মন্ত্রী গোপাল রাজা বিম্বিসারকে আম্রপালীর সে অতীত জীবনের গল্প একে একে শোনানো শুরু করেন।
কাহিনীর প্রয়োজনে প্রসঙ্গক্রমে সে গল্প আবার পাঠকদের আমাকে বলতে হচ্ছে। তবে সবার আগে বলি আম্রপালীর রাজ্য বৈশালী পৃথিবীতে জন্ম নেয়া প্রথম প্রজাতন্ত্র তথা গণতান্ত্রিক রাস্ট্রগুলির একটি। বৈশালী প্রজাতন্ত্র -এ অধিকাংশের ভোটে রাজ্যের সমস্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের পূর্ব পর্যন্ত এসব প্রজাতন্ত্র এর অস্তিত্ব ছিল।
এই বৈশালীর ”শ্রাবস্তী” নামক শহরে মহানমা নামে সামন্ততান্ত্রিক সমাজের একজন বসবাস করতেন । (আশাকরি পাঠকগণ শ্রাবস্তী- নামের সাথে পরিচিত আছেন) ঐ যে কবি জীবনানন্দ দাশ এর বনলতাসেন কবিতার একটি লাইন, ‘মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য’ । প্রাচীন সুন্দর শহর বলেই বোধ হয় কবি বনলতার সাথে প্রাচীন শ্রাবস্তী নামক শহরের তুলনা করেছিলেন। মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য,কথাটির অর্থ তারও মুখ জুড়ে সুদূর অতীতের অন্ধকার ঐশ্বর্য।
আজ থেকে প্রায় ৮৫ বছর আগে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ কবিতা ‘বনলতা সেন’। কে ছিলেন এই বনলতা সেন? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়া যায়নি। এই কবিতাটি লিখে সে সময়ে জীবনানন্দ দাশ ব্যাপক হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন।
যা হোক ,কবিতার সে লাইন গুলি আবার দেখুন।
”চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।”)
শ্রাবস্তী বর্তমানে গঙ্গার নিকটবর্তী নেপাল- উত্তর প্রদেশ সীমান্তের কাছকাছি একটি জেলা। গৌতম বুদ্ধ শ্রাবস্তী এসেছিলেন। ধ্যান করেছিলেন, দান করেছিলেন এবং এভাবে শ্রাবস্তী নগরীকে তিনি অমর করে রেখেছেন। শ্রাবস্তীর রাজকুমার জেত অসম্ভব ধনাঢ্য ছিলেন; তিনি বুদ্ধকে আঠারো কোটি স্বর্ণ মুদ্রা দান করেছিলেন।
যা হোক , মন্ত্রী আম্রপালীর সে অতীত জীবনের গল্প একে একে রাজাকে শোনানো শুরু করলেন।
বৈশালী রাজ্যের এই শ্রাবস্তী নামক স্থানে মহানামা নামের যিনি বসবাস করতেন তিনি একদিন এক কন্যা শিশুসন্তানকে ক্রন্দনরত অবস্থায় একটি আমগাছের নীচে পড়ে থাকতে দেখেন । মহানামা তাকে কুড়িয়ে পেয়ে নিজের বাসায় নিযে যান। স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে এ নিঃসন্তান দম্পতী তাকে নিজের সন্তান হিসেবে লালন-পালন করবার সিদ্ধান্ত নেন । তার নাম রাখা হয় ‘আম্রপালী’ । আম্রবাগনে কুঁড়িয়ে পাওয়াতেই এই নাম ।
যত বয়স বাড়তে লাগলো আম্রপালী তত বেশী রূপবতী হয়ে উঠতে লাগলো । আম্রপালীর বয়স যখন এগারো /বার বছর, মহানমা তখন আম্রপালীর বিয়ের জন্য পাত্রের সন্ধান শুরু করেন। আম্রপালীকে বিবাহ করার জন্য জনপদের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মধ্যে কোন্দল বেঁধে গেল । আশে-পাশের বহু দেশের রাজা , রাজপুত্র, মন্ত্রীপুত্র, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, কাফেলার দলপতি , শহরের বণিক, গ্রামের মহাজন,আম্রপালিকে বিয়ে করতে চাইলেন । সাধারণ মানুষ তো একবার তার দর্শন পেলেই কৃতার্থ হয়ে যায় | আম্রপালীর রূপে সবাই এতটাই মুগ্ধ যে একে অন্যের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করে হলেও প্রত্যেকেই আম্রপালীকে নিজের করে নিতে রাজী ছিলেন ।
আম্রপালীকে নিয়ে এই বিতর্ক বৈশালী প্রজাতন্ত্রের হর্তাকর্তা গণের কানে গিয়ে পৌঁছুলে তারা তাদের এ বিষয়টিকে নিয়ে বিধানসভাতেই আলোচনা শুরু করেন । পিতা সহ আম্রপালীকে সভায় ডাকা হয় । এতোদিন তারা আম্রপালীর অসামান্য যে রূপের কথা কেবল লোকমুখে শুনে এসেছেন তা এই প্রথম তারা সামনাসামনি প্রত্যক্ষ করলেন । সবাই মুগ্ধ । স্বর্গের অপ্সরাও বুঝি আম্রপালীর তুলনায় নগন্য । সবাই উত্তেজিত হয়ে মত দিল আম্রপালী কারো একার গতে পারেনা। তার ঐশ্বরিক সৌন্দর্য উপভোগের অধিকার সবার । চাঁদ কারও একার হতে পারে না । তাই আম্রপালীকে একজন পুরুষের সঙ্গে বিবাহের অধিকার দেয়া ধর্মসম্মত নয়। একে প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক পুরুষের স্ত্রী হিসেবে মনোনীত করে ‘নগরবধূ’ করে রাখা হোক ।’
সে যুগে রূপবতীর সতীত্বের মূল্য সমাজপতিদের কাছে ছিল না । আম্রপালী আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ।আম্রপালীর পালক পিতা মহানমা আম্রপালীর মনের কথা বুঝলেন । তিনি আম্রপালীর মাথায় স্নেহ মাখা হাত রেখে বললেন, ‘মাগো ! তুমি হয়তো আজ আত্মহত্যা করে মুক্তি পেয়ে যাবে । কিন্তু আমি আর তোমার মা রাজদন্ড মতে শূলবিদ্ধ হবো । এমন শাস্তি আমাদের দিও না ।’ আম্রপালী সেদিন তখনকি ভেবেছিলেন আজ আর জানার উপায় নাই। একজন পুরুষের পক্ষে তা বোঝাও হয়তো সম্ভব নয় ।
আম্রপালী তার পালক পিতা-মাতার মুখের দিকে চেয়ে আত্মহননের চেষ্টা থেকে নিজেকে বিরত রাখলেন। । তাকে ‘নগরবধূ’ ঘোষনা করা হলো। নগরের সবচেয়ে সুন্দর স্থানে প্রাসাদ নির্মাণ দেয়া হলো । প্রাসাদের নাম দেয়া হয়েছিল ‘আম্রকুঞ্জ’ ।
আম্র-পালী তখন কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে তাকে বহুভোগ্যা নগরনটী করার সিদ্ধান্ত স্বেচ্ছায় শিরোধার্য করে নিলেন।
আম্রপালীর শর্তগুলি ছিল নিম্নরূপঃ
(ক) নগরের সবচেয়ে মনোরম স্থানে তাঁর গৃহ নির্মিত হবে।
(খ)একবারে মাত্র একজন তাঁর গৃহে প্রবেশাধিকার পাবেন।
(গ)তাঁর দর্শণী হবে প্রতি রাত্রির জন্য পাঁচশত স্বর্ণমুদ্রা
(ঘ)শক্র বা কোনো অপরাধীর সন্ধানে সপ্তাহ অন্তে মাত্র এক দিন তাঁর গৃহে অনুসন্ধান করা যাবে।
(ঙ)তাঁর গৃহে আগত ব্যক্তিগণের সম্বন্ধে কোনো অনুসন্ধান করা চলবে না।
আম্রপালীর উক্ত পাঁচটি শর্তই বিধানসভা কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছিল।
‘পতিতা’ হিসেবে আম্রপালীর নতুন জীবন শুরু হয় । আম্রপালীর নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সে বৈশালীর রাজনর্তকী পদ প্রাপ্ত হন
মন্ত্রী গোপালের মুখে পুরো ঘটনা শোনার পরে মহারাজ বিম্বিসার অস্থির হয়ে পড়লেন। বললেন, ‘এই নারীকে এক নজর না দেখতে পেলে তো আমার জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে ! গোপাল ! আমার সৈন্যবাহিনীকে এখনই প্রস্তুত হতে বলো । আমি আজই বৈশালী রাজ্য আক্রমন করতে চাই । বৈশালী জয় করেই বীরের বেশে আমি আম্রপালীকে আমার মগধ রাজ্যে নিয়ে আসতে চাই !’
গোপাল বলল, ‘মহারাজ দয়া করে অস্থির হবেন না । অনুগ্রহ পূর্বক শান্ত হোন। কেবল একজন সামান্য পতিতা নারী আম্রপালীর জন্য যুদ্ধের আয়োজন করা শোভনীয় নয় ।”
মন্ত্রী গোপাল কি পেরেছিল রাজাকে শান্ত করতে ? এ প্রশ্নের উত্তর আগামী পর্বে। (ক্রমশঃ)
বাংলাদেশ সময়: ৮:৪৩:৪৭ ১২৩৫ বার পঠিত #bangla news #bangladeshi News #bd news #bongo-news(বঙ্গ-নিউজ) #জাতীয় #শিরোনাম