বঙ্গ-নিউজঃ একসময় শীত এলেই পরিযায়ী পাখির কলরবে মুখর হতো নাসিরনগরের মেদীর হাওর। পাখির অভয়াশ্রম হিসেবেই লোকমুখে পরিচিত ছিল এ হাওর। ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখির আগমনে মৌসুমি বিনোদন পেত স্থানীয়রা। পাখির কলতান উপভোগ করতে দূর-দূরান্ত থেকেও আসতেন পাখিপ্রেমী মানুষ। বছর ঘুরে এখন শীত আসে ঠিকই; কিন্তু আগের মতো আসে না অতিথি পাখি। শুধু নাসিরনগরই নয়, চার-পাঁচ বছর ধরে সব হাওরেই কমে গেছে পরিযায়ী পাখির আনাগোনা।
পাখি বিশেষজ্ঞ ও সংশ্নিষ্টরা বলছেন, পাখির আবাসস্থল ধ্বংস, খাদ্য সংকট ও জমিতে কীটনাশক প্রয়োগের ফলে দিন দিন পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমছে। পাশাপাশি হাওরে নতুন নতুন চর পড়ায় হাওর হারিয়েছে তার স্বাভাবিক পরিবেশ। উপরন্তু, মাছ কমে যাওয়ায় পাখির আনাগোনাও কমে গেছে। এ ছাড়া হাওরসহ আশপাশে পাখির আবাসস্থল তৈরিতে স্থানীয় বা সরকারিভাবে কোনো কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় হাওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে অতিথি পাখিরা।
তাদের অভিমত, হাওরের স্যাঁতসেঁতে কাদাপানিতে ছোট মাছ, শামুকসহ পাখিদের প্রাকৃতিক খাবারের নানা উৎস থাকায় সেখানে প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণে বালিহাঁস, পানকৌড়ি, সাদা বক, রামকুড়া, পিয়ারী, শামুককৌড়ি, ল্যাঞ্জা হাঁস, কালো হাঁস, কুড়া, চখাচখি, চাতক, চিত্রা শালিক, ডুবুরি পাখি, দেশি মেটে হাঁস, ধলাটুপি পাঁয়রা, নিশি বক, পাতি তিলিহাঁস, বালু নাকুটি প্রভৃতি নানা প্রজাতির দেশি-বিদেশি পাখি দলবেঁধে ছুটে আসত। সেই চেনা দৃশ্য আজ আর দেখাই যায় না।
সারা পৃথিবীতে বাসরত প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখির মধ্যে এক হাজার ৮৫৫ প্রজাতির পাখি পরিযায়ী বা যাযাবর স্বভাবের। অর্থাৎ ১৯ শতাংশ প্রজাতির পাখি সমগ্র বিশ্বের কোথাও না কোথাও ভ্রমণ করে। এর মধ্যে প্রায় ২৩০ প্রজাতির পাখি পরিযায়ন করে আসে বাংলাদেশে। দেশি এবং পরিযায়ী মিলিয়ে বাংলাদেশে বিচরণ করে প্রায় ৬০০ প্রজাতির পাখি (তথ্যসূত্র : ড. রেজা খান, বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী, দ্বিতীয় খণ্ড)।
৩৩১ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে নাসিরনগর উপজেলা। এর উত্তরে হবিগঞ্জ জেলার লাখাই ও কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলা। দক্ষিণ-পূর্বদিকে মাধবপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা। আর পশ্চিমে মেঘনা নদী। জেলা সদর থেকে নাসিরনগরের দূরত্ব প্রায় ২৮ কিলোমিটার। জেলার উত্তরে অবস্থিত এ হাওরবেষ্টিত নাসিরনগর অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকা। মেঘনা নদীর শাখা গিয়ে মিলিত হয়েছে নাসিরনগরের মেদীর হাওরের লঙ্গন, বলভদ্র, কচরাবিল, আঠাউরি, খাস্তি ও চিকনদিয়া উপনদীর সঙ্গে। এখানে
বেশ কিছু হাওর, বিল ও মরা নদী রয়েছে। এগুলোর মধ্যে পরিযায়ী পাখির জন্য মেদীর হাওরই বিখ্যাত।
সরেজমিন দেখা যায়, এসব নদ-নদী ও খাল-বিলের আশপাশে গত কয়েক বছরে পরিবেশ আইনকে তোয়াক্কা না করে গড়ে উঠেছে জনবসতি ও ইটভাটা। উপজেলার সবচেয়ে বড় বিল আঠাউরি গিয়ে কথা হয় জেলে তাপস দাস ও রবি দাসের সঙ্গে। তারা জানান, হাওরে উঁচু জমিতে সবাই এখন ধানের চারা রোপণে ব্যস্ত। তাই পাখি নিরাপদে থাকতে পারছে না। সে জন্য অতিথি পাখির উপস্থিতি কমে গেছে। তাদের মতে, হাওরে প্রচুর লোকসমাগম থাকে বলে পাখি আসে কম।
নাসিরনগরের ভিটাডুবি গ্রামের জেলে অনিল দাস বলেন, ‘সবকিছুই তো দিন দিন কমতাছে। আমরা যহন ছোড আছিলাম তহন দেখছি, গাছের ওপরে বইয়্যা পাখিগুলা ডিম পাড়ত; কিন্তু বড় বড় গাছ সব কাইট্টা লাইছে, হের লাইগ্যা পাখি অহন আর ডিম পাড়তে আয়ে না। মানুষের ভয়েও অহন আর পাখি আমরার বিলে আয়ে না। এই বিলে আগে রাজ্যের মাছ পাওয়া যাইত, কিন্তু অহন নাই। মাছ যিমুন হারাইছে, পাখিও হারাই গ্যাছেগা।’
হাওর লাগোয়া স্থানীয় বালিখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহিনুর রহমান বলেন, হাওরের পরিবেশ আর আগের মতো নেই। তাই পরিযায়ী পাখির পরিমাণ প্রতিবছরই কমছে।
নাসিরনগরের এ হাওর নিয়ে গবেষণার কাজে বেশ কয়েকবার এখানে এসেছিলেন পাখি বিশেষজ্ঞ শরীফ খান। মোবাইল ফোনে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, পরিযায়ী পাখিরা হাওরের জলে ভেসে ভেসে ফসল সাবাড় করলেও ওরা প্রতিদিন সেখানেই প্রচুর বিষ্ঠা ত্যাগ করে। ফলে যে কোনো ধরনের ফসলের গাছগাছালির জৈব সারের চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। অন্যদিকে মাছগুলো পাচ্ছে ওদের উপযুক্ত খাবার। এতে ফসলের গাছ যেমন দ্রুত বৃদ্ধি পায়, তেমনি মাছেরও ওজন বাড়ে দ্রুত। এত উপকার করেও পাখিরা মানুষের হিংস্র থাবা থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। খাদ্যের সন্ধানে এসে পাখিরা নিজেরাই খাদ্যে পরিণত হচ্ছে। অথচ এসব দেখার যেন কেউ নেই।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মাধব দীপ প্রতিবছরই হাওরে আসেন পাখি দেখতে। কিছুদিন আগে এসে শীতের পাখি দেখতে না পেয়ে হতাশ তিনি। দুঃখ করে বলেন, আমি এ এলাকারই ছেলে। ছোটবেলা আমরা দলবেঁধে হাওরে পাখি দেখতে আসতাম। গত কয়েক বছরে পরিযায়ী পাখির অনুপস্থিতি এটাই জানান দিচ্ছে যে, এখানকার জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। তিনি বলেন, যে বিলজুড়ে আগে পাখি নামত, সেখানে এখন মানুষ কৃত্রিমভাবে মাছ চাষ করছে। পাখি আসবে কীভাবে?
এদিকে, পরিযায়ী পাখির জন্য অনুকূল পরিবেশ না থাকার কথা বলেছেন খোদ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সুমন ভৌমিক। তিনি বলেন, পরিবেশ অনুকূলে না থাকায় কয়েক বছর ধরে হাওরে পাখি কমছে। আমরা চেষ্টা করছি নানা উদ্যোগ নিতে। আশা করি, আবারও পাখি ফিরে আসবে আগের মতোই।
নাসিরনগর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অঞ্জন কুমার দেব বলেন, হাওরে এখন আগের মতো পাখিশিকারি নেই। তবে পরিযায়ী পাখির জন্য হুমকি হতে পারে এমন সব কার্যক্রম বন্ধে উপজেলা প্রশাসন সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে।
নাসিরনগর সরকারি কলেজের জীববিজ্ঞানের শিক্ষক জিয়া উদ্দিন বলেন, হাওর, খাল-বিল, জলাশয় থেকে নির্বিচারে পরিবেশবান্ধব শামুক-ঝিনুক নিধন করার ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি মাছের পরিমাণ যেমন কমছে, কমছে পাখিও। তিনি বলেন, শামুক-ঝিনুক হচ্ছে প্রাকৃতিক ফিল্টার। এগুলো মরে গিয়ে মাংস ও খোলস পচে জমির মাটিতে প্রাকৃতিকভাবে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও পটাশ তৈরি করে। এতে পাখির জলজ খাবার তৈরি হয়। শামুক-ঝিনুকের অভাবে দেশি মাছের বংশবিস্তার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দেশি মাছসহ নানা প্রজাতির জলজ প্রাণি ও পাখির প্রাকৃতিক খাবারের উৎস।
স্থানীয় বাসিন্দা আজিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, পরিযায়ী পাখি আমাদের দেশের জন্য আশীর্বাদ। এসব পাখি আমাদের প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করছে। তাই উপযুক্ত পরিবেশ সুরক্ষায় প্রশাসনের অচিরেই উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
বাংলাদেশ সময়: ৭:৪৪:৩২ ১০৪৩ বার পঠিত