৭৭তম পর্ব–
ডেমাজানি শাখা ,বগুড়া -৩৬ , মোহাম্মদ হোসেন স্যার -২
আমাদের ডেমাজানি শাখার মতই মাদলা শাখা করতোয়া নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত। হাইওয়ে ধরে শাখায় আসতে চাইলে নদী পার হবার আগে ও পরে মাইল খানেক করে রাস্তা হাঁটতে হয়। সে সময় ওখানকার ম্যানেজার মহসিন আলী খন্দকার (দুলাল) ভাই। অনেকক্ষণ আগেই সন্ধ্যা গত হয়েছে ,এমডি স্যারের দেখা নাই । আর বোধ হয় এমডি স্যার তার মাদলা শাখায় আসবেন না। মনে হয় এসব ভেবেই দুলাল ভাই শাখা বন্ধ করে নদী পার হয়ে হাইওয়ে রোড়ের দিকে হেঁটে হেঁটে আসছিলেন। অন্যদিকে এমডি স্যার জোনাল হেডকে নিয়ে মাদলা শাখার দিকেই যাচ্ছিলেন। দূর থেকে দুলাল ভাইকে আসতে দেখে জোনাল হেড স্যার প্রমাদ গুনলেন। ম্যানেজার সাহেবের কাছে এসে তিনি ড্রাইভাররকে গাড়ী থামাতে বলে এমডি স্যারকে বললেন, রাত হওয়াতে শাখা বন্ধ করে ম্যানেজার সাহেব বের হয়ে এসেছেন। দুলাল স্যারের দিকে ইঙ্গিত করে জোনাল হেড স্যার বললেন ইনিই ম্যানেজার। দুলাল ভাই সামনের দিকে হাঁটে বটে তবে দু‘পাশে ভয়ানক দোলে। এমডি সাহেব বিষ্ময় আর শে্লষ্মাত্বক কণ্ঠে বললেন, ইনিই ম্যানেজার ? ইনাকে তো অনেকক্ষণ ধরেই আমি হেলে দুলে হেলে দুলে আসতে দেখছি। বেশী অলস হয়ে গেছে মনে হয়। সাথে সাথে পি এ সাহেবকে বললেন নোট করে নেন- ইনাকে পটুয়াখালীতে যেন বদলী করা হয়্। দুলাল ভাই পটুয়াখালীতে বদলীও হলেন। আবার বগুড়াতেও ফিরে আসতেও পারলেন। সেও এক বিশাল কাহিনী। যে কাহিনীর সূত্রপাত রাজশাহীর আমকে নিয়ে । সুযোগ পেলে সে কাহিনী লিখব না হয় এক সময়।
নিশিন্দারা শাখাতে স্যার গিয়েছিলেন পরের দিন। নিশিন্দারা শাখার ম্যানেজার মোঃ নাসির উদ্দিন সাহেব এমডি স্যারকে শোনায়ে শোনায়ে পিওনকে নাকি বলেছিলেন- এই কে আছো ? এই কে আছো ? স্যারের জন্য তাড়াতাড়ি চা-বিস্কুট নিয়ে এসো। এমডি স্যার নাকি এতে রেগে গিয়ে বলেছিলেন- আমি কি আপনার কাছে চা-বিস্কুট খেতে এসেছি ? আবার আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে চা-বিস্কুট এর অর্ডার দেন! উনার ব্যাংকিং কাজ-কর্মও স্যারের নাকি পছন্দ হয় নাই। স্যার পিএ সাহেবকে বললেন- ইনার ভোলায় বদলী । অন্যদিকে এ শাখার মাঠসহকারী মোঃ আব্দুল হান্নান সাহেবকে এম ডি স্যার একটি প্রশ্ন করলে সে নাকি কথার মাঝখানে ” বুঝলেন স্যার? ” ” বুঝলেন স্যার? ”বলেছিল। স্যার এতে ভীষণ রেগে যান। আমি অবশ্য জানি কথার মাঝে ” বুঝলেন স্যার? ‘বলা ঐ এলাকার কথা বলার একটা ঢং। শুনেছিলাম সামান্য দাঁতের ব্যথায় অনেক খেলোয়াড় সেঞ্চুরী করতে পারে নাই , ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে অনেক আন্দোলন পন্ড হয়েছে , এখন দেখলাম আঞ্চলিক কথা বলার ঢং-য়ে কারো কারো কপালও পুড়তে পারে। কথা বলার একটা ঢং ছাড়াও তার আদায় অগ্রগতি ও অন্যান্য কার্যক্রম স্যারের নিকট অত্যন্ত অসন্তোষজনক মনে হওয়াই মুদ্রাদোষেই হোক আর আঞ্চলিক টানেই হোক বারবার ” বুঝলেন স্যার? ” ” বুঝলেন স্যার” বলা মাঠ সহকারীকে সাময়িক বরখাস্থ করা হয়।
পরবর্তীতে গোকুল শাখার (বর্তমানে মহাস্থান গড় শাখা ) পরিদর্শন কালে সেখানকার কাজ-কর্মও স্যারের নিকট অসন্তোষজনক মনে হওয়ায় ম্যানেজার মোঃ আলী নেওয়াজ সাহেবকে সিলেট জেলায় বদলী করেন। শাখার মাঠ সহকারী শ্যামল বাবুকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। শ্যামল বাবুর অন্যতম প্রধান ত্রুটি ছিল উনি কৃষিঋণের আদায়ের তাগাদা পত্র নির্দেশনার চেয়ে অনেক কম বিতরণ করেছিল।
তবে স্যার মুনছুর ভাইয়ের কাজে সন্তষ্ট হয়ে স্যার তাকে প্রশংসাপত্র প্রদান করেছিলেন। এতে প্রমাণিত হয় উনি ভাল কাজের পুরষ্কার দিতেন। মুনছুর ভাই সম্পর্কে তার এককালের সহকর্মী রেজাউল করিম সবুজ সম্প্রতি কিছু তথ্য দিয়েছেন -
”প্রয়াত শ্রদ্ধাভাজন জনাব মোঃ মুনছুর রহমান স্যারের সাথে ১৯৯১ থেকে আমি প্রায় তিন বছর খান্দার শাখায় কাজ করেছি। তিনি একজন কাজ পাগল মানুষ ছিলেন। মোহাম্মদ হোসেন এমডি স্যার তাঁকে ধন্যবাদ পত্র দিয়েছিলেন। সাপ্তাহিক /পাক্ষিক/মাসিক ব্যাল্যন্সিং (ম্যানুয়াল ব্যাংকিং যুগে এ লেজার ব্যালান্সিং এক মহা শ্রমসাধ্য কাজ ছিল। বলা হতো ছাত্র জীবন সুখের জীবন যদি না থাকে এক্জামিনেশন , তেমনি ব্যাংকের জীবন সুখী জীবন যদি না থাকে ব্যালান্সিং । এখন সবকিছু অটোমেটিক ব্যালান্সিং হয় তাই বর্তমান প্রজন্মের ব্যাংকারগণ এ বিষয়টির সাথে পরিচিত নন।) এর দিনে তিনি অফিস টাইমের আগেই অফিস অর্ডার হাতে নিয়ে ব্যাংকের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। কর্মকর্তা কর্মচারীরা ব্যাংকে ঢোকার আগেই তিনি অফিস অর্ডারে সাইন নিয়ে ব্যালান্স বই সবার হাতে ধরিয়ে দিতেন। আগের দিনের জটিং তুলতে বলতেন। অধিকাংশ ব্যালান্স তিনি নিজেই করতেন। জুন ও ডিসেম্বর মাসে তিনি নির্ধারিত সময়ের আগেই ইন্টারেস্ট দিতেন। পরে প্রয়োজনে সংশোধন করতেন।
তাঁর বাবা মারা গেলে তিনি অফিস থেকে যেয়ে জানাযায় অংশগ্রহন করে দাফন শেষে আবার অফিসে ফিরে এসেছিলেন। নন্দীগ্রাম শাখার ম্যানেজার থাকাকালীন তিনি কৃষিঋণ আদায়ের জন্য গ্রামে গ্রামে গিয়ে সেখানকার মসজিদে রাত্রিযাপন করে পরদিন ভোরে খেলাপী ঋণ গ্রহীতাদের ধরে ধরে ঋণ আদায় করতেন।
তার গলব্লাডারে ষ্টোন ধরা পড়লে তিনি বহু বছর অপারেশন করাননি। তিনি অপারেশনকে খুব ভয় পেতেন। অবশেষে ঢাকায় অপারেশন করায়ে ছিলেন। কিন্তু অপারেশনের কয়েকদিন পর ব্যাংকের কোন এক বিষয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে অস্থির অবস্থায় চিৎকার করে উঠেন। এতে তার অপারেশনের জায়গা ফেটে যায়। পুনরায় অপারেশনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কিন্তু তিনি আর অপারেশন করাননি। অপারেশনের জায়গা ফুলে ক্যান্সার হয়ে যায়।
মুনছুর স্যার সিনেমার পোস্টার দেখতে খুব পছন্দ করতেন। সিনেমার হলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিনি পোস্টার দেখতেন। তিনি একটা সিনেমা অল্প অল্প করে দেখতেন (সম্ভবতঃ ব্যাংকের চিন্তায় কোথাও ঠিকমত তিস্টিতে পারতেন না) । একটা সিনেমা দেখার জন্য তিনি কয়েকবার টিকেট কাটতেন।”
তাই মনে হয় নিবেদিত প্রাণ কিন্তু নিতান্ত অখ্যাত অজ পাড়া গাঁয়ের এ প্রচারবিমুখ ব্যাংকারকে প্রশংসাপত্র প্রদান করে তৎকালীন এমডি স্যার সুবিচার প্রতিষ্টা করেছিলেন। অন্যদিকে দুলাল সাহেবকে তিনি আবার বগুড়ায় ফিরিয়ে এনেছিলেন। শাসন করা তারি সাজে সোহাগ করে যে। পরবর্তীতে অন্য দু জন ম্যানেজারকেও আর বগুড়া ছাড়তে হয়নি, অর্ডার মডিফাই হয়েছিল। মাঠ সহকারীদের সাসপেনশন অর্ডারও পরবর্তীতে প্রত্যাহার করা হয়।(ক্রমশঃ)
বাংলাদেশ সময়: ৮:২৮:৪৩ ৫৫৭ বার পঠিত #bangla news #bangladeshi News #bd news #bongo-news(বঙ্গ-নিউজ) #জাতীয় #শিরোনাম