স্ব ইচ্ছায় দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন।এখানে কারো অভিযোগ ভিত্তিহীন।সেদিন কি যে খুশি আবিরদের ফ্যামেলীতে!

এদিকে অস্পরার বাবা এ বিয়েকে স্বীকৃতি তো দেনইনি
উল্টো একমাত্র মেয়েকে ত্যাগ করলেন।এভাবেই চলছিল আবির অস্পরার সংসার মায়ের আদর স্নেহে।
এদিকে মায়ের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে এলো এবং
ওদের বিয়ের একবছরের মাথায় মা অবসরে যান।
মা একটা নতুন মুখের জন্য আবির -অস্পরাকে তাড়া
দিতে থাকলেন।অস্পরা সবে দুমাস হয় কন্সেফ করেছে।মুখে রুচি নেই।খেলেই বমি হয়।আবিরের মায়ের খুশি দেখে কে? কদিন পর ঘর আলো করে নতুন
অতিথি আসছে।ডাক্তারের পরামর্শ বমি বন্ধ না হওয়া
পর্যন্ত অস্পরার বিছানা থেকে ওঠা বারণ।শুধুমাত্র
গোসল আর ওয়াশরুমের সময় ছাড়া।

দেখতে দেখতে চারমাস পেরিয়ে গেল।আবির আর মার
অতিরিক্ত সাবধানতায় খুব রাগ করে মাঝে মাঝে অস্পরা।মরে যাবার ভয় দেখায়।আবির অস্পরার মুখ
চেপে ধরে ঝরঝরিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দেয়।অস্পরা
হেসে কুটি কুটি হয়।বলে আমাকে হারানোর এতো ভয়
কেন কর! আমি তো দুষ্টুমি করি।তোমাদের এতো ভালোবাসা ছেড়ে আমি কোত্থাও যাব না গো দেখে নিও।অস্পরার হঠাৎ হঠাৎ মাথায় যন্ত্রণা হয়।বমি করে।
চোখে ঝাঁপসা দেখে।ওর নিয়মিত চেকআপ যে ডাক্তার
করেন তিনি পরামর্শ দিলেন ওকে একজন নিউরোলজিস্টকে দেখানোর।যথাসময়ে স্কয়ার হাসপাতালের একজন নিউরোলজিস্টকে দেখানো হয়।
ডাক্তার অনেক পরীক্ষা করতে দিলেন।রিপোর্টে ওর ব্রেন টিউমার ধরা পড়লো।আবির উদভ্রান্ত।অস্পরাকে
কিছু জানতে দেয় না।অস্পরা তার অনাগত সন্তান পৃথিবীতে আসবে সেই সুখে বিভোর।

অাবীরের মা সারারাত দিন আল্লাহকে ডাকেন।পানা চান অস্পরার রোগমুক্তির জন্য।এদিকে আবির ডাক্তার কে বলেন কি করলে তার প্রিয়তম স্ত্রী ও সন্তানকে রক্ষা
করা যাবে?ডাক্তার বলেন এই অবস্থায় কিছুই করা যাবে না।কারণ অস্পরা এখন সাতমাসের গর্ভবতী।তাছাড়া অপারেশন কতোটা সাকসেসফুল হবে সেটাও
অনিশ্চিত।আবির দিশেহারা।কি করবে সে এখন?

আবির সারারাত নীরবে কাঁদে।ভোরের দিকে নিজের অজান্তে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে।ঘন্টাখানেকের মধ্যেই দুঃস্বপ্ন দেখে আঁতকে ওঠে এবং ঘুম ভেঙ্গে যায়।অস্পরা নিশ্চিন্তে ঘুমায় আর স্বপ্ন দেখে তার অনাগত সন্তান কখন পৃথিবীতে আসবে?আবির জানে না আর কতোদিন এভাবে জীবন মৃত্যুর মুখোমুখি লড়াই করে
যেতে হবে? একমাত্র ওপরওয়ালা জানেন!

বাংলাদেশ সময়: ০:২২:২৪   ৭৬৮ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

সাহিত্য’র আরও খবর


সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন: স্বপন চক্রবর্তী
ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা “আমি তো গাঁয়ের মেয়ে ”
৫০ বছরের গৌরব নিয়ে জাবির বাংলা বিভাগ বিশাল ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ উৎসব আয়োজন করেছে
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা- ‘তোমার খোঁজে ‘
অতুলপ্রসাদ সেন: ৩য় (শেষ ) পর্ব-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন;পর্ব ২-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন-স্বপন চক্রবর্তী
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা ” যাবে দাদু ভাই ?”
বাদল দিনে- হাসান মিয়া
ইমাম শিকদারের কবিতা ‘ছোট্ট শিশু’

আর্কাইভ