শোন কাল এসো, কাল দেখা হবে শাহবাগে। তখন কথা হবে।এই বলে টেলিফোন শেষ করে রিসাদ।
রাতটা ফাল্গুনের ফুরফুরে হাওয়ার, ঘন আকাশে তারা বুটির একচিলতে চাঁদোয়া টানানো চোখের সামনে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দৃষ্টি সেখানে মেলে দিয়ে নিঃশ্বাসে টেনে নেয় পাশের আমগাছ ভর্তি বোলের সুঘ্রাণ। জীবনে এমন প্রশান্তিময় প্রকৃতির ছোঁয়া ভালোবাসার হাতে রঙিন লাল চুড়ির টুংটাং শব্দ আর সে হাত ধরে হাটা। এই সুখের কোন তুলনা হয় না আর কোন কিছুর সাথে।
রিসাদ ভাবে কাল বর্ণিলকে অনেক ভালোবাসায় ভরিয়ে দিবে। একবারের জন্যও ওর মন খারাপ করতে দিবে না।
মেয়েটা এত্ত বেশী অভিমানি কেন। আলত ফুলের টোকায় জল আসে ওর চোখে। বড়বড় চোখগুলো টলমল করে পদ্মদীঘির মতন। কথা আটকে যায় ঠোঁট ফুলে উঠে প্রস্ফুটিত ফুলের মতন মুখখানা রঙিন হয়ে উঠে মনে হয় মোমের মতন গলে যাবে বুঝি। ঘন চুলের আড়ালে মুখটা লুকিয়ে রাখে নীচু করে ঐ সময়। আর রিসাদের যে কী ভয়ানক অসহ্য লাগে নিজেকে ঠিক রাখতে সে সময় বর্ণিল যদি কখনও বুঝতো। ঐ চোখের জল ঐ থমথমে মেঘ ভরা মুখ রিসাদ কখনও বর্ণিলকে এমন দেখতে চায় না। রিসাদ শুধুই দেখতে চায় বর্ণিলের উচ্ছাস, আনন্দ হাস্যমধুর মুখ। যেমন সে একটা দারুণ বুদ্ধিদিপ্ত টেলেন্টেড মেয়ে। পড়ালেখায় চৌকশ গানে এবং আঁকায়। শুধু রিসাদের সাথে অভিমানে ও কেন একটা মেয়ে হয়ে যায় শুধু। আর ঠিক কোন কারণে এমন আচরণ রিসাদ ধরতে পারে না। এটা কি প্রকৃতি? এমনই কি বৈষম্য নারী পুরুষের। যাই হোক কাল বর্ণিল তোমার মুখে হাসি আর হাসিতে ভরপুর দেখার জন্য আমি রিসাদ জীবন দিয়ে দিব। অনাবীল এক সুখের স্বপ্ন ঘোরে ভালোলাগায় ওর মনপ্রাণ শিহরিত হয়ে উঠে।
ক্লাস শেষ হয় দুপুর বারোটায় শিষ ভাজতে ভাজতে ধীর স্থির হাঁটে রিসাদ শাহবাগের দিকে।
সকাল থেকে একটানা ক্লাস করে বড্ড ক্লান্ত লাগছে। ক্ষিদাও লেগেছে বেশ তবু ও ভাবে আজ বর্ণিলের সাথে এক সাথে খাবে। পথের পাশের দোকান থেকে কিছু লাল কাঁচের চুড়ি কেনে রিসাদ বর্ণিলের হাতে পড়িয়ে দিবে বলে। আজ বর্ণিল শুধু হাসবে ওকে এতোটুকু কষ্ট পেতে দিবে না।
বর্ণিলের ক্লাস নেই আজ ও বলেছে সকালেই চলে আসবে। ভীড়ে গানে শ্লোগানেমুখর মঞ্চ, রাস্তায় ওর সাথে দেখা হয়ে যাবে। আপন মনে হাঁটে রিসাদ। ফুরফুরে বসন্ত হাওয়া বয় ওর হৃদয় শরীর জুড়ে।
গোটা এলাকা কয়েকবার চক্কর দেয়া হয়ে গেলো বর্ণিলের জন্য চার পাশে চোখ খোলা রেখে। খানিক মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে শ্লোগানেও গলা মিলিয়েছে। ছেলেরা জোড় করছিল আবৃত্তি করার জন্য। রিসাদ পরে বলে কাটিয়ে এসছে। সময় কেটে গেছে বেশ অনেকক্ষন কতটা ঠিক হিসাব নাই। রিসাদ হাতে ঘড়ি পরতে পছন্দ করে না।্ তবে ক্ষিদায় পেটের ভিতর বেশ ব্যাথা করছে তাই বুঝতে পারছে সময় দুপুর গড়িয়ে গেছে। বর্ণিল কোথায়, ও কি দেখতে পাচ্ছে না আমাকে। আমিও কোথাও দেখা পেলাম না। এবার মোবাইলটা বের করে খোঁজ নিতেই হয়। যদিও ইচ্ছেটা ছিল ফোন না করে হঠাৎ ঘুরতে ঘুরতে দেখা পাওয়ার। রিসাদের মনে হলো সে আশাটা পুরণ হলো না আজ।
ভীড় শ্লোগানের পাশ কাটিয়ে ও মার্কেটের দিকে এগিয়ে যায়। এ সময় রাস্তার অন্যপাশে যুথিকে আসতে দেখে আরো কয়েকজন ছেলে মেয়ের সাথে। রিসাদ ওকে এড়িয়ে চলে যেতে চায় । এই মেয়েটা সব সময় কেমন করে যে রিসাদের ভালোলাগার মুহুর্তে চলে আসে। আজ এই মুহুর্তে এই বকবক করা মেয়েটার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না রিসাদের।
কিন্তু যুথি চিৎকার করে ডাকে রিসাদকে । এই রিসাদ………..রিসাদ……সবাই মিলে ওরা এগিয়ে আসে রিসাদের কাছে।
যুথি অস্থির হাত পা নাড়িয়ে বলে তুই কি করছিস এখানে? বর্ণিলের বাসায় যাসনি এখনও?
বিরক্তির ভাব এক মুহুর্তে উবে যায়, ভয় আর শংকা জাগে অজানায় গলা কেঁপে যায় যেন অস্থিরতায়। কেন কি হয়েছে বর্ণিলের বাসায় যাব কেন?
আমরা যাচ্ছি সকালেই খবরটা শুনেছি এখন অস্থির লাগছে তাই ওদের বাসায় যাচ্ছি এখন।
কি হয়েছে আমি তো কিছুই জানিনা। বুকের ভিতর শক্ত হয়ে আসা একটা কপাট দূরে সরাতে সরাতে কোন রকমে জানতে চায় রিসাদ।
বর্ণিলের ভাই বৈশাখ কে কাল রাত থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। তুই শুনিস নাই অবাক হয়ে যুথি জানতে চায় ।
না আমি বর্ণিলের এখানে আসার অপেক্ষা করছিলাম কাল রাতে দশটায় শেষ কথা হলো ওর সাথে।
আমি ফোন করে ছিলাম সাড়ে এগারটায়। বৈশাখ ভাই তখনও না ফেরায় ওরা চিন্তা করছিল।
এখন তো সবাই বেশ দেরী করে বাসায় ফিরে অথবা ফিরেও না কখনও। বাসার লোকজন থাকে চিন্তায় তাই ফোনে যোগাযোগ রাখে সারাক্ষণ। বৈশাখ ভাই বলেছিল বাসায় যাচ্ছে কিন্তু সারা রাতেও বাসায় ফিরেনি। আমি কা¬স করে ফোন করলাম এখনও কোন খবর পায়নি ওরা সবাই অনেক চিন্তায় আছে। আমার খুব অস্থির লাগছেরে । তাই ওদের বাসায় চলে যাচ্ছি। বর্ণিল খুব কাঁদছিল।
এক নিঃশ্বাসে যুথি বলে যায়। রিসাদের বুকের ভিতর যেন এক পাথর বড় হতে থাকে। ও কিছু বলতে পারে না।
ক্ষিদায় পেটের ব্যাথা আর বুকের ব্যাথা মিলে এক প্রচ- যন্ত্রনা ওর গলার দিকে ঠেলতে থাকে। চারপাশ কেমন শূন্য মনে হয়।
যুথি তাগদা দিয়ে জানতে চায় তুই যাবি রিসাদ?
রিসাদ কোন কথা বলতে পারে না। ও ওদের সাথে হাঁটতে থাকে দ্রুত।
সময়টা এমন একজন যুবকের রাতে বাড়ি না ফেরা হয়ে উঠে হারিয়ে যাওয়া। বৈশাখ ভাইয়া কি দূর্দান্ত বুদ্ধিমত্তা সম্পন্য একটি ছেলে। কি যুক্তিপূর্ণ তার কথা বলা। এক একটা যুক্তি যেন এক একটি বুলেট। প্রকৌশলি হয়েছে কেবল। আমেরিকা যাওয়ার কথা অল্প কিছু দিনের মধ্যে। আর তার প্রেমিকা বীথি কি অপূর্ব মিষ্টি একটি মেয়ে।অদ্ভুত সুন্দর সম্পর্ক ওদের দুজনের মধ্যে।
কিছুদিন আগে একজন ব্লগার কে খুন করেছে নির্মমভাবে। দুজনকে মারাত্মক ভাবে আহত করেছে। অনেককে হত্যার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। আন্দোলন শাহবাগের এই গণ জাগরণে, মারাত্মক হিং¯্র হয়ে উঠেছে রাজাকারের সমর্থক জামাতে ইসলামী দল। ইসলামের কথা বলে ওরা এমন মিথ্যা কথা এবং কাজ কী ভাবে করতে পারে বোধগম্য হয় না রিসাদের। শুধু এ টুকু বোঝে এরা অসম্ভব খারাপ মানুষ। রিসাদ নিয়মিত নামাজ পড়ে না। মসজিদে যায় না। কিন্তু ওর খুব ভয় হয় এক ধরনের পবিত্রতা কাজ করে ধর্মের জন্য। মিথ্যাকথা বলা বা খারাপ অনৈতিক কাজ করতে পারে না। ধর্মের বিষয়গুলো মনের খুব গভীরে ভালোবাসায় লালন করে।
যদি কিছু হয় বৈশাখ ভাইয়ার কি হবে এমন সুন্দর একটা পরিবারে ভেবে অস্থির হয়ে ওঠে রিসাদ।
ভাবনাগুলো ওর ভিতর চাপ সৃষ্টি করছে ভয়ানক রকম। মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠল। পরেই যেতো পাশে থেকে শামিম ধরে ফেলে রিসাদ কে।
শাহবাগের ভীড় ছড়িয়ে বাইরে চলে এসেছে ওরা শামিমের গাড়ি ছিল ওরা তাতে চড়ে বসল। যুথি বলল তোর কি শরীর বেশী খারাপ লাগছে?
তা লাগছে একটু সব কিছু মিলিয়ে খারাপ লাগাটা মন থেকে শরীরে ভীড় করছে। জানিস আমি অপেক্ষা করছিলাম বর্ণিলের আসার জন্য।
ফোন করিস নি
না কাল রাতে কথা হলো
আর সকাল থেকে ক্লাস নিয়ে ব্যাস্ত ছিলাম ভাবলাম ওতো আসেবেই ঘণ্টাখানেক আমি অপেক্ষা করছিলাম ওর জন্য।
আমি কাল রাতেই শুনেছি রাতে ফোন করেছিলাম আজ এখানে আসার জন্য। তখন জানাল ভাইয়ার জন্য টেনসন করছে তখনও ফেরেনি।
রিসাদ জানায়, আমার সাথে কাল রাতে নয়টায় শেষ দেখা হলো। আমি চলে যাওয়ার আগে উনার সাথেই ছিলাম সন্ধ্যা থেকে। উনি অবশ্য বলেননি বাড়ি যাবেন এমন কিছু। গত তিনদিন ধরে একটানা এখানে পরে আছেন।
ওরা বর্ণিলদের বাসায় পৌঁছে গেল। অনেক লোকজন এসেছেন বাড়িতে, আত্বিয়, প্রতিবেশী, বন্ধু, পরিচিত কিন্তু সবাই চুপচাপ। কোন খবর পাওয়া যায় নাই এখন পর্যন্ত। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে আছে চারপাশে।
প্রতিটি মানুষের মুখ গম্ভীর। এতো মানুষের ভীড়ে বর্ণিলকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
যুথি বলল চল ওর ঘরে যাই। ওর ঘরে বিছানার উপর বর্ণিল বসে আছে। মুখটা ঘিরে আছে ওড়নায়, মেঘ থমথম মুখ জল ভরা চোখ। আজ এক উচ্ছাসিত বর্ণিলের মুখ দেখার আশাছিল হাতটা টেনে নিয়ে পড়িয়ে দিতে চেয়েছিল লাল কাঁচের চুড়ি ব্যাগের পেটে পরে আছে টুংটাং শব্দে। অথচ টুংটাং জলতরঙ্গ হাসিতে গড়িয়ে যাওয়ার কথা ছিল বর্নিলের। ওর দিকে তাকিয়ে দুচোখ ভরে উঠছে জলে রিসাদেরও।
ওরা কি কথা বলবে? রিসাদ ওর পাশে বসে বর্ণিলের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে রাখল। বর্ণিল রিসাদের কাধে মাথা রেখে ফুপিয়ে উঠল।
যুথি, শামিম, রনি, রেবেকা, ইমতিয়াজ রিসাদ সবার মনমরা অবস্থা চোখ জোড়া জল
খানিক পরে একটা গুঞ্জরণ উঠল। টিভিতে খবরে বলছে পুলিশ একটি লাশ উদ্ধার করেছে। একজন যুবকের তার মাথাটি দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন।
ফোন বজে উঠল ফোনটা এসেছে থানা থেকে। কাউকে গিয়ে লাশটি তাদের পরিচিত কেউ কিনা শনাক্ত করতে বলা হচ্ছে।
একটা চিৎকার দিয়ে বর্ণিলের মা অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
বাড়িতে একটা কান্নার রোল উঠল যে যেখানে ছিলেন সেই অবস্থায় চেপে রাখা কান্নায় ডুকরে উঠল। বর্ণিলদের আনন্দময় বাড়িটায় কান্না বিষাদে গুমড়ে উঠল।
রিসাদ বারান্দায় একটা বেতের চেয়ারে বসে আছে আকাশে বুটিবুটি তারার সাথে একচিলতে চাঁদের আলো ওর পায়ের কাছে লুটিয়ে আছে। আমের বোলের ঘ্রাণে ফাল্গুনের মৌমৌ সৌরভ ফুরফুরে হাওয়া কিছুই তাকে আকৃষ্ট করছে না। ওর হাতে এক গুচ্ছো কাঁচের চুড়ি টুংটাং শব্দ তুলছে আর রেকর্ড প্লেয়ারে বৈশাখ ভাইয়ের বাজানো গিটারের সুর বাজছে ওর সব মনোযোগ সেখানে নিবিষ্ট হয়ে আছে।চোখে থমথমে গম্ভীর বর্ণিলের মেঘভাড় মুখ কি ভাবে এই মুখে হাসি ফুটবে আর কোনদিন।
বাংলাদেশ সময়: ১৩:৩৮:৩৯ ৭১৮ বার পঠিত