মৌসুমীর সাথে এইভাবে হঠাৎ দেখা হবে কোনদিনও স্বপ্নেও ভাবেনি তীর্থ। সে ঠিক করেছিল আর কোনদিনও মুখ দেখবে না মৌসুমীর। আসলে তীর্থ তাদের দীর্ঘ ছয় বছরের সম্পর্কের অবসান টা মেনে নিতে পারেনি। মৌসুমী কথা দিয়েছিল, তীর্থ ছাড়া আর কাউকে কোনদিনও বিয়ে করবে না। মৌসুমীর যে বিয়ে ঠিক হয়েছে সেই খবরটা তীর্থ আগেই পেয়েছিল। মৌসুমির হবু স্বামী বিলেত ফেরত ডাক্তার। বিয়ের পর নাকি তারা বিলেতে সংসার পাতাবে। মৌসুমীর বান্ধবীদের মুখে তীর্থ শুনেছিল, বাড়ির চাপে নাকি বিয়ে করতে হচ্ছে মৌসুমীকে। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আবার কারো বিয়ে হয় নাকি। মৌসুমীর ও নিশ্চয়ই মত আছে, তবেই না বিয়ে হচ্ছে। তাহলে কেন তীর্থ কে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সে? খুব কষ্ট হয়েছিল তীর্থর, রাগ হয়েছিল খুব। তাই সে ঠিক করেছিল আর কোনদিন মুখদর্শন করবে না মৌসুমীর। কিন্তু আমাদের ইচ্ছেতেই কি সবটা হয়। মাথার উপর যে সর্বশক্তিমান বসে আছেন, তার লিখনের উপর কি আর আমাদের জোর খাটে। তাই আজ তীর্থ না চাওয়া সত্ত্বেও দেখা হয়েই গেল দুজনের। বিয়ের খবর টা জানলেও বিয়ের দিন টা জানতো না তীর্থ। সেটা জানলে কোনমতেই মৌসুমীর বাড়ির সামনে দিয়ে যেত না আজ সে। এই সেই কালীচরণ ঘোষ রোডের দোতলা বাড়িটা মৌসুমীদের। কত স্মৃতি ঘেরা এই বাড়ি। কত ছোট ছোট গল্প লুকিয়ে রয়েছে এই দোতলা বাড়ির শ্যাওলা জমা রেলিং গুলো কে আঁকড়ে। মৌসুমীর ছিল মর্নিং স্কুল। আর তীর্থর ডে। স্কুল থেকে ফিরে দোতলার ব্যালকনি টাতে দাঁড়িয়ে থাকতো মৌসুমী। আর তীর্থ দুই কিলোমিটার অতিরিক্ত রাস্তা ঘুরে, এই রাস্তাটা দিয়ে স্কুলে যেত, শুধু একবার মৌসুমিকে দেখবে বলে। আজ ওই ব্যালকনির শ্যাওলা ধরা রেলিং গুলো ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। গতকাল ছিল মৌসুমীর বিয়ে। আজ তার বিদায়ের পালা। চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। সারা পাড়া জমা হয়েছে কালীচরণ ঘোষ রোডের এই সরু রাস্তা টা তে। ক্ষণে ক্ষণে কান্নার রোল উঠছে। চোখে জল তো আসবেই, মেয়ের বিদায় বলে কথা। কোনমতে ভিড় ঠেলে ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল তীর্থ। কনের সাজে সেজেছে মৌসুমী। কি অপূর্ব না দেখাচ্ছে তাকে লাল বেনারসি তে। তার ফর্সা মুখখানা যেন কপালের সাদা চন্দনের রং টাকেও হার মানিয়েছে। লাল আলতা পরা পাটা যেন স্বয়ং লক্ষ্মী ঠাকুরের। রূপের আভা ঝরে পড়ছে তার সারা শরীর থেকে। মৌসুমী কে দেখে আর চোখের জল আটকে রাখতে পারলো না তীর্থ। কেঁদে ফেললো সে। কিন্তু মৌসুমী নির্বিকার, কোন প্রতিক্রিয়া নেই তারমধ্যে। তীর্থ একটিবার কথা বলতে চাইলো মৌসুমীর সাথে। কিন্তু মৌসুমী কোন সাড়া দিল না। তীর্থ কে সামনেথেকে দেখেও কি মৌসুমী একবার কাঁদবেনা। একবার কথা বলবে না তার সাথে। সবকিছু ত্যাগ করে আপ্রাণ চেষ্টা করবে না তার কাছে ফিরে যাওয়ার। হয়তো তাই করত মৌসুমী। কিন্তু স্বর্গ রথে শুয়ে থাকা শরীরটার মধ্যে যে আর প্রাণ বাকি নেই। শুধু পড়ে আছে স্পন্দনহীন নিথর দেহটা। গতকাল রাতেই আত্মহত্যা করেছে মৌসুমী। আজ তার বিদায়। কিন্তু গন্তব্য বিলেত নয়। তার গন্তব্য নিমতলা মহাশ্মশান।
বাংলাদেশ সময়: ২:৩৫:৪৩ ১৩৭৮ বার পঠিত # #গল্প