বঙ্গ-নিউজ ডটকম: মুসলিম বিরোধী চরমপন্থি ভিক্ষুদের প্রতি মিয়ানমার সরকারের অনুমোদন এবং নীরব সহযোগিতা রয়েছে বলে দাবি করেছে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স। মিয়ানমারে মুসলিম-বৌদ্ধ সম্পর্কের ওপর সরেজমিন খোঁজখবর নিয়ে তৈরি করা বিশেষ একটি প্রতিবেদনে এ দাবি করে সংবাদ মাধ্যমটি।মিয়ানমারের বৌদ্ধ ধর্মীয় চরমপন্থি ‘আন্দোলন ৯৬৯’ নামে খ্যাত। ইতোমধ্যে সংগঠনটি নিজেদের পুরো সাংগঠনিক প্রক্রিয়া তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তার করতে পেরেছে। গ্রুপটি চরমপন্থায় চালিত এবং তাতেই তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। গ্রুপটির প্রধান একজন ভিক্ষু। ভিরাথু নামে এই ভিক্ষু সাবেক সামরিক জান্তা সরকারের সময় মুসলিম বিরোধী সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়ার কারণে একবার জেলও খেটেছেন।
রয়টার্সের সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভিরাথুকে তার মুসলিমবিরোধী তৎপরতার জন্য রীতিমত ‘বার্মিজ বিন লাদেন’ নামেও ডাকা হয় দেশটিতে। রয়র্টার্স অনুসন্ধানে সবচেয়ে বিস্ময়করভাবে যে তথ্য উদঘাটিত হয় তা হল, ভিরাথুর এই চরমপন্থি বৌদ্ধ ধর্মীয় সংগঠন ৯৬৯ এর সাথে গুরুতর সম্পর্ক রয়েছে মিয়ানমার সরকারের।
বিশেষত ৯৬৯ এর মূল শেকড় গ্রথিত দেশটির সামরিক সরকারের কাঠামোতে। সামরিক কর্মকর্তাদের ভেতরে এ সংগঠনের মূল বিস্তার ঘটে গেছে চোখে পড়ার মত। রয়টার্স জানায়, আজকের সংস্কারপন্থি গণতন্ত্রী মিয়ানমারও কিন্তু এই জান্তা সরকারেরই উত্তরসূরি। তারই ওসরে সংস্কারপন্থি আজকের মিয়ানমার সরকারের জন্ম।
ফলে ৯৬৯ নামে আন্দোলনটি বর্তমান মিয়ানমার সরকারের শীর্ষ অনেক কর্মকর্তার ব্যাপক সমর্থন পেয়ে আসছে। এমনকি দেশটির বিরোধীদলীয় গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী নোবেলজয়ী অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) এর বেশ কয়েকজন সদস্যও ৯৬৯ এর প্রতিষ্ঠা, সাংগঠনিক তৎপরতাকে নিবিড়ভাবে সহযোগিতা দিয়ে আসছে।
ভিরাথু দেশটিতে মুসলমানদের দোকান ও আন্তধর্মীয় বিবাহ বর্জন করার আহবান জানিয়েছেন। ভিরাথু ইতোমধ্যে দেশটিতে মুসলমানদের ধর্মীয় ইবাদতের স্থান মসজিদকে ‘শত্রু ঘাঁটি’ বলে ঘোষণা দিয়েছে।
রয়টার্স তার অনুসন্ধানে দাবি করে বলেছে, ভিরাথুর চরমপন্থি তৎপরতার সাথে মিয়ানমারের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রীও রয়েছেন। তবে ভিরাথুর ধর্মীয় অভিভাষণগুলো বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে বোঝাবুঝি, সম্প্রীতি ও ভালবাসার কথাই বলে দাবি করেছেন ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রী সান সিন্ট।
রয়টার্সের সাথে এক সাক্ষাৎকারে ধর্মমন্ত্রী সিন্ট ভিরাথুর চরমপন্থার কথা অস্বীকার করেন। ভিরাথু সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তিনি ধর্মীয় সহিংসতা উসকে দিচ্ছেন এটা হতে পারে না। অসম্ভব।’ সান সিন্ট এক সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল ছিলেন। ৯৬৯ এর ভিক্ষুরা মুসলমানদের দোকানপাট ও ব্যবসা বাণিজ্য যে বয়কট করার ঘোষণা দিয়েছে তাতে সিন্ট দোষের কিছু দেখেন না।
তবে তিনি ভিক্ষুদের বয়কট করার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন বাজার অর্থনীতি চর্চা করছি’ তো ‘কেউ তো এটা বন্ধ করতে পারে না। এটা তো ভোক্তাদের ব্যাপার।’
একইভাবে মিয়ানমার প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন ৯৬৯’র মতাদর্শকে শান্তিপূর্ণ বলে মনে করেন। এ বিষয়ে প্রেসিডেন্টের কার্যালয় রয়টার্সকে কোন মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। তবে গ্রুপটির আন্দোলন ও তৎপরতা নিয়ে ক্রমবর্ধমান বিতর্কে সাড়া দিয়ে প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে রোববার একটি বিবৃতি দেয়া হয়। বিবৃতিতে ৯৬৯কে শান্তিপূর্ণ আখ্যা দিয়ে বলা হয়, ‘৯৬৯ নিছকই একটি শান্তির প্রতীক’। এবং ভিরাথু হলেন ‘প্রভু বুদ্ধের একজন পুত্র।’
মূলত ভিরাথু এবং তার অন্যান্য সহযোগী ভিক্ষুরা মিয়ানমার ব্যাপী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও সহিংসতার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। রয়টার্সের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, গতে অক্টোবরে মিয়ানমারের রাখাইনে গ্রুপটির কর্মী ও সমর্থকরা মুসলমান রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হামলায় সরাসরি অংশ নিয়েছিল। এদের সাথে কোথাও কোথাও নিরাপত্তা বাহিনীর স্থানীয় সদস্যরাও অংশ নেয়।
গেল মার্চে মিয়ানমারের অন্যতম শহর মেইখতিলায় ভিক্ষুদের ছড়িয়ে দেয়া সহিংসতায় অন্তত ৪৪ মুসলিম নিহত হন এবং ১৩ হাজার মুসলিম বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ হয়ে যায়। সংগঠনটিতে নয়শ ঊনসত্তর ভিক্ষু থাকায় এটি ৯৬৯ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এটি একটি জাতীয়তাবাদী ধর্মীয় আন্দোলন। অনেকে সংগঠনটির আন্দোলনকে জার্মানির হিটলারের চরম জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট নাৎসী বা নাজিদের সাথে তুলনা করেন।
গ্রুপটির আন্দোলনের সম্পর্ক সরাসরি রাষ্ট্রের সাথে। সংগঠনটি গড়ে ওঠার পেছনে মিয়ানমার সরকারের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা ভিক্ষু কায়া লইনই প্রধান পথিকৃৎ। রয়টার্স জানায়, মিয়ানমারের সাবেক জান্তা সরকার ১৯৮৮ সালে নির্মমভাবে গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান দমনের পর দেশটিতে বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক সম্প্রসারণে কায়া লইনকে দায়িত্ব দেয়।
কারণ সেসময় দেশটির জনগণের মধ্যে সরকারের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে বৌদ্ধধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছিল। লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক এ বার্তা সংস্থাটি জানায়, ওই সময়ের মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে দেখা যায়, প্রায় প্রতিদিনই দেশটির প্রধান ও অন্যান্য জেনারেলদের কোন না কোন প্যাগোডা কিংবা বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের খবর প্রকাশিত হয়েছে।
সে সময় থেকেই ভিক্ষুদের সরকার কর্তৃক নিবন্ধিত করা হয়। এবং তাদের সাংগঠনিক তৎপরতাও সীমিত করে আনা হয়। এর মধ্য দিয়ে বৌদ্ধধর্মকে সাংবিধানিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা না হলেও রাষ্ট্রের কাঠামোগুলোতে বৌদ্ধ ধর্মীয় শীর্ষ ব্যক্তিত্বদের মর্যাদা দেয়া হয়। এবং তাদের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
বৌদ্ধ ধর্মের সম্প্রসারণ এবং পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৯১ সালে দেশটির জান্তা সরকার ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরে ডিপার্টমেন্ট অফ দ্য প্রোমোশন এন্ড প্রোপাগেশন অফ দ্য সাসানা (ডিপিপিএস) গঠন করে। এবং এর প্রধান হিসেবে কায়া লইনকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
পালি ভাষায় সাসানা মানে ‘ধর্ম’। পালি হল বৌদ্ধদের ধর্মীয় ভাষা। পরে বৌদ্ধ শব্দটির সমার্থক হয়ে সাসানা শব্দটি।
১৯৯২ সালে কায়া পদত্যাগ করেন। বর্তমানে ডিপিপিএস এর প্রধান খাইন অং। যিনি একজন সাবেক সামরিক শীর্ষ কর্মকর্তা। কায়া লইনের ছেলে অং লইন তুন জানান, তার বাবা কায়া লইনের সাথে দেশটির উচ্চ পর্যায়ে সামরিক কর্মকতাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কায়ার স্ত্রীও ৯৬৯ এর সাথে যুক্ত ছিল। তবে পরে তাকে সংগঠনটি থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। তুন বলেন, “তার সাথে সাবেক জান্তা শাসক থান শোয়ের সাথেও নিবিড় সম্পর্ক ছিল। ধর্মীয় বিষয়ে আলাপ করতে তারা প্রায় দেখা করত।”
দেশটিতে মুসলিম বাণিজ্য বন্ধে ৯৬৯ এর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আন্দোলন এ সময়ে খুবই আলোচিত বিষয়। সহিংসতার কারণও মুসলমানদের দোকানপাট বাণিজ্য কেন্দ্র বন্ধকরণ বটে। কিন্তু কেন মুসলমানদের ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধের প্রতি ভিক্ষুদের নজর পড়ল তার সম্পর্কে রয়টার্স জানায়, মিয়ানমারের মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনেকেই মুসলিম।
এমনকি দেশটির ছোট ও মাঝারি শ্রেণীর অধিকাংশ ব্যবসাপাতিই মুসলিমদের দখলে। নির্মাণ কোম্পানি নাইং গ্রুপ, মাদারল্যান্ড, ফাদারল্যান্ড মিয়ানমারে ব্যাপক প্রসিদ্ধ কোম্পানি। বলা যায় বড় কোম্পানিগুলোর মধ্যে অন্যতম এই কোম্পানিগুলো।
বর্তমানে দেশটির প্রধান শহর ইয়াঙ্গুনের আধুনিক ভবনগুলো তাদেরই তৈরি। তবে ৯৬৯ এর আন্দোলনের ফলে বৌদ্ধ ক্লায়েন্টরা ইতিমধ্যে মুসলিম কোম্পানিগুলোকে বাদ দিয়েছে। ইয়াঙ্গুনে মুসলমান ব্যবসায়ী ও কোম্পানিগুলো বর্জন সম্পর্কে ক্ষমতাসীন ইউনিয়ন সলিডারিটি এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির একজন মুসলিম এমপি শোয়ে মুয়াং বলেন, ‘আমি খুবই উদ্বিগ্ন এই একটি শহরেই যদি এটি শুরু হয়ে যায় তবে তো এটি অন্য শহরগুলোতেও প্রভাব ফেলবে।’
মিয়ানমারের প্রাণকেন্দ্র ও রাখাইনে সহিংসতায় এ পর্যন্ত কমপক্ষে ১ লক্ষ ৫৩ হাজার মুসলমানদের নিজ বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে দেয়া হয়েছে। এখন তারা বিভিন্ন ক্যাম্পে আছে। এসব ক্যাম্প দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন। তবে তাদেরকে নিজ বাস্তুভিটা ফিরিয়ে দেয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
উল্লেখ্য, ৯৬৯ সম্প্রতি দাবি করেছে তাদের দেশ নাই। তারা তাদের দেশ হারিয়ে ফেলেছে ফলে তারা তাদের বৌদ্ধের মিয়ানমার পুনরুদ্ধারে আন্দোল চালিয়ে যাবে। অবশ্য মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় কোন ধর্ম নেই। সাংবিধানিকভাবে বৌদ্ধও মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় ধর্ম নয়।
তবে বৌদ্ধ ধর্মানুসারীরাই দীর্ঘ সময় মিয়ানমার শাসন করে আসছে। দেশটির জনসংখ্যার মাত্র ৪ ভাগ মুসলমান। বৌদ্ধরা হলো ৯০ ভাগ।
বাংলাদেশ সময়: ১২:১৮:১৩ ৪৫১ বার পঠিত