৬৬ তম পর্ব–
ডেমাজানি শাখা ,বগুড়া -২৫ -অপূর্ব ভোজন -৬।
বেলা অনেকদুর গড়িয়ে গেছে। স্যার রফিকের দিকে তাকিয়ে বললেন- আর কোন কথা নয়- উঠি। তবে আমরা সহজে কেউ উঠতে পারছিলাম না। শরীর কেমন যেন ভার ভার লাগছিল। ঘরের মাঝখানে পাতা চৌকিতে বসে আমরা খাচ্ছিলাম। স্যার চৌকির মাঝখানে হাঁটু ভাঁজ করে বৈঠকি ঢংয়ে বসেছিলেন। স্যারের দুপাশে আমরা। রফিক অবশ্য একটু কাত হয়ে চেয়ারের মত করে দু পা ঝুলিয়ে বসেছিল। পিছন দিয়ে হেঁটে এসে আমার কানে কানে কথা বলার সময় ছাড়াও সে দু এবার উঠেছে। আমাকেও উঠতে হয়েছে। স্যার কিন্তু এ দীর্ঘ সময়ে একটুও নড়াচড়া করতে পারে নাই। তাই আমরা পারলেও স্যার উঠতে পারছিলেন না। রফিক তার হাতটা এগিয়ে দিল , স্যার রফিকের হাত ধরে ওঠার উদ্যোগ নিল। এমন সময় মুরুব্বী বললেন উডবেন না , উডবেন না, কলা খাওয়া লাগবি। পাকা কলা। দেখলাম এক কাঁদি গাছ পাকা কলা হাজির। অধিকাংশই পেকে গেছে তবে নীচের দিকের ছড়ি কাঁচা আছে। রফিক তাড়াতাড়ি বললো কলার কাঁদি সে তার সাইকেলে করে নিয়ে যাবে। কাল অফিসে খাওয়াবে। বাঁচা গেল। এতক্ষণে রফিককে একটু দুরদর্শী মনে হলো। মুরুব্বী ডিমগুলি দেখিয়ে খাবার ইঙ্গিত করতেই সে একটা বাটিতে হাঁসের আর মুরগীর ডিম গুলোও নিয়ে নিল। বললো বাটি লোক মারফৎ পরে ফেরৎ দিবে। তার মধ্যে একটা অলরাউন্ডার অলরাইন্ডার ভাব এসে গেছে –দেখলাম। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সামনে রাখা বড় গামছার তিন জন তিন প্রান্ত দিয়ে হাত মুখ মুছতে লাগলাম।
হঠাৎ নজরে পড়লো মুরুব্বী তার ছেলে ও জামাইয়ের সাথে কি যেন শলা-পরামর্শ করছে। পরামর্শ শেষে মুরুব্বী স্যারের সামনে হাত জোড় করে বললো “আজ আর যাওয়া হবে না বাবা । এখানে আপনাদের অ্যাতে চারডা ডাল-ভাত খাইয়ি আজকের অ্যাত থাকা লাগবি”। তার কথা শেষ না হতেই আমাদের জুতা-স্যান্ডেল গুলি ছোট ছেলে হাতে করে ভিতরে নিয়ে গেল। তীরে এসে তরী ডুবে গেল । ফেরার পথ রুদ্ধ হয়ে গেল।
সবাই তাজ্জব বনে গেলাম। তাজ্জব বনে গেলে মানুষের চেহারা কেমন হয় তা আজ এখন স্মরণ করতে পারছি না। সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে থাকা মুরুব্বীর নিকট তাজ্জব বনে যাওয়া স্যার হাতজোড় করে মাফ চাওয়া শুরু করলেন । দু জনের হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থেকে স্বস্ব পক্ষে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে যুক্তি –তর্ক উপস্থাপনের দৃশ্য আজো ভুলতে পারি না। বেশ কয়েক মিনিট এভাবেই কেটে গেল। বুঝলাম স্যারের হাতজোড় করার পদ্ধতির কার্যকারীতা এখানে নেই। আমি রফিককে ইঙ্গিত করলাম ছেলে ও জামাইদের ম্যানেজ করে জুতা-স্যান্ডেল গুলি ফেরৎ আনার ব্যবস্থা করতে। রফিক তাদের নিয়ে বাহিরে গিয়ে বোঝাতে শুরু করলো। আমার ভয়টা যতটা রাতে থাকা নিয়ে তার চেয়ে বেশী ঐ যে অ্যাতে মানে রাতে খাবার দাওয়াত দিল তা নিয়ে। এরকম অপূর্ব আয়োজনের খাবারের ভাগ্য এ জগতে আমাদের জীবনে দুইবার ঘটুক সে মূহুর্তে আমরা কেহ তা মানতে রাজী না।
খেলাপী কৃষিঋণ গ্রহীতার নিকট যে ভাবে ঋণের টাকা ফেরৎ চাওয়া হয় দেখলাম রফিক সেভাবে মুরুব্বীর ছেলে –জামাইয়ের কাছে জুতা-স্যান্ডেল ফেরৎ চাচ্ছে। ইলেকশনের আগে এ এলাকার প্রার্থীরা যে ভাবে অঙ্গীকার করতো সেভাবে নিরুপায় রফিকও অঙ্গীকার করছে আবার একদিন আসবে। বিলম্ব হলেও রফিকের কৌশল শেষ পর্যন্ত কাজে আসলো । অবশেষে জুতা-স্যান্ডেল ফেরৎ পাওয়া গেল। আমরা সেগুলি পায়ে পরে নিয়ে বিদায়ের জন্য প্রস্তুত হলাম।
বিদায় বেলা আমরা যে কিছুই খাইনি এবং তারাও যে কিছু খাওয়াতে পারে নাই- মুরুব্বী তার তিন ছেলে ও জামাই মিলে এ কথা মনে হয় হাজার বার বললো। জামাইয়ের সন্দেহ হলো রান্না বোধ হয় ভাল হয় নাই। খাবার ব্যাপারে আমাদের এহেন সীমাবদ্ধতা তাদের যে ক্ষুব্ধ করেছে তা আমরা পরিস্কার বুঝতে পারলাম। আমাদের মুখে কোন ভাষা নাই। ধন্যবাদটা যে জানাবো সে শক্তি ও প্রবৃত্তিও অবশিষ্ট নাই। শুধু হাত মিলায়ে সালাম বিনিময় করে সবাইকে ব্যাংকে হিসাব খোলার আমন্ত্রণ জানিয়ে বিদায় নিলাম। রফিক জানালো সন্ধ্যার পর এ রাস্তা আর নিরাপদ নয়। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। আমি রফিককে অনুযোগের সুরে বললাম –দাওয়াত গ্রহনের সময় সে এ সব কথা বললে ভাল হতো। এত ভরা পেটে নড়াচড়াতেই যে কষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রফিক একটা অজুহাত খাড়া করে আমার কানে কানে ফিসফিসিয়ে নির্বোধের মত বলে বসলো –আমাদের নাকি একটা ভুল হয়ে গেছে। শার্টের নীচে সবাই একটা করে ব্যাগ বেঁধে নিয়ে দাওয়াত খেতে আসলে সব খাবার সেখানে রাখা যেত । কেউ টেরও পেত না। সবাই সন্তষ্ট থাকতো। বেকুফ কি গাছে ধরে , মানুষই বেকুফ হয়-মনকে প্রবোধ দিলাম আমি । ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষায় কোমরে বই বেঁধে নিয়ে গিয়ে রফিক কিভাবে বিপাকে পড়েছিল সে কাহিনী কে যেন আমাকে বলেছিল । সে কাহিনী এ সময় আমার বারবার মনে পড়তে লাগলো। অন্যদিকে শার্টের নীচে ব্যাগ বেঁধে সেখানে খাবার ফেলার বিষয়ে রফিকের কল্পিত চিত্রনাট্য আমি বাস্তবে কল্পনা করলাম । ঝোল ও মিস্টিসহ পেট- বুকের কাছে ব্যাগে খাবার রাখা! গা ঘিনঘিন করতে লাগলো। মনে হলো গোসল করলে আরাম পেতাম। সে জন্যই কিনা জানি না –আমার বমি বমি লাগা শুরু হলো। অস্বস্তিসহই ব্যাংকের দিকে রওনা দিলাম। রাস্তায় একবার মনে হলো শেখ-সাদী পকেটে যে খাবারগুলো রেখেছিলেন সে গুলো হয় ফলমূল না হয় শুকনা খাবার ছিল।
ব্যাংকে এসে রফিক সবাইকে ডিমগুলো খেতে বললো। প্রায় সবাই সাথে সাথে ছোট ছোট মুরগীর ডিম খেল।রফিকও খেল । স্যার বিরত থাকলেন । হাঁসের ডিমগুলি অবহেলায় পড়ে থাকলো। একটা হাঁসের ডিম খাবার জন্য রফিক আমাকে প্ররোচিত করতে লাগলো। হঠাৎ ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্তের একটা কবিতা মনে পড়ে গেল-
ঘৃণায় যে নাহি খায় এ হাঁসের ডিম ।
মরুক সে না খেয়ে তেতো নিম ।।
বৃথাই রসনা তার বৃথা তার মুখ ।
কোন কালে নাহি পায় আহারের সুখ ।।
এখানেও সবাই পিড়াপীড়ি শুরু করলো। সবার পিড়াপীড়িতে আমি হাঁসের ডিম খেতে রাজী হলাম। রফিক স্যারকেও ভীষণ পিড়াপীড়ি করলো । স্যারও কেন জানি না খেতে রাজী হলেন ।
তিন নেড়ে একই দিনে দুইবার বেলতলায় গেল । (ক্রমশঃ)
বাংলাদেশ সময়: ২২:৩৩:৩২ ৬০১ বার পঠিত #bangla news #bangladeshi News #bd news #bongo-news(বঙ্গ-নিউজ) #জাতীয় #শিরোনাম