বঙ্গ- নিউজ ডটকমঃ একটি মাছ ধরার নৌকায় ওঠা ৪০ যুবকের চোখে ছিল মালয়েশিয়া যাওয়ার রঙিন স্বপ্ন। অল্প টাকায় স্বপ্নের সে দেশে যাওয়ার জন্য জীবন বাজি রেখে তারা ট্রলারে করে সমুদ্র পথে রওনা হয়েছিলেন।কিন্তু উত্তাল সে সমুদ্রের ঢেউয়ে টিকতে পারেনি ট্রলারটি। ডুবে যায় চোখের সামনেই। বিভীষিকাময় এ ঘটনার বর্ণনা দিলেন সেখান থেকে বেঁচে আসা শামীম আহম্মেদ। কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘‘আমি কোনোমতে একটি মাছের ড্রাম ধরে তিনদিন সমুদ্রে ভাসতে থাকি। শেষতক জেলেরা আমাকে উদ্ধার করে। চোখের সামনে মানুষগুলো এভাবে পানিতে তলিয়ে গেল, শুধু আপসোস করা ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না।”
সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার বিভীষিকাময় ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কেঁদে ওঠেন শামীম আহম্মেদ। তিনি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার দিঘলদী গ্রামের বাসিন্দা।
বৃহস্পতিবার বিকেলে শামীমের সঙ্গে কথা হয় সাংবাদিকদের। শামীম জানান, ওই ট্রলারে থাকা ৪০ জনের মধ্যে নয়জনের বাড়ি আড়াইহাজারের বিভিন্ন এলাকায়।
৬ জুন শামীমসহ ৪০ জনকে টেকনাফ থেকে মাছ ধরার ট্রলারে করে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাঠানো হয়। পরে ট্রলারটি ডুবে গেলে তিনদিন সমুদ্র ভেসে থাকার পর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের মাধ্যমে উদ্ধার হন শামীম। উদ্ধারের পর শামীমকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় নেওয়া হয় টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। অবস্থার অবনতি ঘটায় পরে তাকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। চিকিৎসা শেষে সম্প্রতি বাড়ি ফিরেছেন শামীম। সুস্থ হলেও সেই ঘটনা এখানো দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাকে।
সাংবাদিকদের শামীম জানান, দুই/তিন লাখ টাকার বিনিময়ে মালয়েশিয়া পৌঁছে দেওয়া এবং চাকরির নিশ্চয়তা দিয়ে একটি দালাল চক্র আড়াইহাজার উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে ১০০ জন বেকার যুবককে কয়েক দফায় কক্সবাজার নিয়ে যায়। ৬ জুন প্রথম দফায় ছিল ৪০ জন। এদের প্রথমে ঢাকা থেকে বাসে করে নেওয়া হয় কক্সবাজার। সেখানে কয়েকটি গেস্ট হাউজে চারটি গ্রুপে ভাগ করে যুবকদের রাখা হয়। প্রথম ৪০ জনের চালানটি নেওয়া হয় টেকনাফ সীমান্তে। প্রত্যেককে কালো হাফ প্যান্ট ও কালো গেঞ্জি পড়িয়ে জেলে সাজিয়ে ডিঙি নৌকায় করে দালাল চক্র রওনা হয় গভীর সমুদ্র পথে।
তিনি আরো বলেন, ‘‘মাছ ধরার ট্রলারে করে আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল থাইল্যান্ড। পরে থাইল্যান্ড ও এর সীমান্তে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন কৌশলে মালয়েশিয়ার পৌঁছে দেওয়ার কথা। এরপর মালয়েশিয়ার স্থানীয় এজেন্ট আমাদের রিসিভ করে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে চাকরি দিয়ে শর্ত পূরণ করবে। আমাদেরও স্বপ্ন পূরণ হবে।”
শামীম বলেন, ‘‘কিন্তু ডিঙি নৌকায় আধা ঘণ্টা চলার পর দালাল চক্র ৪০ জনের মধ্য থেকে ১২ জনকে তাদের সম্মতিতেই ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে অজ্ঞান করে মাছের ড্রামে বিশেষ কায়দায় রেখে দেয়। বাকিরা জেলে সেজেই সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয়। যাদের অজ্ঞান করে ড্রামে ভরা হয়েছিল তারা মূলত ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা কম দিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও দালালদের এই কৌশল মানতে রাজি হয়েছিল।”
শামীম বলে যান, ‘‘মাছের ড্রামে ভরে ১২ জনকে এবং জেলে সাজিয়ে বাদ বাকিদের মাঝ সমুদ্রে একটি মাছ ধরার ট্রলারে ওঠানো হয়। লোকজন বেশি হয়ে গেছে বলে ট্রলারের মাঝিদের সঙ্গে দালাল চক্রের কথাকাটি হয়। মাঝিদের আপত্তি সত্ত্বেও দালাল চক্র ৪০ জনের চালানটি ট্রলারে উঠিয়ে দিয়ে নিজেরা টেকনাফে ফিরে যায়। গভীর সমুদ্রে যাওয়ার পরপরই উত্তাল সাগরে ট্রলারটিকে টালমাটাল মনে হচ্ছিল। চোখের সামনে ট্রলারটি ডুবে যায়। আমি ড্রাম আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। তিন দিন তিন রাত আমি এ অবস্থায় ভাসতে থাকি।”
তিনি বলেন, ‘‘আড়াইহাজারের নয়জন ডুবে যাওয়া ট্রলারে ছিল। এছাড়া বাকি ৩১ জনের কী অবস্থা সেটা আমার জানা নেই।”
নিখোঁজ যারা
আড়াইহাজার উপজেলার ব্রাহ্মন্দী গ্রামের শুক্কুর আলীর ছেলে সোহেল, ফাউসা গ্রামের বিলালের ছেলে আনোয়ার হোসেন, উজান গোবিন্দীর আলম, দিঘলদীর আরজু ভূঁইয়ার ছেলে সাইফুল, চালিভাঙ্গা গ্রামের জজ মিয়ার ছেলে দুলাল ও একই গ্রামের লাল মিয়ার ছেলে স্বপন, গোলাম রসুল ও আবদুল কাদির নিখোঁজ রয়েছেন।
পুলিশের বক্তব্য
আড়াইহাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আখতার মোরশেদ টেকনাফ থানার ওসির বরাত দিয়ে জানান, মানব পাচার ও ট্রলার ডুবে যাওয়ার ঘটনায় টেকনাফ থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় মানব পাচারকারীরা ঢাকার ও নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের বাসিন্দা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গত সপ্তাহে টেকনাফ থানার ওসি তাকে ফোন করে বিষয়টি জানান।
ওসি আখতার আরো জানান, এরই মধ্যে নিখোঁজ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। নিখোঁজদের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মেম্বারদের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১:১৬:০৮ ৪৪৩ বার পঠিত