গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, যে ব্যাংক দেশের জন্য অবদান রেখেছে, সেই ব্যাংককে এভাবে ধ্বংস হতে দেওয়া যাবে না। এটা মানুষের প্রতিষ্ঠান, মানুষই তা প্রতিহত করবে। তিনি আরও বলেন, সরকার কী চায়, সেটা হবে না। জনগণ কী চায়, তাই হবে।
গতকাল শুক্রবার সোশ্যাল বিজনেস ডে বা সামাজিক ব্যবসা দিবস উপলক্ষে স্থানীয় একটি হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী অধিবেশনের পর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস এসব কথা বলেন। সম্প্রতি গ্রামীণ ব্যাংককে ১৯ টুকরা করা, সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোসহ বিভিন্ন সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি।
গ্রামীণ ব্যাংক উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠানে আসা বিদেশি অতিথিদের মনোভাব সম্পর্কে ড. ইউনূস বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে প্রথম থেকেই বিদেশি অতিথিরা উদ্বিগ্ন। অর্থমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, ড. ইউনূস চলে যাওয়ার পর গ্রামীণ ব্যাংক আরও ভালো চলছে—এমন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যদি ভালোই চলে, তবে গ্রামীণ ব্যাংককে নষ্ট করার দরকার নেই।
‘রাজনীতিবিদ’ হওয়া প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী আমার প্রশংসা করলেন নাকি দুর্নাম করলেন, বুঝলাম না।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে এসেছেন বিএনপির নেতারা। কংগ্রেসাল মেডেল পাওয়ায় অভিনন্দন জানাতেও তাঁরা এসেছেন।’
এ ছাড়া অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য প্রদানের একপর্যায়ে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচিত নারী সদস্যদের মঞ্চে ডাকেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সদস্যরা মঞ্চে ওঠার পর তিনি তাঁদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা আপনাদের পাশে থাকব। আপনাদের ব্যাংক কেউ ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না।’
গ্রামীণ ব্যাংকের এই সদস্যদের সম্পর্কে তিনি বলেন, তাঁরাই নতুন বাংলাদেশ দিয়েছেন। প্রত্যেকেই ১০ লাখ নারী ঋণগ্রহীতার প্রতিনিধিত্ব করছেন। নারীর ক্ষমতায়নে তাঁরা কাজ করছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সামাজিক ব্যবসা দিবস: সামাজিক ব্যবসা দিবস উপলক্ষে দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ইউনূস সেন্টার। ৩০টি দেশের দেড় শতাধিক বিদেশি অতিথি এতে অংশ নেন। দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশি অতিথিরা নিজেদের অভিজ্ঞতা ও মতামত ব্যক্ত করেন।
উদ্বোধনী অধিবেশনে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সামাজিক ব্যবসার মধ্যে বিশাল একটা স্বপ্ন রয়েছে। দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে এ ধরনের ব্যবসা ব্যাপক ভূমিকা রাখে। কর্মসংস্থানে এই সামাজিক ব্যবসাকে কাজে লাগানো যেতে পারে বলে তিনি অভিমত দেন।
মুহাম্মদ ইউনূসকে স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে উল্লেখ করে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা বলেন, সামাজিক ব্যবসা হলো একটি অনন্য ধারণা, যা ড. ইউনূস অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে দরিদ্র লোকেরা ব্যবসা করতে পারে। তারা আয় করতে পারে। এটাকে ড. ইউনূসের ‘গ্রেট ম্যাজিক’ হিসেবে অভিহিত করেন তিনি।
জাপানের রাষ্ট্রদূত শিরো সাদাসিমা বলেন, সামাজিক ব্যবসার আওতায় জাপানে খুচরা ব্যবসা, অটোমোবাইল, কৃষি ও গবেষণার কাজ চলছে। দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব বিনির্মাণে সামাজিক ব্যবসার উদ্যোগ গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন মালয়েশিয়ার সেরেমবান রাজ্যের শাহজাদা টিংকু রেধাহউদ্দিন।
প্যানেল আলোচনা: কয়েকটি প্যানেল আলোচনায় সামাজিক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। এতে প্রত্যেকেই নিজ দেশ বা প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন।
সরকারি প্রতিষ্ঠান বা আন্তর্জাতিক সাহায্য ছাড়াই হাইতিতে চলছে সামাজিক ব্যবসা। প্রায় ২০০ এনজিও সামাজিক ব্যবসা করছে। এ তথ্য দিয়ে হাইতির ইউনূস সোশ্যাল বিজনেসের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ইপেনা লুইসেন আরও জানান, হাইতির ২ শতাংশ বনভূমির পরিমাণ ২৫ শতাংশে উন্নীত করতে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের সহায়তায় সামাজিক ব্যবসার আওতায় কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস, আফ্রিকার পরিচালক সিলভেইন ফ্রান্স ডি ফেরেইরা জানান, ড. ইউনূসের সামাজিক ব্যবসার ধারণাটি স্বীকৃতি দিয়েছে আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। ফ্রান্সের গ্রামীণ ভিওলিয়া ওয়াটারের প্রকল্প পরিচালক এরিক লেসুইয়ার জানান, গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিশুদ্ধ পানির সুবিধা দিতেই তাঁরা সামাজিক ব্যবসায় এসেছেন।
ফোর্বস সাময়িকীর শীর্ষ ৫০০ ধনীর তালিকায় থাকা নেপালের একমাত্র বিলিওনার ও চৌধুরী গ্রুপের চেয়ারম্যান বিনোদ কে চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার সমস্যা রয়েছে নেপালে। প্রতিবছর দুই লাখ লোক শ্রমবাজারে প্রবেশ করেন। সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে এই বেকারত্ব দূর করা সম্ভব।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ফ্রান্সের ড্যানোন গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ইমানুয়েল ফেবার ও ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস, জার্মানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাসকিয়া ব্রুওয়েস্টেন। অনুষ্ঠানে ইউনূস সেন্টারের মাধ্যমে পাঁচটি সামাজিক ব্যবসার উদ্যোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হয়।
অনুষ্ঠানে সামাজিক ব্যবসার শহর হিসেবে স্পেনের বার্সেলোনার নাম ঘোষণা করা হয়েছে। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত শহরটি এই মর্যাদা পাবে।
গতকাল ছিল মুহাম্মদ ইউনূসের জন্মদিন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই অতিথিরা তাঁকে শুভেচ্ছা জানান। আর চীন থেকে আসা প্রতিনিধিদলটি ‘উই নিড ইউ’ লেখা সংবলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে অনুষ্ঠান মিলনায়তনে আসে।
বাংলাদেশ সময়: ১১:১২:০১ ৪১৭ বার পঠিত