বঙ্গ-নিউজ ডটকম: -আন্টি, বাসা ভাড়া হবে দেখে আসলাম। একটু দেখতে পারি?
-কে থাকবে?
-আমরা কয়েক বান্ধবী থাকব।
-মেয়েরা! না না, আমি মেয়েদের ভাড়া দিই না।
-কিন্তু লিখেছেন তো ব্যাচেলর ভাড়া দেওয়া হয়?
-মেয়েরা আবার ব্যাচেলর হয় নাকি? পড়াশোনা শেষ করেছ। এবার বিয়ে করো।
ঢাকা মহানগরের একজন বাড়ির মালিকের সঙ্গে রুপা ও সাথীর কথোপকথন। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছেন তাঁরা। হল ছাড়ার পর বাসা খোঁজার তিক্ত অভিজ্ঞতার এটা একটা শালীন উদাহরণ। তাঁরা এখন আছেন একটি ছাত্রী হোস্টেলে।
প্রতিবছর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রায় তিন লাখ ছাত্রছাত্রী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে বের হন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বলছে, মোট শিক্ষার্থীর ৪০ ভাগই নারী। তাঁদের একটি বড় অংশ জীবিকার সন্ধানে ও প্রয়োজনে আসেন ঢাকায়, যাঁদের থাকার কোনো জায়গা নেই। রুপা-সাথীদের মতো এই নারীদের ৪০০ বছরের পুরোনো এই নগরে থাকার ব্যবস্থা নিয়ে প্রতিনিয়ত তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান মাহবুবা নাসরীন বলেন, তৈরি পোশাকশিল্পে নারীদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি সমাজ মেনে নিতে পারলেও উচ্চশিক্ষিত নারীদের ব্যাপারে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো নেতিবাচক। তৈরি পোশাকশিল্পে কর্মরত নারীরা দল বেঁধে বাসা ভাড়া করে থাকতে পারছেন; কিন্তু উচ্চশিক্ষিত নারীরা পারছেন না। তিনি বলেন, নারীরা আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পথে এগোচ্ছে, কিন্তু সমাজ এগোচ্ছে না।
নিরাপত্তার অজুহাত, নানা শর্ত আর যন্ত্রণা: নীলক্ষেত স্টাফ কোয়ার্টারের বাসায় কক্ষ ভাড়া দেন আইয়ুব আলী। তিনি বলেন, ‘কোনো নারীকে ভাড়া দিলে অনেক দায়িত্ব নিতে হয়। অভিভাবকেরা বলেন, “মেয়েকে আপনার জিম্মায় দিয়ে গেলাম। দেখে রাখবেন।” দেখে রাখতে গেলে আবার ওই নারী অপমানিত বোধ করেন।’
দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা (নারী) বললেন, ‘একবার একজনকে প্রায় রাজি করিয়ে ফেলেছিলাম। বাড়িওয়ালা আমার ও আমার বাবার জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট চাইলেন। সময়মতো সব হাজির করলাম। শেষ মুহূর্তে ভদ্রলোক বেঁকে বসলেন। বলেন, নিরাপত্তা দেবে কে?’ ওই নারী কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি আমার এত বড় অফিসে এত মানুষের নিরাপত্তা দিতে পারি, অথচ নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে আমাকেই থাকতে দেওয়া হলো না।’
চাকরিজীবী অন্য এক নারী জানান, বাড়ির কর্ত্রী প্রতি মুহূর্তে তাঁকে বুঝিয়ে দেন, তিনি দয়া করে তাঁকে থাকতে দিয়েছেন। রাত আটটার মধ্যে বাসায় ঢুকতে হবে এবং আটটার পরে রান্নাঘরে ঢোকা যাবে না। ইস্ত্রি ও রাইসকুকার চালানো যাবে না। ফ্রিজ রাখলে ভাড়ার সঙ্গে অতিরিক্ত ৩০০ টাকা দিতে হবে। বাইরের কেউ আসতে পারবে না, এমনকি ভাই-বোনও না। এ রকম নানা শর্তের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করেন বাড়ির মালিকেরা।
নারীরা যে শুধু বাড়ির মালিকদের অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন, তা নয়। অভিযোগ রয়েছে পুরুষ তত্ত্বাবধায়কদের বিরুদ্ধেও। গল্পটি বলছিলেন একজন নারী সাংবাদিক। কাহিনিটি এমন-দুর্ব্যবহার সহ্য করতে না পেরে তাঁর এক বন্ধু ওই তত্ত্বাবধায়কের গালে চড় মেরেছিলেন। কিন্তু পুরুষ হয়ে নারীর হাতের চড় একেবারেই মানতে পারেননি ওই তত্ত্বাবধায়ক। তিনি শোধ তোলেন অন্যভাবে। প্রায়ই দেখা যায়, সব বাসায় আলো জ্বলছে, শুধু তাঁর (ওই সাংবাদিক) বাসায় নেই। একই অবস্থা ছিল পানি নিয়েও।
সুযোগ সীমিত: রাজধানীতে কর্মজীবী নারীদের জন্য নীলক্ষেত কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল, মিরপুরে নওয়াব ফয়জুন্নেসা কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল ও খিলগাঁয়ে আছে বেগম রোকেয়া কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল। তিনটিতে মিলে আবাসনের সুযোগ আছে হাজার খানেক নারীর। নীলক্ষেত কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে পাঁচ শ নারীর থাকার ব্যবস্থা আছে। হোস্টেলের সহকারী সুপার শাহানা সুলতানা বলেন, ‘প্রতিদিন কমপক্ষে একজন নতুন মানুষ আসেন একটি আসনের খোঁজে। গড়ে মাসে ৩০টি আবেদনপত্র তো জমা পড়েই, আর খালি হয় ছয়-সাতটা আসন। আমরা যখন আসন বরাদ্দের বৈঠকে বসি, তখন পরোনো আরও ছয়-সাত মাসের তালিকা যুক্ত হয়।’
রাজধানীর ফার্মগেট, মণিপুরিপাড়া, নীলক্ষেত, আজিমপুরের কোথাও কোথাও কর্মজীবী মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা আছে। তবে সেসব বাড়ি বা কক্ষের অবস্থা করুণ। চমত্কার বিজ্ঞাপন দেখে এসব হোস্টেলে গিয়ে অনেকেই চোখের পানি ফেলেন।
এ সমস্যার সমাধান কী? প্রতিনিয়ত কর্মক্ষেত্রে নারীদের যুক্ত হওয়ার হার বাড়ছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো যে লেবার ফোর্স সার্ভে করে, তাতে দেখা যায়, ২০০২-০৩ সালে শ্রমবাজারে নারীর উপস্থিতি ছিল ১০ দশমিক ৩ শতাংশ, সেটি ২০১০ সালে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ২ শতাংশে। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, নারীদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হওয়া দরকার। সেই সঙ্গে দরকার সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে আরও হোস্টেল তৈরি।
বাংলাদেশ সময়: ১১:৪০:৩১ ৪৩৮ বার পঠিত