বঙ্গ-নিউজঃ রপ্তানি বিলের মাধ্যমে জনতা ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা পাচার ও আত্মসাতের ঘটনায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। ক্রিসেন্ট গ্রুপের মালিকেরা এবং জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তারাই থাকছেন আসামির তালিকায়।
বিষয়টি নিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং দুর্নীতি দমন কমিশন আলাদা অনুসন্ধান করেছে। শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই তাদের অনুসন্ধান শেষে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অনুমোদনের জন্য প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। দুদকের অনুসন্ধানও শেষ হয়ে কমিশনের অনুমোদনের অপেক্ষায়। অনুমোদন পাওয়ার পর দুটি সংস্থাই মামলা করবে।
সূত্র জানিয়েছে, শুল্ক গোয়েন্দার অনুসন্ধানে পাচারের সঙ্গে ক্রিসেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ কাদের, পরিচালক সুলতানা বেগম এবং রিমেক্স ফুটওয়্যারের চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক লিটুন জাহান মীরার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তবে দুদকের অনুসন্ধানে ওই চারজনের পাশাপাশি ক্রিসেন্ট লেদারের পরিচালক রেজিয়া বেগম ও লেসকো লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. জাকারিয়াকে আসামি করার কথা বলা হয়েছে।
দুদক জনতা ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে তাঁরা হলেন উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মো. রেজাউল করিম (বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের ডিএমডি), ডিজিএম মুহাম্মদ ইকবাল, এ কে এম আসাদুজ্জামান ও কাজী রইস উদ্দিন আহমেদ, এজিএম মো. আতাউর রহমান সরকার, এসপিও মো. খায়রুল আমিন, মো. মাগরেব আলী, অফিসার ইনচার্জ (এক্সপোর্ট) মোহাম্মদ রুহুল আমিন, সিনিয়র অফিসার ইনচার্জ মো. সাইদুজ্জামান, মো. মনিরুজ্জামান ও মো. আবদুল্লাহ আল মামুন।
তবে শুল্ক গোয়েন্দার অনুসন্ধানে আরও দুজন ব্যাংকারের নাম এসেছে। তাঁদের নামেও মামলার সুপারিশ করা হয়েছে। এঁরা হলেন জনতা ব্যাংকের তৎকালীন দুই জিএম মো. ফখরুল আলম (বর্তমানে কৃষি ব্যাংকের ডিএমডি) ও মো. জাকির হোসেন (বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের ডিএমডি)।
অনুসন্ধান সূত্রগুলো বলছে, বিলের মাধ্যমে বিদেশে পণ্য সরবরাহ করে সে অর্থ ফেরত আনেনি ক্রিসেন্ট গ্রুপ। কাগজে-কলমে তারা চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করেছে হংকং ও ব্যাংককে। সেই রপ্তানি বিল কিনে গ্রুপটিকে নগদে টাকা দিয়েছে ব্যাংক। এখন রপ্তানির টাকা ফেরত আসছে না। ব্যাংক চাপ দেওয়ায় মাঝেমধ্যে কিছু অর্থ এসেছে দুবাই থেকে। যদিও আমদানিকারক দেশ থেকেই টাকা আসার কথা। এর আগে তদন্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, সরকার থেকে নেওয়া নগদ সহায়তার টাকা দুবাই ও যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করেছে গ্রুপটি।
গ্রুপটির রপ্তানির ৬৫৩টি বিলের টাকা দেশে ফেরত আসেনি। এর মূল্যমান বাংলাদেশি টাকায় ১ হাজার ৩০৩ কোটি ৬৯ লাখ। এসব রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশই কিনেছে হংকং ও থাইল্যান্ডের ৯টি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় আছেন বাংলাদেশিরা। আবার পণ্য হংকংয়ে পাঠানো হলেও রপ্তানি বিল পাঠানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমদানি করা এসব প্রতিষ্ঠান ভুয়া। রপ্তানি ভর্তুকির টাকা অবৈধ উপায়ে যুক্তরাষ্ট্র ও দুবাইয়ে নিয়ে ফেরত এনেছে ক্রিসেন্ট গ্রুপ।
দুদক ও শুল্ক গোয়েন্দার অনুসন্ধান প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, দুটি সংস্থাই ব্যাংকের কাছ থেকে নানা নথিপত্র সংগ্রহ করেছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই ও পর্যালোচনা করে অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে জালিয়াতির পরপরই বাংলাদেশ ব্যাংকের করা তদন্ত প্রতিবেদনের বেশির ভাগ তথ্য মিলে গেছে। প্রাথমিক প্রতিবেদনে মাঠপর্যায়ের যেসব কর্মকর্তার দায়ের কথা বলা হয়েছে, তাঁদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে ব্যাংকে শীর্ষ পর্যায়ের নির্বাহী, পরিচালনা পর্ষদের কাউকে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, মামলার পর তদন্ত পর্যায়ে তাঁদের সংশ্লিষ্টতা ও দায়ের বিষয়ে খতিয়ে দেখা হবে।
এদিকে একই বিষয়ে দুটি সংস্থার অনুসন্ধান নিয়েও কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছে দুটি সংস্থাই। দুই সংস্থার মধ্যে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ চলছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। এ নিয়ে শেষ পর্যন্ত জটিলতা তৈরি হয় কি না, তা নিয়েও তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
দুদকের হয়ে অনুসন্ধান করেছে সহকারী পরিচালক গুলশান অনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বে একটি দল। তারা এ ঘটনায় অর্থ আত্মসাৎ, প্রতারণা, জাল কাগজপত্র তৈরি করে জালিয়াতি, পরস্পর যোগসাজশ, প্রতারণায় সহায়তা, ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ আনছে। পাশাপাশি অর্থ পাচার আইনের দুটি ধারায় মামলা হবে।
শুল্ক গোয়েন্দা মামলা করবে অর্থ পাচার আইনে। সংস্থার অতিরিক্ত মহাপরিচালক আবদুল হাকিমের নেতৃত্বে একটি দল বিষয়টির অনুসন্ধান করে।
দুদক সূত্র বলছে, ক্রিসেন্ট গ্রুপের ঘটনাটিতে জাল-জালিয়াতির আশ্রয়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততায় জনতা ব্যাংকের টাকা পাচার এবং আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে জালিয়াতি এবং পরের পর্যায়ে অর্থ পাচার হয়েছে। তাই দুদক ছাড়া অন্য সংস্থার এ বিষয়ে মামলা করার আইনি ভিত্তি নেই।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) সহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে এক বছর আগে থেকে অনুসন্ধান চলছে। যেহেতু বিষয়টি অর্থ পাচার–সংক্রান্ত, সে কারণে শুল্ক গোয়েন্দার এখতিয়ার আছে বিষয়টি নিয়ে কাজ করার।
বাংলাদেশ সময়: ৭:০১:৪৪ ৫৫৮ বার পঠিত