আম্র পালী আমের নাম করণের ইতিহাস (শুরু থেকে ১১ টি পর্ব একত্রে):জালাল উদদীন মাহমুদ

Home Page » বিনোদন » আম্র পালী আমের নাম করণের ইতিহাস (শুরু থেকে ১১ টি পর্ব একত্রে):জালাল উদদীন মাহমুদ
সোমবার, ২২ এপ্রিল ২০১৯



 জালাল উদদীন মাহমুদ   আম্র পালী আমের নাম করণের ইতিহাস –এ পর্যর্ন্ত সূচনা ছাড়াও ১১ পর্বে প্রকাশিত হয়েছে। পর্বগুলি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হলেও অনিয়মিত ছিল। তাই অনেকের পক্ষেই হয়তো সবগুলি পর্ব পড়া সম্ভব হয় নাই।কেউ কেউ কিছু পর্ব মিস করায় ”আম্র-পালী ” সংক্রান্ত সব পর্ব একত্রে দিতে অনুরোধ এসেছে। নীচে সূচনা সহ ১১টি পর্ব একত্রে দিলাম। পাঠকদের জন্য এগুলো একত্র করেছেন ” কৃষিবিদ নূর-এ-আল মুক্তাদির তানিন”।

একটি নতুন জাতের আম যা যশোর, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, নড়াইল, মাগুরাওপার্বত্য এলাকায় বেশী উৎপাদিত হয় , তার নাম কি ? তার নাম আম্র-পালী ।
আম্র পালী - আমের সাথে জড়িত আছে এক অপরুপা সুন্দরী মহিলার নাম। তিনি এখন থেকে ২৫০০ বছর আগে জন্মেছিলেন । ২৫০০ বছর আগে ভারতের এক শ্রেষ্ঠ নর্তকীর নাম ছিল আম্র পালী। তার রূপে আগুন জ্বলতো | সেই আগুনে ঝাঁপ দিতে চায় সবাই |

ঘন আমবনে গাছের নিচে এক পরিত্যক্ত কন্যাশিশুকে খুঁজে পেয়েছিল এক নিঃসন্তান বিত্তহীন দম্পতি | তারা তার নাম রাখেন আম্রপালী।আমগাছের নিচে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন বলে এই নামই রাখা হয়েছিল | সংস্কৃতে আম্র মানে আম এবং পল্লব হল পাতা | অর্থাত্ আমগাছের নবীন পাতা | সেই বালিকা কৈশোরে পা দিতে না দিতেই নিদারুণ সমস্যায় পড়লেন তার বাবা মা | সমস্যার কারণ মেয়ের রূপ । আম্রপালী কে নিয়ে রিতীমত যুদ্ধ বেধে যায়| খ্রিস্টের জন্মের ৫০০-৬০০ বছর আগে | ভারতবর্ষের বৈশালী রাজ্যে (বর্তমান বিহার রাজ্য)| গ্রামের মহাজন, শহরের বণিক, জনপদের রাজা সবাই তাকে পেতে চায় ? সাধারণ মানুষ তাকে এক নজর দেখার জন্য অস্থির । কি হবে আম্র পালীর ?

আম্র পালীর রুপে-গুণের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে তাকে বিবাহ করার জন্য বহু রাজপুত্র উদগ্রীব হয়ে উঠলেন,ক্রমে তাঁরা পরস্পরের মধ্যে কলহে প্রবৃত্ত হতে লাগলেন। তা দেখে আম্র পালীর পিতা চিন্তিত হয়ে পড় লেন ,কারণ কণ্যার পাণিপ্রাথীদের মধ্যে যাঁকেই তিনি বিমুখ করবেন তিনিই হয়ে উঠবেন তার ঘোরতর শক্র। উপায়ান্তর না দেখে তখন আম্র পালীর পিতা শহরের গণ্য-মান্য ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শের জন্য এক সভা আহ্বান করলেন। সেই সভায় আম্রপালীর বিবাহ প্রসঙ্গ উপস্থাপন করা হলে সভাস্থ ব্যক্তিবর্গ আম্রপালীকে সভায় উপস্থিত করানোর জন্য আম্র পালীর পিতাকে অনুরোধ জানালেন। পিতার আদেশে কন্যা আম্রপালী সভায় উপস্থিত হয়ে-সমাজপতিদের চাপে যে সিদ্ধান্ত নিল তা জানাব কিনা ভাবছি। বিষয়াবলী অশ্লীল মনে হতে পারে। তবে সব কিছু বিবেচনা করতে হবে সে সময়ের প্রেক্ষাপটে।

আম্রপালী বাস করতেন বৈশালী শহরে । বৈশালী ছিল প্রাচীন ভারতের একটি শহর। এটি বর্তমানে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের বিহার রাজ্যের অন্তর্গত একটি প্রত্নক্ষেত্র । গৌতম বুদ্ধ একাধিকবার বৈশালীতে এসেছিলেন। তাঁর সমসাময়িক কালে বৈশালী ছিল একটি সমৃদ্ধ ও বর্ধিষ্ণু শহর। চীনা পর্যটক ফাহিয়েন (খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতাব্দী) ও হিউয়েন সাংয়ের ভ্রমণবিবরণীতে বৈশালী শহরের কথা উল্লিখিত হয়েছে।

বৈশালীতে তৎকালীন প্রচলিত নিয়মানুসারে সর্বাঙ্গসুন্দরী রমণী বিবাহ করতে পারতেন না তিনি হতেন গণভোগ্যা। অতএব সর্বাঙ্গসুন্দরী রমণীরুপে স্বীকৃতা আম্রপালীকেও এই প্রচলিত নিয়ম শৃঙ্খলে আবদ্ধা হতে হবে। সমাজপতিরা বিধান দেয়, আম্রপালী কোনওদিন বিয়ে করতে পারবেন না | কারণ এত রূপ যৌবন নিয়ে তিনি কোনও একমাত্র পুরুষের ভোগ্যা হতে পারেন না |

সেদিনের সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হল, আম্রপালী হবেন বৈশালীর নগরবধূ ( অনেকে বলেন নগরবধূর ইংরেজী courtesan. courtesan মানে a woman, usually with a high social position, who in the past had sexual relationships with rich or important men in exchange for money. | অর্থাত্ বহু পুরুষের ভোগ্যা ) | বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থে তাঁকে জনপদকল্যাণী বলেও উল্লেখ করা হয়েছে | এই জনপদকল্যাণী বা নগরবধূ কিন্তু সামান্য গণিকা বা দেহপসারিণী নন | তিনি হবেন নৃত্যগীতে পারদর্শী, অভিজাত আদবকায়দায় রপ্ত এক সুন্দরী | উচ্চবংশের পুরুষই পেতে পারবেন তাঁর সঙ্গসুখ | জনপদকল্যাণী নিজেই নিজের সঙ্গী নির্বাচন করতে পারবেন | কিন্তু বিয়ে কোনওদিনও নয় | তাঁকে লক্ষ্য করে সে আমলে বৈশালীতে নতুন আইন তৈরি হয়ে গেল, অনিন্দ্য সুন্দরী নারী কখনও পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হতে পারবেন না। জনসাধরণের আনন্দের জন্য তাঁকে উৎসর্গ করা হবে।

এইসব সিদ্ধান্ত সেদিনের সভায় গৃহীত হলে আম্রপালীর পিতা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও বিচলিত হয়ে পড়লেন,কিন্ত সভায় গৃহীত এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো রকম প্রতিবাদ করতেও সাহসী হলেন না। স্নেহময় পিতার মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে আম্রপালী তখন কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে সভায় এই সিদ্ধান্ত স্বেচ্ছায় শিরোধার্য করে নিলেন। আম্রপালীর উক্ত শর্তগুলি ভীষণ অশ্লীল মনে হবে। সে গুলি জানাব কিনা বুঝতে পারছি না।
বিচারকেরা রায় দিলেন, ‘আম্র-পালীকে নিয়ে লড়াইয়ের দরকার নাই। ও সকলের হবে । রাস্ট্রের নির্দেশে দেহ ব্যবসার ঘটনা পৃথিবীতে এই একটিই।
আম্র-পালী তখন কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে তাকে বহুভোগ্যা নগরনটী করার সিদ্ধান্ত স্বেচ্ছায় শিরোধার্য করে নিলেন।

আম্রপালীর শর্তগুলি ছিল নিম্নরূপঃ

(ক) নগরের সবচেয়ে মনোরম স্থানে তাঁর গৃহ নির্মিত হবে।
(খ) একবারে মাত্র একজন তাঁর গৃহে প্রবেশাধিকার পাবেন।
(গ) তাঁর দর্শণী হবে প্রতি রাত্রির জন্য পাঁচশত স্বর্ণমুদ্রা
(ঘ ) শক্র বা কোনো অপরাধীর সন্ধানে সপ্তাহ অন্তে মাত্র এক দিন তাঁর গৃহে অনুসন্ধান করা যাবে।
(ঙ) তাঁর গৃহে আগত ব্যক্তিগণের সম্বন্ধে কোনো অনুসন্ধান করা চলবে না।
আম্রপালীর উক্ত পাঁচটি শর্তই উক্ত বিচারকদের সভা কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছিল।

এরপর বারবিলাসিনীরূপে আম্রপালীর জীবনের নতুন অধ্যায় আরম্ভ হল। কালক্রমে তিনি প্রচুর অর্থ-সম্পদের অধিকারিণী হলেন। রাজাদের থেকে কম ছিল না আম্র-পালীর সম্পদ | জনপদকল্যাণী হওয়ার সুবাদে তিনি ছিলেন বৈশালীর রাজনর্তকী | সুবিশাল উদ্যান, মর্মর অট্টালিকা ছিল তাঁর সেবায় নির্মিত ।

আম্রপালী বিভিন্ন স্থান থেকে দক্ষ চিত্রশিল্পীদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন এবং তাঁদের দ্বারা তখনকার রাজা,মন্ত্রী, সম্ভ্রান্ত নাগরিক এবং ধনাঢ্য ব্যাক্তিগণের প্রতিকৃতি নিজ গৃহের প্রাচীরে অম্কিত করিয়েছিলেন।এই সকল প্রতিকৃতির মধ্যে মগধরাজ (বর্তমানে ভারতের বিহার) বিম্বিসারের(৫৫৮ খ্রিঃপূঃ – ৪৯১ খ্রিঃপূঃ) প্রতিকৃতি দেখে আম্রপালী মোহিত হন এবং মগধরাজের সহিত মিলনের জন্য অধীর হয়ে ওঠেন। অপরপক্ষে মগধরাজ বিম্বিসারও আম্রপালীর অপ্সরীতুল্য রূপের খ্যাতি শুনে তাঁকে দেখার জন্য অত্যন্ত আগ্রহী হন।
আম্রপালীর রূপের আগুনে ঝাঁপ দিতে চাইলেন মগধরাজ বিম্বিসার । রাজা বিম্বসার ছিলেন মগধের (বিহারের) প্রথম ঐতিহাসিক রাজা।
কবি জীবনানন্দ দাসের ”বনলতা সেন ” -কবিতাটির প্রথম স্তবকের তৃতীয় লাইনে কিন্তু এই বিম্বিসার –এর নাম লেখা আছে।

“বনলতা সেন’ কবিতাটি সম্ভবত বিংশ শতাব্দীর সর্বাধিক পঠিত বাংলা কবিতাগুলোর একটি।
”বনলতা সেন ” -কবিতাটির প্রথম স্তবকে যে বিম্বিসার –এর নাম লেখা আছে সেই রাজা বিম্বিসার – এর সাথে কিন্তু আম্র পালীর প্রেম হয়েছিল।তবে বিম্বিসার-এর বিবাহ-প্রস্তাব হেলায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন আম্রপালী | বিম্বিসার-এর পুত্র অজাতশত্রও আম্রপালীর রুপে মুগ্ধ হয়েছিল। সে কাহিনী পরে বলা হবে।
‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি;
বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি;
আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক,
চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
ব্যাখ্যাঃ-কবিতাটির প্রথম স্তবকে কবি হাজার বছর ব্যাপী ক্লান্তিকর এক ভ্রমণের কথা বলেছেন । তিনি হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে ফিরেছেন;- যার যাত্রাপথ সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। তার উপস্থিতি ছিল বিম্বিসার ও অশোকের জগতে যার স্মৃতি আজ পুরাতন তাই ধূসর। আরো দূরবর্তী বিদর্ভ নগরেও স্বীয় উপস্থিতির কথা জানাচ্ছেন কবি। এই পরিব্যাপ্ত ভ্রমণ তাকে দিয়েছে অপরিসীম ক্লান্তি। এই ক্লান্তিময় অস্তিত্বের মধ্যে অল্প সময়ের জন্য শান্তির ঝলক নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল এক জন রমণী। কবি বলেছেন তিনি নাটোরের বনলতা সেন।
প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের শুরু খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে। এর আগেও যে প্রাচীন ভারতে রাজনৈতিক ইতিহাস ছিল না তা নয়, তবে সেই ইতিহাস আজও তেমন স্পষ্ট নয়।

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের দিকে প্রাচীন ভারতে ষোলোটি স্থানীয় রাজ্য গড়ে উঠেছিল । প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থসমূহ ও প্রাচীন জৈন গ্রন্থ সমূহে এ ১৬ টি রাজ্যের উল্লেখ আছে। এই ১৬ টি রাজ্যের মধ্যে মগধ ছিল অন্যতম। এই মগধের (বর্তমানে ভারতের বিহার) রাজা ছিলেন বিম্বিসার । বিম্বিসার মাত্র পনেরো বছর বয়সে মগধের রাজা রূপে অভিষিক্ত হনেএবং ৫৪২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪৯২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত মগধ শাসন করেন।
অন্যদিকে এই ১৬টি রাজ্যের মধ্যে অন্যতম ছিল বজ্জি রাজ্য। এই রাজ্যের রাজধানী ছিল বৈশালি। এই বৈশালিতেই বাস করতো সুন্দরী আম্র-পালি। আম্র-পালির রাজ্যের রাজার সাথে বিম্বিসারের ভীষন শত্রতা ছিল।
তাহলে তারা কিভাবে একে অপরের কথা জানতে পারলো ?
কিভাবে তাদের দেখা হলো?
কিভাবে বা প্রেমই হলো ?
সে এক বিশাল কাহিনী । এ বিশাল কাহিনী শোনার ধৈর্য্য কি সবার হবে ?
প্রাচীন ভারতের মগধ রাজ্যের রাজা ছিলেন বিম্বিসার । তিনি রাজ্য বিস্তার করে সাম্রাজ্য গঠনের উদ্দেশ্যে বহু বিবাহ করেছিলেন । স্ত্রীর সংখ্যাটা শুনে যেন কেউ ভয় না পায় । তার স্ত্রীর সংখ্যা ১০০ নয়, ২০০ নয়- , ৩০০ নয় , ৪০০ নয় , ৪৫০ও নয় ৪৯৯ও নয় । তার চেয়েও বেশী । সংখ্যাটা একটু পরে জানাব।
না , সংখ্যাটা এখনই জানাই । তার স্ত্রীর সংখ্যা ছিল ৫০০ ! হ্যাঁ, পাঁচশ ।
উপরের অংশটি পড়লে সবারই বিম্বিসারের চরিত্র সম্পর্কে একটা ধারনা সৃষ্টি হবে । মনে হবে, লোকটি কেবল তার নিজের কামনা-বাসনাকে চরিতার্থ করেছেন। তার জীবনে কি প্রেম-ভালবাসা ছিল ? এত স্ত্রী থাকতে তাঁর জীবনে প্রেম –ভালবাসা আসার কোনও প্রয়োজনই নাই । তার পক্ষে ভালবাসা প্রেম কি- এসব বোঝাও সম্ভব নয় ।
অথচ বিম্বিসারের জীবনে প্রেম এসেছিল । তিনি এক সুন্দরী নর্তকী এর প্রেমে পড়েছিলেন । সেই সুন্দরী নর্তকীই হলো আমাদের আলোচ্য আম্র-পালী। আম্র-পালীর জীবনে তো নিত্য নতুন পুরুষের আনাগোনা । তার জীবনেই বা আ্বার প্রেম কেন ? এ সব প্রশ্নের জবাব মিলবে আগামীতে। কাহিনীটি ‘গল্প’ আকারে বলার চেষ্টা করবো।
শুনবেন তো ?

সম্রাট বিম্বিসারকে রাজ্য রক্ষা বা রাজ্যবিস্তারের প্রয়োজনে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছিল। এমনি এক যুদ্ধে তিনি জয়লাভ করেছে প্রাসাদে ফিরলেন। রাতে প্রাসাদের নাচ-গানের আসর জলসা শুরু হলো। আগে থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সুন্দরী সুন্দরী রাজ-নর্তকীদের হাজির করা হয়েছে । চারদিকে আনন্দ- উল্লাস , চারদিকে বাদ্য-বাজনা , চারদিকে নাচ- গান । রাজা বিম্বিসার তার মন্ত্রী ও সভাসদদের নিয়ে তাদের নৃত্যগীত উপভোগ করছেন ।
একজন নর্তকীর নাচে মুগ্ধ হয়ে তিনি তার পাশে বসা মন্ত্রী গোপাল কে বললেন – এ নর্তকী সারা পৃথিবীর মধ্যে সেরা।
গোপাল মৃদুস্বরে বলে উঠলো, ‘মহারাজ ! এইমাত্র যে নাচ আপনি দেখলেন তা বৈশালীর রাজনর্তকী আম্র-পালীর নখেরও যোগ্য না ।
মহারাজ গোপালকে খুব বিশ্বাস করতেন। তাছাড়া গোপাল বৈশালীরই এক রাজার পুত্র ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি নিজ রাজ্য ত্যাগ করে রাজা বিম্বিসারের দরবারে আসলে বিম্বিসার তাঁকে মন্ত্রীত্ব প্রদান করেন । তাঁর মেধা ও সততায় রাজা বিম্বিসার বরাবরই মুগ্ধ ছিলেন । গোপালকে অবিশ্বাস করার কোন কারনই ছিল না । রাজা অবশ্য সেদিন বৈশালীর রাজনর্তকী আম্র-পালী সম্পর্কে মন্ত্রী গোপালকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না। কিন্তু আম্র-পালীর চিন্তা মন থেকে মুছে ফেলতেও পারলেন না। কয়েকদিন পরের ঘটনা। মহারাজ বিম্বিসার গোপালের কাছে আম্র-পালীর কথাটা তুললেন‘গোপাল !
আমি ভাবছি সামনের কোন এক উৎসবে তোমাদের বৈশালীর সেই রাজনর্তকীকে নিয়ে আসবো ।’
‘তাতো কোন ভাবেই সম্ভব নয় মহারাজ ।’
‘কেন সম্ভব নয় ?’
‘বৈশালী ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়া আম্রপালীর জন্য ,শুধু নিষেধই নয় একধরনের অপরাধ ।’
আমি প্রয়োজনে বৈশালীরাজকে বলবো। ‘সম্রাট বিম্বিসার স্বয়ং বৈশালীরাজকে বললেও অসম্ভব ?’ কেন ?
“মহারাজ ! এই নারীর জন্য বহু রক্তপাত হয়েছে । বহু রাজা, রাজপুত্র বণিক , ধনাঢ্য ব্যাক্তি কেবল এক নজর চোখের দেখার জন্য তার বাড়ির সামনে দিনের পর দিন তাঁবু খাটিয়ে অপেক্ষা করে । যতক্ষণ পর্যন্ত আম্র-পালীর আগ্রহ না জন্মে, কেউ তার বাড়িতে ঢুকবার অনুমতি পর্যন্ত পায় না …’তাছাড় ?
-তাছাড়া আবার কি মন্ত্রী ?
-বৈশালীরাজ তো আমাদের শত্রু , আপনাকে সেখানে ঢুকতে হলে যুদ্ধে জয়লাভ করেই ঢুকতে হবে।
রাজা চিন্তিত মুখ করে বললেন, ‘কি যেন নাম বলেছিলে এই নারীর ?’
‘এই নারীর নাম আম্রপালী ,মহারাজ।’
‘এমন অদ্ভুত নাম আগে কখনও শুনেছি বলে তো মনে পড়ে না। আমি আম্রপালীর সম্পর্কে সবকিছু জানতে আগ্রহী । তারপর সিদ্ধান্ত নিব। গোপাল তুমি এর সব বৃত্তান্ত আমাকে শোনাও !’
গোপাল বেশ কিছুক্ষণ ভেবে নিলেন। তারপর আম্রপালীর গল্প শুরু করলেন । প্রথমে তার অতীত জীবন বললেন।
আম্রপালীর সে অতীত জীবনের গল্প সবাইকে তো জানায়েছি । আর জানানোর দরকার আছে কি? আমি সরাসরি তাদের “প্রেম-কাহিনী” তে যেতে চাই । তবে পাঠকদের মতামত চাই - মন্ত্রীর বলা আম্র-পালীর সে “অতীত –কাহিনী” শুরু করবো নাকি সরাসরি আম্র-পালী ও বিসিম্বারের “প্রেম-কাহিনী” তে চলে যাব?
মন্ত্রী গোপাল রাজা বিম্বিসারকে আম্রপালীর সে অতীত জীবনের গল্প একে একে শোনানো শুরু করেন।
কাহিনীর প্রয়োজনে প্রসঙ্গক্রমে সে গল্প আবার পাঠকদের আমাকে বলতে হচ্ছে। তবে সবার আগে বলি আম্রপালীর রাজ্য বৈশালী পৃথিবীতে জন্ম নেয়া প্রথম প্রজাতন্ত্র তথা গণতান্ত্রিক রাস্ট্রগুলির একটি। বৈশালী প্রজাতন্ত্র -এ অধিকাংশের ভোটে রাজ্যের সমস্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের পূর্ব পর্যন্ত এসব প্রজাতন্ত্র এর অস্তিত্ব ছিল।
এই বৈশালীর ”শ্রাবস্তী” নামক শহরে মহানমা নামে সামন্ততান্ত্রিক সমাজের একজন বসবাস করতেন । (আশাকরি পাঠকগণ শ্রাবস্তী- নামের সাথে পরিচিত আছেন) ঐ যে কবি জীবনানন্দ দাশ এর বনলতাসেন কবিতার একটি লাইন, ‘মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য’ । প্রাচীন সুন্দর শহর বলেই বোধ হয় কবি বনলতার সাথে প্রাচীন শ্রাবস্তী নামক শহরের তুলনা করেছিলেন। মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য,কথাটির অর্থ তারও মুখ জুড়ে সুদূর অতীতের অন্ধকার ঐশ্বর্য।
আজ থেকে প্রায় ৮৫ বছর আগে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ কবিতা ‘বনলতা সেন’। কে ছিলেন এই বনলতা সেন? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়া যায়নি। এই কবিতাটি লিখে সে সময়ে জীবনানন্দ দাশ ব্যাপক হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন।
যা হোক ,কবিতার সে লাইন গুলি আবার দেখুন।
”চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।”)
শ্রাবস্তী বর্তমানে গঙ্গার নিকটবর্তী নেপাল- উত্তর প্রদেশ সীমান্তের কাছকাছি একটি জেলা। গৌতম বুদ্ধ শ্রাবস্তী এসেছিলেন। ধ্যান করেছিলেন, দান করেছিলেন এবং এভাবে শ্রাবস্তী নগরীকে তিনি অমর করে রেখেছেন। শ্রাবস্তীর রাজকুমার জেত অসম্ভব ধনাঢ্য ছিলেন; তিনি বুদ্ধকে আঠারো কোটি স্বর্ণ মুদ্রা দান করেছিলেন।
যা হোক , মন্ত্রী আম্রপালীর সে অতীত জীবনের গল্প একে একে রাজাকে শোনানো শুরু করলেন।
বৈশালী রাজ্যের এই শ্রাবস্তী নামক স্থানে মহানামা নামের যিনি বসবাস করতেন তিনি একদিন এক কন্যা শিশুসন্তানকে ক্রন্দনরত অবস্থায় একটি আমগাছের নীচে পড়ে থাকতে দেখেন । মহানামা তাকে কুড়িয়ে পেয়ে নিজের বাসায় নিযে যান। স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে এ নিঃসন্তান দম্পতী তাকে নিজের সন্তান হিসেবে লালন-পালন করবার সিদ্ধান্ত নেন । তার নাম রাখা হয় ‘আম্রপালী’ । আম্রবাগনে কুঁড়িয়ে পাওয়াতেই এই নাম ।
যত বয়স বাড়তে লাগলো আম্রপালী তত বেশী রূপবতী হয়ে উঠতে লাগলো । আম্রপালীর বয়স যখন এগারো /বার বছর, মহানমা তখন আম্রপালীর বিয়ের জন্য পাত্রের সন্ধান শুরু করেন। আম্রপালীকে বিবাহ করার জন্য জনপদের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মধ্যে কোন্দল বেঁধে গেল । আশে-পাশের বহু দেশের রাজা , রাজপুত্র, মন্ত্রীপুত্র, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, কাফেলার দলপতি , শহরের বণিক, গ্রামের মহাজন,আম্রপালিকে বিয়ে করতে চাইলেন । সাধারণ মানুষ তো একবার তার দর্শন পেলেই কৃতার্থ হয়ে যায় | আম্রপালীর রূপে সবাই এতটাই মুগ্ধ যে একে অন্যের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করে হলেও প্রত্যেকেই আম্রপালীকে নিজের করে নিতে রাজী ছিলেন ।
আম্রপালীকে নিয়ে এই বিতর্ক বৈশালী প্রজাতন্ত্রের হর্তাকর্তা গণের কানে গিয়ে পৌঁছুলে তারা তাদের এ বিষয়টিকে নিয়ে বিধানসভাতেই আলোচনা শুরু করেন । পিতা সহ আম্রপালীকে সভায় ডাকা হয় । এতোদিন তারা আম্রপালীর অসামান্য যে রূপের কথা কেবল লোকমুখে শুনে এসেছেন তা এই প্রথম তারা সামনাসামনি প্রত্যক্ষ করলেন । সবাই মুগ্ধ । স্বর্গের অপ্সরাও বুঝি আম্রপালীর তুলনায় নগন্য । সবাই উত্তেজিত হয়ে মত দিল আম্রপালী কারো একার হতে পারেনা। তার ঐশ্বরিক সৌন্দর্য উপভোগের অধিকার সবার । চাঁদ কারও একার হতে পারে না । তাই আম্রপালীকে একজন পুরুষের সঙ্গে বিবাহের অধিকার দেয়া ধর্মসম্মত নয়। একে প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক পুরুষের স্ত্রী হিসেবে মনোনীত করে ‘নগরবধূ’ করে রাখা হোক ।’
সে যুগে রূপবতীর সতীত্বের মূল্য সমাজপতিদের কাছে ছিল না । আম্রপালী আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ।আম্রপালীর পালক পিতা মহানমা আম্রপালীর মনের কথা বুঝলেন । তিনি আম্রপালীর মাথায় স্নেহ মাখা হাত রেখে বললেন, ‘মাগো ! তুমি হয়তো আজ আত্মহত্যা করে মুক্তি পেয়ে যাবে । কিন্তু আমি আর তোমার মা রাজদন্ড মতে শূলবিদ্ধ হবো । এমন শাস্তি আমাদের দিও না ।’ আম্রপালী সেদিন তখনকি ভেবেছিলেন আজ আর জানার উপায় নাই। একজন পুরুষের পক্ষে তা বোঝাও হয়তো সম্ভব নয় ।
আম্রপালী তার পালক পিতা-মাতার মুখের দিকে চেয়ে আত্মহননের চেষ্টা থেকে নিজেকে বিরত রাখলেন। । তাকে ‘নগরবধূ’ ঘোষনা করা হলো। নগরের সবচেয়ে সুন্দর স্থানে প্রাসাদ নির্মাণ দেয়া হলো । প্রাসাদের নাম দেয়া হয়েছিল ‘আম্রকুঞ্জ’ ।
আম্র-পালী তখন কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে তাকে বহুভোগ্যা নগরনটী করার সিদ্ধান্ত স্বেচ্ছায় শিরোধার্য করে নিলেন।
আম্রপালীর শর্তগুলি ছিল নিম্নরূপঃ
(ক) নগরের সবচেয়ে মনোরম স্থানে তাঁর গৃহ নির্মিত হবে।
(খ)একবারে মাত্র একজন তাঁর গৃহে প্রবেশাধিকার পাবেন।
(গ)তাঁর দর্শণী হবে প্রতি রাত্রির জন্য পাঁচশত স্বর্ণমুদ্রা
(ঘ)শক্র বা কোনো অপরাধীর সন্ধানে সপ্তাহ অন্তে মাত্র এক দিন তাঁর গৃহে অনুসন্ধান করা যাবে।
(ঙ)তাঁর গৃহে আগত ব্যক্তিগণের সম্বন্ধে কোনো অনুসন্ধান করা চলবে না।
আম্রপালীর উক্ত পাঁচটি শর্তই বিধানসভা কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছিল।
‘পতিতা’ হিসেবে আম্রপালীর নতুন জীবন শুরু হয় । আম্রপালীর নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সে বৈশালীর রাজনর্তকী পদ প্রাপ্ত হন
মন্ত্রী গোপালের মুখে পুরো ঘটনা শোনার পরে মহারাজ বিম্বিসার অস্থির হয়ে পড়লেন। বললেন, ‘এই নারীকে এক নজর না দেখতে পেলে তো আমার জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে ! গোপাল ! আমার সৈন্যবাহিনীকে এখনই প্রস্তুত হতে বলো । আমি আজই বৈশালী রাজ্য আক্রমন করতে চাই । বৈশালী জয় করেই বীরের বেশে আমি আম্রপালীকে আমার মগধ রাজ্যে নিয়ে আসতে চাই !’
গোপাল বলল, ‘মহারাজ দয়া করে অস্থির হবেন না । অনুগ্রহ পূর্বক শান্ত হোন। কেবল একজন সামান্য পতিতা নারী আম্রপালীর জন্য যুদ্ধের আয়োজন করা শোভনীয় নয় ।”
মন্ত্রী গোপাল কি পেরেছিল রাজাকে শান্ত করতে ?

বাংলাদেশ সময়: ১৩:২৫:২৯   ৭০২ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

বিনোদন’র আরও খবর


১৬ ব্যান্ডের সবচেয়ে বড় কনসার্ট আজ আর্মি স্টেডিয়ামে
এবার হিন্দি সিনেমার নায়িকা বাংলাদেশের জয়া আহসান
আজ আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস, —”পুরুষ ও ছেলেদের সাহায্য করো”
শুভ জন্মদিন সুরের পাখী রুনা লায়লা
শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রবেশপত্রে সানি লিওনের ছবি!
রক্তাক্ত অমিতাভ বচ্চন হাসপাতালে
চঞ্চল,মেহজাবীন, তিশা, ফারিণ,পলাশ, শাহনাজ খুশি -সবাই গেলেন আমেরিকায়
দুই না তিন পুত্র সন্তানের বাবা শাকিব খান! সূত্রঃ জনকন্ঠ
শেখ হাসিনা বাংলাদেশে নারী ক্ষমতায়নের অগ্রদূত : স্পিকার ; ১০০০ নারী উদ্যোক্তা’র মধ্যে ৫ কোটি টাকার অনুদান প্রদান
বুবলীর সন্তানের বাবা শাকিব খান, বয়স আড়াই বছর

আর্কাইভ