বঙ্গ-নিউজঃ বেগম রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার অর্ন্তগত পায়রাবন্দ গ্রামে। ১৮৯৮ সালে তাঁর বিয়ে হয় বিহারের ভাগলপুর নিবাসী উর্দুভাষী সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেনের সঙ্গে। তিনি ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, তদুপরি সমাজসচেতন, কুসংস্কারমুক্ত এবং প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন। উদার ও মুক্তমনের অধিকারী স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায় রোকেয়া দেশি-বিদেশি লেখকদের রচনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান এবং ক্রমশ ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। তাঁর সাহিত্যচর্চার সূত্রপাতও ঘটে স্বামীর অনুপ্রেরণায়। তবে রোকেয়ার বিবাহিত জীবন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯০৯ সালের ৩ মে সাখাওয়াৎ হোসেন মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গ রোকেয়া নারীশিক্ষা বিস্তার ও সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর স্বামীর প্রদত্ত অর্থে পাঁচ জন ছাত্রী নিয়ে তিনি ভাগলপুরে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস’ স্কুল স্থাপন করেন। কিন্তু পারিবারিক কারণে রোকেয়া ভাগলপুর ছেড়ে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন। ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ কলকাতার ১৩ নং ওয়ালিউল্লাহ লেনের একটি বাড়িতে মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে তিনি নবপর্যায়ে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৬ সালের মধ্যে ছাত্রীসংখ্যা একশত পেরিয়ে যায়। স্কুল পরিচালনা ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রোকেয়া নিজেকে সাংগঠনিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত রাখেন। ১৯১৬ সালে তিনি মুসলিম বাঙালি নারীদের সংগঠন আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন সভায় তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। ১৯২৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলার নারী শিক্ষা বিষয়ক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। রোকেয়া অলঙ্কারকে দাসত্বের প্রতীক বিবেচনা করেছেন এবং নারীদের অলঙ্কার ত্যাগ করে আত্মসম্মানবোধে উজ্জীবিত হয়ে আর্থরাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে সচেষ্ট হতে আহ্বান জানিয়েছেন।
কোনো ভগ্নী মস্তক উত্তোলন করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন-রূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। … আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্যে পুরুষগণ এই ধর্মগ্রন্থগুলি ইশ্বরের আদেশ বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। … এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন কিছুই নহে। মুনিদের বিধানে যে কথা শুনিতে পান, কোনো স্ত্রী-মুনির বিধানে হয়ত তাঁহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন। … ধর্ম আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর করিয়াছে; ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন।
“
”
— বেগম রোকেয়া, ১৯০৪
পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব। যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জ্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয়, তবে তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে আমরা লেডীকেরাণী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডীমাজিস্ট্রেট, লেডীব্যারিস্টার, লেডীজজ — সবই হইব!… উপার্জ্জন করিব না কেন?… যে পরিশ্রম আমরা “স্বামী”র গৃহকার্য্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসায় করিতে পারিব না?… আমরা বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন করি না বলিয়া তাহা হীনতেজ হইয়াছে। এখন অনুশীলন দ্বারা বুদ্ধিবৃত্তিকে সতেজ করিব। যে বাহুলতা পরিশ্রম না করায় হীনবল হইয়াছে, তাহাকে খাটাইয়া সবল করিলে হয় না? |
” |
—বেগম রোকেয়া, ১৯০৪
|
আমি বিশ্বাস করি– নাটক, গান, নাচ তথা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড মানুষের ভিতরগত পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। আর তাই পাহাড়ের সাধারণ মানুষ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরেও একটি সাংস্কৃতিক দল গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে আমার।’
স্বপ্নের শুরুটা যেখান থেকে ১৯৭১ সাল। তখন ১০ম শ্রেণির ছাত্রী তিনি । বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একঝাঁক তরুণকে নানাভাবে সহায়তা প্রদান করেন। বলতে গেলে– তখন থেকেই বঙ্গবন্ধু তাঁর কাছে এক বিস্ময়কর নেতার নাম। অনুপ্রেরণা ও আদর্শের উৎস। ভাবতে লাগলেন– কী করে তাঁর সান্নিধ্যে থেকে কাজ করা যায়। কিন্তু, আটপৌরে নারী জীবন…! চাইলেই কী সহজে সবকিছু হয়? পাওয়া যায়? করা যায়? বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই হঠাৎ বিয়ে হয়ে যায় তাঁর। প্রচলিত স্বাভাবিক নিয়মেই সন্তান লালন–পালনের গুরুদায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। উপরন্তু, সরকারি চাকরিতে যুক্ত হওয়ায় সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করা আর হয়ে ওঠলো না। মেনে নিলেন বাস্তবতা। কিন্তু, মনে রয়ে গেলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে মানুষের জন্য কিছু করার বাসনা।
১৯৮৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত সরকারি চাকরির পাশাপাশি সবসময় ভিতরে–ভিতরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে মানুষকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছি। ২০১৬ সালে শিক্ষকতা থেকে অবসরগ্রহণের সঙ্গে–সঙ্গে কালবিলম্ব না করে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে কাজ শুরু করি। একের পর এক সভা, সমাবেশ ও উঠান বৈঠকের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের প্রতি সাধারণ মেয়েদের মাঝে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের কথা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করি। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে জেলায় প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার নিজহাতে গড়া সহযোগী সংগঠন যুব মহিলা লীগের জেলাশাখার যাত্রা শুরু হয়। সেখানে আমাকে আহ্বায়ক করে ১১ সদস্যের কমিটি গঠন করেন বাংলাদেশ যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক অপু উকিল ও জেলার নেতারা। তাঁরই নির্দেশে ও সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে মাত্র সাড়ে তিনমাসের মধ্যে জেলার ১০টি উপজেলায় যুব মহিলা লীগের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে সে সময়টা ছিল বেশ অস্থিতিশীল। আওয়ামী নেতা–কর্মীদের ওপর একের পর এক সন্ত্রাসী হামলা হচ্ছিল। তখন এই বিরূপ পরিস্থিতিতে আমি এক মুহূর্তও থেমে থাকিনি…।’
এতোক্ষণ যাঁর কথা বলছিলাম,তিনি রোকেয়া আখতার। নিজের সাংগঠনিক দক্ষতার কারণেই ২০১৮ সালের এপ্রিলে সম্মেলনের মাধ্যমে তাঁকে রাঙামাটি জেলার যুব মহিলা লীগের সভাপতির পদে নির্বাচিত করা হয়। তিনি বলেন, ‘দায়িত্ব পাওয়ার পর আমার দায় আরও বেড়ে যায়। প্রস্তুতি নিতে থাকি জেলার সাধারণ মানুষের বিশেষ করে নারীদের আস্থা অর্জনের। রাঙামাটির ১০ উপজেলায় জনসংযোগ তৈরি করতে আমি নানাধরনের ঝুঁকি সত্ত্বেও নিরলসভাবে কাজ করি। ফলে, তৈরি হয় আমার বিশাল কর্মীবাহিনী। বিশেষ করে– জেলায় নারী ভোটারের সংখ্যা বেড়ে যায় আশাতীতভাবে।
নারীর ক্ষমতায়নের এই সময়ে এসে রোকেয়া আখতারের এই এগিয়ে চলার পথটি একদমই মসৃণ ছিলো না। কর্মজীবনের শুরুতে শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন রোকেয়া আখতার। টানা ৩৫ বছর। ওই পেশাতেও সফল ছিলেন তিনি। একাগ্রচিত্তে প্রতি বছর হাজারো শিক্ষার্থীর মাঝে বিতরণ করেছেন জ্ঞানের আলো। রাজনীতির মাঠেও নিজের অবস্থানকে পোক্ত করেছেন ধীরে–ধীরে।
সবমিলিয়েই– স্বপ্ন তাঁর অনেক বড়। দৃষ্টি তাঁর সামনের দিকে। স্বামীর স্মৃতিচারণ করে বলেন, “আমার স্বামী প্রয়াত আ ব ম আব্দুর রব ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন বীরসেনানী। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর সদস্য হিসেবে ভারতের দেরাদুনে প্রশিক্ষণ শেষে ৯নং সেক্টরের অধীনে থানা কমান্ডার হিসেবে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধে আমি’ বইটি প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। তিনি রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সম্মানিত সদস্যও ছিলেন।”
রোকেয়া আখতার ইতোমধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য মহিলা ও শিশু অধিদপ্তর থেকে জেলা শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা অর্জন করেন। ২০০৪ সালে জেলার ডেপুটি প্রোগ্রাম চিফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সালে জেলার শ্রেষ্ঠ কাবশিক্ষক নির্বাচিত হন। বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণও প্রদান করেন। তাঁর লেখা ও পরিচালনায় জারি গান পরিবেশন করে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিভাগীয় পর্যায়েও বেশকিছু পুরস্কার অর্জন করে। তাঁর গান নিয়মিতভাবেই বাংলাদেশ বেতার, রাঙামাটি কেন্দ্রে প্রচারিত হয়।
তিনি বলেন– ‘বেগম রোকেয়াকে আমি যখন পড়ি তখন শুধু ভাবি– কী যুদ্ধটাই না তিনি করে গেছেন নারীজাতির মুক্তির জন্য, কল্যাণের জন্য। আমি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হই তাঁর লেখা থেকে। আমি বিশ্বাস করি– নাটক, গান, নাচ তথা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড মানুষের ভিতরগত পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। আর তাই পাহাড়ের সাধারণ মানুষ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরেও একটি সাংস্কৃতিক দল গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে আমার।’
মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে রোকেয়া আখতার চান সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসন থেকে সাংসদ হতে। তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পাবে কিনা জানি না, তবে এটা জানি যে– মানুষের জন্য কিছু করার বাসনাই হচ্ছে বড় ইবাদত। এতে তিনি নিশ্চয়ই পিছপা হবেন না।
বাংলাদেশ সময়: ১৬:৩৪:৩১ ১০৯০ বার পঠিত