সাজিব, স্টাফ রেপোটার : মেয়র পদে মোট প্রার্থী সাত জন। জনগণের হিসাব দুই জনকে নিয়ে। আওয়ামী লীগ ও ১৪ দল সমর্থিত এডভোকেট আজমত উল্লা খান এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের অধ্যাপক আবদুল মান্নান। লাইমলাইটে তারা দু’জন। বড় দু’দলের দুই প্রার্থী। জয়-পরাজয়ের হিসাব-নিকাশ তাদেরকে নিয়েই। নীরব ভোটাররা চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন দুই প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতা নিয়ে।
মিলিয়ে দেখছেন প্রার্থীদের অতীত কর্মকা-। গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এবার নির্বাচনে প্রার্থীদের ব্যক্তিগত বিষয়াদি ছাপিয়ে ভোটের ক্ষেত্রে বড় করে দেখা হচ্ছে রাজনীতির বিষয়টি। প্রার্থীদের পাশাপাশি রাজনীতি ফ্যাক্টর হয়ে দেখা দিয়েছে। রাজনীতি ও প্রার্থীদের ব্যক্তিগত আচরণ মিলিয়ে মাইনাস প্লাসের হিসাব কষছেন ভোটাররা।
আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমত উল্লা টঙ্গী পৌরসভার তিন বারের সাবেক মেয়র। টানা সতের বছর তিনি ছিলেন পৌর পিতার আসনে। তার ব্যক্তিগত আচার ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন নেই এলাকায়। সকলের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলেন। মানুষকে কাছে টানার ক্ষমতা আছে তার। এটাই তার সবচেয়ে বড় সম্বল। আওয়ামী লীগের মতো একটি সংগঠিত বড় রাজনৈতিক দলের গাজীপুর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক, তিনি ওই দলের সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী- এটি তার জন্য বড় প্রাপ্তির দিক।
তবে প্রতিকূল পরিবেশে টানা সতের বছর টঙ্গী পৌরসভার মেয়র থাকাকালে অসমাপ্ত ও অর্ধসমাপ্ত রয়ে গেছে পৌরসভার অনেক কাজ। অনেকের চাহিদা পূরণ হয়নি, অনেকে পাননি তার প্রত্যাশিত ফলাফল। এ নিয়ে ধীরে ধীরে কিছু ক্ষোভ জমা হয়েছে সাধারণের মাঝে। নির্বাচনকে সামনে রেখে সে ক্ষোভগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। টঙ্গীর জলাবদ্ধতা এখনও একটি বড় সমস্যা। সতের বছরেও এর কিনারা হয়নি। জলাবদ্ধতা স্পর্শ করে সকল শ্রেণীর নাগরিককে। এখনও বৃষ্টি হলে ভোটারদের স্মরণ করিয়ে দেয় জলাবদ্ধতার কথা। টঙ্গীর জলাবদ্ধতা আজমত উল্লার একটি মাইনাস পয়েন্ট। পৌর মেয়র থাকাকালে টেন্ডারবাজদের নিয়ন্ত্রণে না রাখার প্রভাব পড়ছে তার ওপর। বসতবাড়ির প্ল্যান পাসের বেলায় কমিশনারদের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ করেননি তিনি। এখন সে কথাগুলো উঠতে শুরু করেছে। ঝুট ব্যবসা থেকেও কমিশনাররা পৌরসভার নামে চাঁদাবাজি করেছেন এমন কথা চাউর আছে টঙ্গীতে।
গাজীপুর-২ টঙ্গী-গাজীপুর সদর আসনের এমপি জাহিদ আহসান রাসেলের সঙ্গে এডভোকেট আজমত উল্লার ঠা-া লড়াইয়ের কথা টঙ্গী-গাজীপুরে ওপেন সিক্রেট। এমপি জাহিদ আহসান রাসেল মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লার সঙ্গে দিনরাত কাজ করছেন এটা সত্য তবে এমপির সমর্থকদের নিয়ে নানা গুঞ্জন আছে টঙ্গীতে। এখনও আজমত উল্লার বড় মাইনাস পয়েন্ট জাহাঙ্গীর আলম। তিনি আজমত উল্লাকে সমর্থন দিয়েছেন, তার পক্ষে ভোটও চাইছেন- কিন্তু জাহাঙ্গীর আলমকে যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে সেটা মানতে পারেননি তার সমর্থকরা। তারা এখনও বিক্ষুব্ধ। ওই সব সমর্থক এখনও একাত্ম হতে পারেননি আজমত উল্লার সঙ্গে। আলাপকালে দেখা গেছে জাহাঙ্গীর আলমের সমর্থকদের মধ্যে যে অংশটি সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তারা হয়তো শেষ পর্যন্ত আজমত উল্লাকে ভোট দেবেন কিন্তু তার দলবিহীন সমর্থকরা সেটি না-ও দিতে পারেন। এছাড়া, গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে এক প্রার্থী আরেক প্রার্থীকে সমর্থন দেয়ার পরও প্রার্থীর সমর্থকরা উল্টো কাজ করছে।
জাহাঙ্গীর আলম নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেও ব্যালটে তার প্রতীক কিন্তু থাকছে। অন্যদিকে এখন পর্যন্ত জাহাঙ্গীরের সব সমর্থককে নিয়ে এক জায়গায় বসে কোন আলোচনা না করায় তাদের এলোমেলোভাব থেকেই যাচ্ছে। গাজীপুর নতুন সিটি করপোরেশন টঙ্গী বাদেও নতুন বিশাল এলাকা যোগ হয়েছে এর সঙ্গে। আজমত উল্লা ছিলেন টঙ্গী পৌরসভার মেয়র। নবসৃষ্ট সিটি করপোরেশনের নতুন এলাকার ভোটারদের কাছে তিনি পরিচিত, সেভাবে জানাশোনার মানুষ নন। গাজীপুরের ওই সব স্থানীয় বিষয়াদি ছাড়াও সমপ্রতি চার সিটি করপোরেশন এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশন লাগোয়া কালীগঞ্জ পৌরসভায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর হারের ঢেউ লেগেছে গাজীপুর সিটি করপোরেশনেও। অন্যদিকে বাস্তবতার কারণেই শেষ সময়ে এসে সরকারের জনপ্রিয়তার পারদ নিম্নমুখী থাকে। এ সময় নির্বাচন হওয়াটা আজমত উল্লার জন্য আরেকটি মাইনাস পয়েন্ট। বিএনপি তুলে ধরছে সরকারের নানা ব্যর্থতা এবং হেফাজত ইস্যু। তাদের সঙ্গে মাঠে আছে জামায়াত, জাপা সহ ইসলামী দলগুলো। অন্যদিকে সরকার মহাজোটের শরিক জাপাকেও তাদের সঙ্গে ধরে রাখতে পারেনি। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী এডভোকেট আজমত উল্লার প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে চার সিটি করপোরেশনে হারের পর গাজীপুরে জয়ের জন্য আওয়ামী লীগের সর্বাত্মক তৎপরতা। সেভাবেই তাদের পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। দলে দলে কেন্দ্রীয় নেতারা গাজীপুরে আসতে শুরু করেছেন।
এদিকে বিএনপি সমর্থিত অধ্যাপক এমএ মান্নানের ব্যক্তিগত আচার ব্যবহার নিয়ে ক্ষোভ নেই এলাকাবাসীর। তিনিও ভাল ব্যবহারের মানুষ হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে যে এলাকা নিয়ে সিটি করপোরেশন গঠিত হয়েছে তিনি এই আসনের এমপি ছিলেন, মন্ত্রী হয়েছিলেন। দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে এমপি হয়েছিলেন ১৯৯১ সালে। সে সময়ে গঠিত বিএনপি সরকারের ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। মন্ত্রী থাকাকালে তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ ওঠে, ওই সব কথা এখন নির্বাচনী মাঠে আলোচিত হচ্ছে। ১৯৯৬ সালে তিনি নির্বাচন করে পরাজিত হন। ২০০১ সালে তাকে বাদ দিয়ে গাজীপুর-২ আসনে মনোনয়ন দেয়া হয় জাতীয় পার্টি থেকে আগত নেতা টঙ্গীর হাসানউদ্দিন সরকারকে। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে অধ্যাপক এমএ মান্নান স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন ঘড়ি প্রতীক নিয়ে। নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে হাসানউদ্দিন সরকার ৮৭ হাজার ভোট পেয়ে পরাজিত হন আওয়ামী লীগ প্রার্থী আহসানউল্লাহ মাস্টারের কাছে। অন্যদিকে ঘড়ি প্রতীকে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী এমএ মান্নান পান ৮৫ হাজার ভোট। বিএনপির দুই প্রার্থীর দ্বন্দ্বে সহজে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। সে সময় এমএ মান্নানকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। আহসান উল্লাহ মাস্টার খুন হওয়ার পর উপ-নির্বাচনে আবার প্রার্থী করা হয় অধ্যাপক মান্নানকে।
উপ-নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন আহসানউল্লাহ মাস্টারের ছেলে জাহিদ আহসান রাসেলের কাছে। সে সময় কথা ওঠে হাসানউদ্দিন সরকারের গোপন বিরোধিতার কারণে তিনি হেরেছেন, সেই থেকে হাসান-মান্নানের বিরোধ জিইয়েই ছিল। এখনও এলাকার মানুষ জানে তাদের বিরোধ সদরে মিটলেও অন্তরে রয়ে গেছে। তবে একটি সূত্র জানিয়েছে, আগামীতে গাজীপুর-২ আসনে হাসানউদ্দিন সরকারকে এমপি মনোনয়ন দেয়ার শর্তে তাদের বিরোধের মীমাংসা হয়েছে। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এমএ মান্নানের মাইনাস পয়েন্ট হচ্ছে দীর্ঘদিন এলাকায় কোন যোগাযোগ না রাখা। এছাড়া, জাতীয় সংসদের সর্বশেষ আসন বিন্যাসে তার এলাকা কালিয়াকৈর নির্বাচনী এলাকায় পড়ায় তিনি ওই দিকেই বেশি যোগাযোগ রেখে চলছিলেন। অধ্যাপক এমএ মান্নান সম্পর্কে নেতাকর্মী মহলে প্রচার আছে তিনি অগাধ বিত্তের মালিক হলেও কর্মীদের জন্য তার হাত মোটেও উদার নয়। তার প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে সরকারের শেষ সময়ে নির্বাচন হওয়া, ভোটের মাঠে স্থানীয় নির্বাচনের রূপ ছাপিয়ে জাতীয় ইস্যুতে নির্বাচনী প্রচার হওয়া, স্থানীয় ভাবে জাতীয় পার্টি, হেফাজত সহ ইসলামী দলগুলোর সমর্থন পাওয়া, নিজের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই হিসেবে তার পক্ষে জামায়াতের মাঠে নামা, মরিয়া হয়ে বিএনপি কর্মীদের ভোট প্রার্থনা করা, কালীগঞ্জ পৌরসভা সহ চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ঢেউ এ নির্বাচনে দোলা লাগা, আওয়ামী লীগের জাহাঙ্গীর ইস্যুকে সফল ভাবে কাজে লাগানো।
নতুন সিটি করপোরেশন এলাকা গঠিত হয়েছে টঙ্গী থানা এবং গাজীপুর সদর উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন ও গাজীপুর পৌরসভা নিয়ে। ১০ লাখ ২৬ হাজার ভোটারের মধ্যে পৌনে ৪ লাখ ভোটার টঙ্গীতে, বাকি ভোটার গাজীপুরে। র্নির্বাচনে এলাকার দিক বিবেচিত হলে সুবিধা পাবেন অধ্যাপক মান্নান। নির্বাচনে তার সবচেয়ে বড় প্লাস হচ্ছে দীর্ঘ দিন তিনি ক্ষমতার বাইরে এমপি, মন্ত্রী বা স্থানীয় সরকারেরও কোন দায়িত্বে ছিলেন না। সে কারণে তার সমালোচনাও কম। তবে দলীয় ভোটের ক্ষেত্রে গাজীপুরে আওয়ামী লীগ-বিএনপির খুব বেশি তারতম্য নেই। তবে গত নির্বাচনের ফল ছিল আওয়ামী লীগের পক্ষে
বাংলাদেশ সময়: ১৩:৩১:০৬ ৫১০ বার পঠিত