৮৩তম পর্ব–
ডেমাজানি শাখা ,বগুড়া -৪২ , ”আম নিয়ে বিড়ম্বনা”-৪
বগুড়ায় নিজএলাকায় এসে দুলাল সাহেব ঐ ভদ্রলোক স্যারের বিভিন্ন আমের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বলা তথ্য সমূহ যাচাইয়ের আগ্রহ নিজের মধ্যে খুঁজে পেলেও তার বাসায় আম নিয়ে যাবার আগ্রহ সঙ্গত কারনেই আর খুঁজে পায় নাই। শুধু দুলাল সাহেব কেন বগুড়ার আর কেহই কোন দিন তার বাসায় গিয়েছিল বলে জানা নাই। কারন যাবার আগ্রহীরা হয়তো দুলাল সাহেবের সাথে দেখা করে উনার সব জারিজুরি অবগত হতো।
তবে অজীবন গবেষণা বিমুখ দুলাল সাহেবের এব পর আম নিয়ে গবেষণার একটা ঝোঁক সৃষ্টি হয়। উইলসন মিজনার বলেছিলেন , ” একটি সূত্র থেকে কোন কিছু কপি করলে সেটি হয় নকল, আর একাধিক সূত্র থেকে কপি করলে হয় গবেষণা।”তিনি বিভিন্ন সূত্র থেকে আমের খোঁজ খবর রাখা শুরু করেন এবং রীতিমত একজন আম গবেষক বনে যান। পাশাপাশি ঐ স্যার ভদ্রলোকের কাহিনী বিশেষ করে কোন আমের কি বৈশিষ্ট্য তা সবাইকে বলে বেড়ানো শুরু করেন। আ
বলতে বলতে সব আমের বৈশিষ্ট্য সহ ভদ্রলোকস্যারের পুরা কাহিনী বোধ হয় তার ঠোঁটস্ত হয়ে গিয়েছিল । কেউ জিজ্ঞাসা করলে বা জিজ্ঞাসা না করলেও গড়গড় করে বলে যেত। আর জনে জনে জিজ্ঞাসা করতো ভাল আমের নাম ল্যাংড়া কেন ? আমার যেহেতু আম নিয়ে যৎসামান্য পড়াশোনা ছিল তাই দুলাল সাহেবের কাহিনী মুখস্থ হতে আমার তেমন সময় লাগে নাই। আর রসালো কাহিনী আমার একটু বেশী ভাল লাগে। ভাল লাগার বিষয় মানুষ ভোলে কম। তখন আমে ফরমালিন দেয়া হতো না। কিন্তু দুলাল সাহেব আম নিয়ে সৃষ্ট বিভ্রাটের যে স্মৃতি আমাকে সংক্রামিত করেছিলেন তাতে বোধ হয় ফরমালিন মেখেই দিয়ে ছিল। তার সে স্মৃতিকথা ভুলতে পারিনি এখনও। তবে ভাল আমের নাম ল্যাংড়া কেন ? তার এ প্রশ্নের উত্তর আমি তখন দিতে পারিনি। কারন উত্তর আমি তখন জানতাম না।
এ সব ঘটনার বছর পাঁচেক পরে দুলাল ভাইয়ের সাথে আমার ঘনিষ্ট হবার সুযোগ সৃষ্টি হয় । সে সময় বাদুড়তোলা শাখা বগুড়ার আমি ইনকামিং ম্যানেজার আর উনি আউট গোয়িং। চার্জ হ্যান্ডওভার –টেকওভারের সময় আমরা বেশ ঘনিষ্ট হয়ে পড়ি। বয়সে অনেক সিনিয়র তাই আমি তাকে তখন দুলাল সাহেবের পরিবর্তে দুলাল ভাই বলে ডাকা শুরু করি। বড় মজার রসিক মানুষ তিনি। একটু ঢিলেঢালা কিন্তু ভীষণ কৌতুক প্রিয় ।সর্বোপরি তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। অচিরেই তিনি আমার আমার শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হন। বয়সের পার্থক্য ভুলে আমাদের এ সম্পর্ক দিনে দিনে গভীর বন্ধুত্বে পরিনত হয়।
তখন জৈষ্ট্য মাস শুরু হয়েছে। একদিন বিকেলে চার্জ বুঝে নেবার ফাঁকে এক কাস্টমারের সাথে বসে আম খাবার সময় হঠাৎ উনি আমাকে আবার প্রশ্ন করলেন আচ্ছা ,ভাল আমের নাম ল্যাংড়া কেন ? আমি এবারও বললাম জানিনা। উনি বললেন আপনি তো অনেক খোঁজ খবর রাখেন ,বই- পত্র ঘাঁটেন -পড়েন , পারলে আমাকে এ উত্তর জানাবেন।
আমি বললাম আমের প্রাচীন ইতিহাস জানতে চান আমি বলতে পারবো এমনকি আম নিয়ে ২/১ টা কৌতুকও বলতে পারবো কিন্তু ,ভাল আমের নাম ল্যাংড়া কেন সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না। পাশে বসা কাস্টমার (তিনি নামকরা একজন গানের শিক্ষক ছিলেন ,সবাই তাকে ওস্তাদজী বলে ডাকতেন । নাম সম্ভবতঃ ওস্তাদ খাজা গোলাম মঈন উদ্দীন ) আমের প্রাচীন ইতিহাস আমার কাছে জানতে চাইলেন ।
আমি বলা শুরু করলাম, মোগলরাই প্রথম এদেশে আমবাগানের সূত্রপাত করেন।
আমাকে থমিয়ে দিয়ে ওস্তাদজী বললেন ভ্রমণ কাহিনীর লেখক তার এক ছাত্র কিছুদিন আগে ভারত গিয়েছিলেন। সে নাকি দেখে এসেছে মোগলরা যে আম বাগানের শুরু করেছিলেন ভারতবর্ষে, সেই আম বাগান আজও পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দিল্লির পথে প্রান্তরে নাকি শুধু একটি গাছই বেশী দৃশ্যমান- সেটি হলো আম গাছ। কলকাতাতেও রয়েছে প্রচুর আম গাছ।কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের দিকে যেতে থাকলে পথে পড়বে রানাঘাট, তাহিরপুর ও কৃষ্ণনগর। কৃষ্ণনগর শহর থেকেই চোখে পড়বে সারি সারি আমের বাগান। এর আগেও আমের বাগান আছে। তবে কৃষ্ণনগর থেকে শুরু করে পলাশী, মুর্শিদাবাদ, মালদহ পুরা এলাকা জুড়েই কেবল আমের বাগান।
আমি বললাম , যতদুর জানি মালদহ থেকে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ মাত্র দুই ঘণ্টার পথ। এরপরই রাজশাহী। তার মানে হলো আমাদের রাজশাহী এলাকায় যেসব আম বাগান রয়েছে তার শুরু হয়েছে কিন্তু সেই কৃষ্ণনগর বা মালদহ-মুর্শিদাবাদে। এই পুরো অঞ্চলটাই এখনও আমের বাগানে পূর্ণ ।
গবেষক বনে যাওয়া দুলাল ভাই এবার বললেন, আমের তো আরো প্রাচীন ইতিহাসও আছে। সেগুলোও বলেন। আমি আমার জানার সাথে মিলায়ে দেখি।
আমি বললাম , হ্যাঁ, আরো অনেক পুরাতন ইতিহাস আছে। রামায়ন ও মহাভারতে আম্রকানন শব্দের দেখা মেলে। প্রাচীন সাহিত্যেও আমের উল্লেখ আছে । প্রাচীন কালে মহাকবি কালিদাস কচি আমপাতার মরচে রং দেখে বলেছেন, ‘পার্বতীর ঠোঁটের মতো রং।’
খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭-এ আলেকজান্ডার সিন্ধু উপত্যকায় আম দেখে ও খেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এ সময়ই আম ছড়িয়ে পড়ে মালয় উপদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ ও মাদাগাস্কারে। প্রখ্যাত চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ ৬৩২ থেকে ৬৪৫ সালের মধ্যে এ অঞ্চল এসেছিলেন। এ বিশ্ব পর্যটক বঙ্গভূমিতে এসে এর অনেক কিছুতেই বিস্মিত হয়েছেন। কিন্তু তিনি অন্য কোনো ফলের নয়, এখানকার আমের ভীষন প্রশংসা করেছেন ও বিশ্ববাসীর কাছে এই আমের বিষয় তুলে ধরেছেন।ইংরেজদের আগে পর্তুগিজ আমল থেকে এদেশে শত শত বছর ধরে পশ্চিমারা এসেছেন ।তারা আমাদের আমের প্রশংসা করে বিস্তর লেখালেখি করে গেছেন।পর্তুগিজদের হাত ধরে জাহাজে চেপে আম যায় আমেরিকা ও ব্রাজিলে।সম্রাট বাবর আমকে ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বোৎকৃষ্ট ফল হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।মুগল সাম্রাজ্যে আম শুধুমাত্র রাজ পরিবারের বাগানেই চাষ করার অনুমতি ছিল। পরবর্তীতে সম্রাট শাহজাহান রাজ পরিবারের বাইরে আমের চাষ করার অনুমতি দেন ।
কৌতুক প্রিয় দুলাল ভাই এবার আমার কাছ থেকে আম নিয়ে কৌতুক শুনতে চাইলেন। সে দিন বোধ হয় আমি তাকে দুটি কৌতুক বলেছিলাম-
১. সবাই জানি সম্রাট আকবর বীরবলকে খুব ভালবাসতেন৷ একদিন খেতে বসেছেন তারা । বীরবলের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে । কিন্তু সম্রাট আকবর বীরবলকে আরো বেশী শাহী খানা খেতে বললেন। কিন্তু বীরবল বললেন, পেটে আর জায়গা নেই হুজুর৷ একটু পরে একজন এসে বীরবলের প্লেটে কিছু রসালো আম রাখল৷ বীরবল সাথে সাথে সব আম খেয়ে ফেললো। সম্রাট আকবর খুব রেগে গেলেন।
বীরবল সম্রাটকে বললেন, হুজুর রাস্তায় খুব ভিড় থাকলেও সেই পথ দিয়ে আপনি গেলে সবাই কূর্ণিশ করে সরে গিয়ে আপনাকে জায়গা করে দেন৷ আপনি যে রকম আমাদের রাজা, আমও সে রকম ফলের রাজা৷ আপনাকে যে রকম আমরা রাস্তা ছেড়ে দিই৷ আমার পেটও সেই রকম আমকে দেখে রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে৷ তাই আমি আম খেতে পেরেছি৷
২.কলিকাতা শহরে অমল বাবু প্রত্যহ বাস ধরে কর্মস্থলে যান।প্রতিদিন বাসে উঠে দেখেন প্রতিবন্ধী সিটে কোন না কোন প্রতিবন্ধী বসে আছে। কিন্তু একদিন দেখে প্রতিবন্ধী সিটে একটি বস্তা বসানো আছে। সবাই ভাবছে কেউ হয়তো সিট রেখে দিয়েছে। অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে।
৪/৫ টি স্টপেজ পার হয়ে যাওয়ার পর -বাসে খুব ভিড়। এর মধ্যে আবার দুজন প্রতিবন্ধী উঠেছে। সবাই খুব চেঁচাচ্ছে- কার বস্তা, হটান সিট থেকে, প্রতিবন্ধীকে বসতে দিন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন লোক তখন বলে উঠলো- আমার বস্তা।
অমল বাবু বললেন , আপনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বস্তাটা সিটে রেখেছেন কেন?
লোকটি বললো , সিটটা প্রতিবন্ধীর জন্য। আর বস্তায় আমার আম আছে। আমগুলো সব ল্যাংড়া।
আজ এ সব কৌতুক লেখার সময় মনে হচ্ছে আমাদের রাজশাহী-চাঁপাইয়ের লোকজন অনেক ভাল। তারা ঢাকায় এসে ল্যাংড়া আমের বস্তাকে প্রতিবন্ধী সিটে বসায়ও না আবার ল্যাংড়া আমের জন্য প্রতিবন্ধী ভাতাও দাবী করে না।
কৌতুক পর্ব শেষ হবার সাথে সাথে দুলাল ভাই আবার পুরনো জিগির তুললেন -ভাল আমের নাম ল্যাংড়া কেন ?
আমি দুলাল ভাইকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম,আচ্ছা আম-কাঁঠালের মৌসুম এলেই এত বড় বড় মাছি কোথা থেকে আসে ?
দুলাল ভাই বললেন ,জানি না।
আমি বললাম , আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর জানি না , আপনিও আমার প্রশ্নের উত্তর জানেন না। অতএব উভয় পক্ষ কাটাকাটি। ওস্তাদজীসহ তিনজনই আমরা এবার খুব একচোট হাসলাম।
এর কদিন পর উনি আমাকে চার্জ বুঝে দিয়ে বাদুড়তোলা শাখা থেকে রিলীজ নিয়ে চলে গেলেন। তবে রাস্তা ঘাটে যেখানেই দেখা হতো আমরা দু জন গাল গল্পে মেতে উঠতাম । দিনে দিনে আমরা আরো ঘনিষ্ট হয়ে পড়লাম। আমার যে কোন বিপদে তিনি ছুটে আসতেন। তার ৫০ সি সির ছোট হোন্ডা কোম্পানীর লাল মটর সাইকেলে আমাকে যে কতবার লিফট দিয়েছেন তার ইয়াত্তা নাই। এক সময় তিনি রিটায়ার্ডমেন্টে গেলেন।তার পরেও দেখা হলে হাসতে হাসতে বলতেন ,ভাল আমের নাম ল্যাংড়া কেন ? আমি তার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখিনি । সময় পাইনি। গুরুত্ব দেইনি। কয়েক বছর আগে তিনি গত হয়েছেন। আম নিয়ে এ লেখার ফাঁকে আমি শুধু ল্যাংড়া কেন –ফজলী , হাঁড়িভাঙ্গা এমনকি আম্রপালি আমগুলোর নাম করণের ইতিহাস খুঁজে বের করেছি। ইতিহাস আমার হাতে কিন্তু দুলাল ভাইকে জানানোর আর কোন সুযোগ নাই। আজ আমি আত্মজীবনি লেখার ফাঁকে ফাঁকে প্রসঙ্গক্রমে কত ইতিহাসই না সবাইকে জানাচ্ছি ! হে মহাকাল , তুমি কি পারবে সামান্য আধা যুগ পীছে যেতে , যখন দুলাল ভাই ক্ষণিকের এ জগতে বিদ্যমান ছিল। তাকে আমি ল্যাংড়া আমের সে ইতিহাস জানাতে চাই। ক্ষনিকের জন্য হলেও ফিরে যেতে চাই তার সাথে বগুড়া শহরে কাটানো অতীতের হাসি-খুশী ঝলমলে সোনালী দিনগুলিতে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় কতবার বলে উঠলাম-
কথা কও, কথা কও।
অনাদি অতীত, অনন্ত রাতে
কেন বসে চেয়ে রও?
কথা কও, কথা কও।
কেউ কথা বলেনি। উত্তর মেলেনি। জানি , অনাদি অতীত -মহাকাল কোনকিছুই আর ফিরিয়ে দিতে পারবেনা। সৃষ্টি কর্তা তাকে সে ক্ষমতা দেননি।পুরাতনকে হরণ আর নতুনকে বরণই তার লীলা খেলা।
আমি ইতিহাস লেখার লোভ এই প্রথম সংবরণ করলাম। ল্যাংড়া আমের নামকরণের যে ইতিহাস আমি দুলাল ভাইকে জানাতে পারিনি , তা আমার নিজ হাতে আর কাউকে জানাতে চাই না।(ক্রমশঃ)
বাংলাদেশ সময়: ১২:২৬:৪৯ ৬২০ বার পঠিত #bangla news #bangladeshi News #bd news #bongo-news(বঙ্গ-নিউজ) #জাতীয় #শিরোনাম