বঙ্গ-নিউজঃ বাসের ধাক্কায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের মৃত্যু, মেয়রের আশ্বাস মানেনি কেউ, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ভিপি নুরের একাত্মতা। ‘আবরার তোর স্মরণে-ভয় পাই না মরণে’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’- শিক্ষার্থীদের এমন স্লোগানে উত্তাল ছিল গতকালের ঢাকার রাজপথ। খণ্ড খণ্ড অবস্থান আর বিক্ষোভে রাজধানীর প্রগতি সরণি অবরোধ করে রাখেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এ সময় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলামের আশ্বাসেও শিক্ষার্থীদের অবস্থানের নড়চড় হয়নি। মেয়রের ঘটনাস্থল ত্যাগ করার পরই সেখানে একটি বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। নিহত আবরারের সহপাঠীদের দিনভর আন্দোলনে বারিধারা নতুনবাজার থেকে খিলক্ষেত পর্যন্ত সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে বাড্ডা, রামপুরা, খিলক্ষেত ও বিমানবন্দর এলাকায় দেখা দেয় তীব্র যানজট। সন্ধ্যায় অবরোধ তুলে নেওয়া হলে ওই এলাকায় যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। আজ সকাল ৮টা থেকে আবারও সড়কে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন ও অবরোধ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল সকাল সাড়ে ৭টার দিকে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে জেব্রা ক্রসিংয়ের ওপর সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাসের চাপায় নিহত হন বিইউপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী। রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) চলা ট্রাফিক সপ্তাহের তৃতীয় দিনে এ ঘটনা ঘটল। এ খবরে ঘটনাস্থলে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন তার সহপাঠীরা। শতাধিক শিক্ষার্থীর এ আন্দোলনে একে একে সংহতি জানাতে আসেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, পাইওনিয়ার ডেন্টাল কলেজ ও শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থীরা। পরে ঘাতক বাসটি জব্দ ও তার হেলপার সিরাজুল ইসলামকে আটক করে পুলিশ। বাদ জোহর বিইউপির ক্যাম্পাসে নামাজে জানাজা শেষে বিকাল পৌনে ৪টার দিকে বনানী কবরস্থানে আবরারের লাশ দাফন করা হয়। জানা যায়, ঘাতক বাসটি আবরারকে ধাক্কা দেওয়ার আগে বারিধারা নতুনবাজারে দাঁড়িয়ে থাকা মিরপুর আইডিয়াল স্কুলের ছাত্রী সিনথিয়া সুনতানাকে ধাক্কা দেয়। এতে সিনথিয়ার ঘাড়ের হাড় ভেঙে যায়। পথচারীরা ধাওয়া দিলে বাসটি বেপরোয়া গতিতে পালিয়ে গিয়ে যমুনা ফিউচার পার্কে দ্বিতীয়বার একই ঘটনা ঘটায়। আহত স্কুলছাত্রী সিনথিয়াকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তবে পুলিশ জানায়, নতুন বাজারের ঘটনায় যাত্রীরা চালককে আটক করে তাদের কাছে সোপর্দ করে। পরে হেলপার গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে আসে। ঘটনার পর থেকে সে পলাতক। চালকের কাছে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আবরারের নিহত হওয়ার ঘটনায় তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কুড়িল থেকে নর্দা পর্যন্ত অন্তত ছয়টি জায়গায় অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন। ওই রুটে চলা দুটি বাসের শিক্ষার্থী ছাড়াও মিরপুরের ক্যাম্পাস থেকেও এসে যোগ দেন শত শত শিক্ষার্থী। পরে বিভিন্ন স্লোগানে বিক্ষোভ করেন তারা। এ সময় বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় গড়ে ওঠা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা তাদের আট দফা দাবি নিয়ে সংহতি জানাতে আসেন। দুপুর দেড়টার দিকে সেখানে বিক্ষোভ থামিয়ে আবরারের রুহের মাগফিরাত কামনায় দোয়া অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে আন্দোলনরতদের ফাঁসাতে বাসের এক হেলপার নিজেই সুপ্রভাতের একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেন বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন। শিক্ষার্থীরা ওই আগুন তৎক্ষণাৎ নিভিয়ে ফেলেন। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যান ওই হেলপার। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, আবরার নিয়ম মেনেই পথচারী পারাপারের জন্য নির্ধারিত স্থান জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। এ সময় তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে তুলে দেওয়ার জন্য সঙ্গে এসেছিলেন তার বাবা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আরাফাত আহমেদ চৌধুরী। তাদের নিজেদের বাড়ি মালিবাগের নিউ সার্কুলার রোডে। তবে তারা যমুনা ফিউচার পার্কের পেছনের দিকে ভাড়া বাসায় থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে ওঠার সময় অন্য একটি বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়েই আবরারকে ধাক্কা দিয়ে প্রায় ১০ মিটার দূরে ঠেলে নিয়ে যায় সুপ্রভাত পরিবহনের বাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের শিক্ষার্থী আবরারের বন্ধু নাজমুস সাকিব জানান, ‘যে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আবরার আন্দোলন করেছে, কথা বলেছে, সেই সড়কেই তার প্রাণ গেল। তাহলে সড়ক কতটুকু নিরাপদ হয়েছে? সবার জন্য সে নিরাপদ সড়ক চেয়েছিল। কিন্তু দিনের শেষে কী পেলাম? আমার বন্ধু আজ সড়কেই মারা গেল।’
সুপ্রভাত বাসটির নিবন্ধন বাতিল : এদিকে সুপ্রভাতের সেই বাসের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় বিআরটিএর সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) মো. রফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়।
সন্ধ্যায় বিক্ষোভ কর্মসূচি স্থগিত : সন্ধ্যা ৬টার দিকে গতকালের মতো বিক্ষোভ কর্মসূচি স্থগিতের ঘোষণা দেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। তাদের পক্ষে মাইশা নূর নামে এক শিক্ষার্থী সাংবাদিকদের জানান, ‘বুধবার সকাল ৮টায় আবার সড়কে অবস্থান নেবেন তারা। এটা কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। এখানে রাজনৈতিক উপস্থিতির কোনো প্রতিফলন আমরা দেখতে চাই না।’ বাসচাপায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের মৃত্যুর প্রতিবাদে সারা দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের আহ্বান জানান মাইশা নূর।
তোপের মুখে মেয়র আতিকুল : বেলা সোয়া ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। এ সময় তিনি বলেন, ‘আজ সময় এসেছে সচেতনতা বৃদ্ধি করার। সেটা তোমরাই পারবে। আজ তোমাদের দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক।’ প্রতি মাসে সড়ক নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈঠকের কথাও বলেন তিনি। শিক্ষার্থীরা তাকে জানান, জাবালে নূর বন্ধ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জাবালে নূর এখনো চলছে। সুপ্রভাত বাস এমন একটি দুর্ঘটনা ঘটানোর পরও কাল থেকে চলবে। পরে মেয়র আবরার আহমেদ চৌধুরীর নামে সেখানে সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে একটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি এবং সুপ্রভাত বাস বন্ধের ঘোষণা দেন। এরপর রাস্তা ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করলে শিক্ষার্থীরা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। তাদের তোপের মুখে একপর্যায়ে সেখান থেকে চলে যান মেয়র আতিকুল।
ডাকসু ভিপি নুরের সংহতি : সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের মাঝে গিয়ে আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছেন ডাকসুর নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুর। বিকাল পৌনে ৫টার দিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা রাশেদ খানকে নিয়ে সেখানে যান তিনি। এ সময় নুর শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ একাত্মতা প্রকাশ করেছে। এর আগে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটা আন্দোলনে রক্তক্ষয়ী হামলা চালানো হয়েছে। এজন্য ছাত্রসমাজকে সচেতন থাকতে হবে।
আন্দোলনরতদের ব্রিফিং : এর আগে দুপুরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন শামীম আল হাসান। তিনি জানান, ‘আমাদের আট দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাব। ইতিমধ্যে আমাদের চার-পাঁচটি দাবির সঙ্গে মেয়র একমত হয়েছেন। আমরা চাই আমাদের বাকি দাবিগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন হোক। আমরা যে দাবি দিয়েছি তা যৌক্তিক। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমাদের এ দাবি মেনে নিতে হবে।’
আট দফায় যা আছে : বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- পরিবহন সেক্টরকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা, আটক চালককে দ্রুততম সময়ের মধ্যে শাস্তির আওতায় আনা, ফিটনেসবিহীন বাস ও লাইসেন্সবিহীন চালক অপসারণ, স্পিড ব্রেকার ও ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ, সড়কে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ আইনের আওতায় আনা, দায়িত্বে অবহেলাকারী প্রশাসন ও ট্রাফিক পুলিশকে স্থায়ী অপসারণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, প্রতিযোগিতামূলক গাড়ি চলাচল বন্ধ করে নির্দিষ্ট বাস স্টপ ও যাত্রী ছাউনি করা, ছাত্রদের জন্য হাফ পাস বা আলাদা বাস সার্ভিস চালু।
বাংলাদেশ সময়: ৭:১০:৩৮ ৬০৯ বার পঠিত