বঙ্গ-নিউজঃ নইমাকে নিয়ে নিকুঞ্জের একটা ফ্ল্যাটে উঠেছে নেহাল ।
নানা ধরনের ব্যবসা- বাণিজ্য আর ব্রোকারি থেকে তার আয় স্ফীত হচ্ছে । বলা চলে, তেড়েফুঁড়ে আঙুল ফুলে কলা গাছ হওয়ার পথে অনেক পা এগিয়েছে । এই মুহূর্তে এই নিকুঞ্জেই অন্তত হাজার দুএক বর্গফুটের একটা ফ্ল্যাট সে কিনতে পারে । নইমা লক্ষ করেছে , ইদানিং নেহাল কিছুটা পানাসক্তও । হুইস্কি, ব্রানডি, কিংবা বিয়ারের গন্ধ নিয়ে টলতে টলতে যখন গভীর রাতে বাসায় ঢুকে তখন নইমা শাড়ির আঁচলে নাক ঢাকে , ঘেন্নায় নাক কোঁচকায় ।
আজ রাত অনেক হয়েছে । সেই কখন থেকে খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে নেহাল আসবে বলে । অথচ ফেরার নাম নেই; এমন কি মোবাইল ফোনটা পর্যন্ত বন্ধ। একটু ঝিমুনি ধরতেই হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠে । হাসি ছড়ানো মুখে নইমা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয় কিন্তু সব চাওয়া পাওয়া হয় না।
‘ সরি, আমি খেয়ে এসেছি ‘ - বলে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় নেহাল।
এসব দেখে নইমা গুমরায় । মেইন বেডরুমের পাশের রুমে বাতি নিভিয়ে মিউজিক প্লেয়ারে গান শুনে - ‘কি আশায় বাঁধি খেলাঘর বেদনার বালুচরে/ নিয়তি আমার ভাগ্য লয়ে যে নিশিদিন খেলা করে … বেদনার বালুচরে ।‘ গান শুনে আর চোখে টলটল করে দু’ ফোঁটা জল।
এমন কিন্তু তো হবার কথা ছিল না।
নইমা দেখতে বেশ সুন্দরী , শিক্ষিত মেয়ে -ইকনোমিকসে এম, এ। তার পিতা জাঁদরেল এক অধ্যাপক। সম্পদ নয়, শুধু সুখের মুখ দেখার জন্য দীর্ঘদিনের পরিচিত ক্লাস ফ্রেন্ড নেহালকে ভালবেসে বেছে নিয়েছে । গরিব ঘরের হলেও নেহাল দেখতে সুদর্শন , চলাফেরা ও কথাবার্তায় বেশ স্মার্ট । ধনের নয়, মনের মিলই আসল কথা।
তার চেয়েও বড় একটা কারণে নেহালের প্রতি নইমার অগাধ শ্রদ্ধা –প্রসূত অন্ধ আকর্ষণ । নেহাল এক সময় প্রগ্রেসিভ পলিটিক্সে জড়িত ছিল; বিপ্লবের বহ্নি শিখা বুকে বয়ে বেড়াতো , সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ওৎপ্রোত জড়িত থেকে গান গাইত, এমনকি নাটকে অভিনয় করতো। এসবই ছিল নইমার চাওয়া – নাথিং এলস । আত্মীয়স্বজনের সমালোচনা সত্তেও বিয়ে করে সে খুশী । সো ফার সো গুড ।
কিন্তু বিয়ের পর , বিশেষত ব্যবসাবাণিজ্যের বিস্তৃতির প্রেক্ষিতে একি চালচলন নেহালের। আজকাল তার কাছে সাহিত্য, সংস্কৃতি , রাজনীতির খবর থাকে না, কেবল কর্পোরেট সেক্টর আর কাঁচা পয়সার কিসসা। নইমা চায় গান কিংবা আবৃত্তি শুনতে অথচ সে শোনায় গাড়ি- বাড়ি আর উপরে উঠার সিঁড়ির গল্প ।
আজকাল আদর্শ , মূল্যবোধ গন উইথ দ্যা উইন্ড, নইমা – একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে নেহাল।
বেলা এগারোটায় নেহালের ঘুম ভাঙল। যথারীতি নইমা বেড -টি নিয়ে নেহালের কাছে গেল । কাল রাতে কিছু না খেয়ে কেঁদে কেঁদে সে যে পাশের রুমে ঘুমিয়ে পড়েছিল, সেটা বুঝতে দিল না । ভাবল , ঝোপ বুঝে কোপ মারাই বুদ্ধিমানের লক্ষণ।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নইমার থুতনিতে টোকা দিয়ে নেহাল নিমীলিত চোখে বলল , থ্যাঙ্কস । ভাবটা এমন যে গতরাতে কিছুই হয় নি।
বিছানা গোছাতে গোছাতে নইমা বলল, শুনেছিলাম মদ্যপেরা মাতাল হলে মাতলামির সব কথা ভুলে যায় । এখন দেখছি মোটেও ভুল শুনিনি ।
ফ্রেশ হয়ে এসে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসল নেহাল । নইমাকে বলল, আজ কিন্তু তোমাকে নিয়ে সারা দিন এদিকওদিক ঘুরাঘুরি করবো , লাঞ্চ হবে বাইরে এবং আজ রাতটা কাটাবো কোন এক ফাইভ স্টার হোটেলে।
ফাইভ স্টার হোটেলে কেন?
তোমাকে নিয়ে ফাইভ স্টার হোটেলে একটা রাত কাটাই ; সারারাত গল্প করি, গান গাই, দুজন দুজনকে ভালবাসি , জড়িয়ে ধরি… অসুবিধা কিসের? ফাইভ স্টার পরিবেশে শুধু একটা রাত হারিয়ে যেতে মন উচাটন ।
বাসায় বুঝি ভালবাসা হয় না?
হয়, হয় । লোয়ার মিডল ক্লাসের ভালবাসা বাসায় হয় – সবাইকে নিয়ে, সবার সাথে – মোল্লার দৌড় যেমন মসজিদ পর্যন্ত। কিন্তু বিয়নড দ্যাট , অর্থাৎ ধনীর বন্ধনীতে , স্বামীস্ত্রী হানিমুনে বিদেশে যায়, দেশের ভেতর থাকলে ফাইভ স্টার হোটেলে রাত কাটায়। থার্টি ফার্স্ট নাইটে কি হয় জাননা বুঝি?
কিন্তু অত টাকা?
ডোন্ট ওরি , মেরে পাস মে মানি হ্যায়। ঠারেঠোরে তুমি নিশ্চয় স্বীকার করবে, বৃষ্টির ঝাপটা খাওয়া মাচানের লাউডগার মতো আমার অর্থনৈতিক অবস্থাও লকলকিয়ে উঠছে । নইমার গালে গাল চেপে বলল, তিন কোটি টাকার একটা ডিল ফাইনালের অপেক্ষায় …কোথা তোম কোথা হাম…।
নইমা চুপ করে শুনছে , চোরা –চোখে নেহালের কথাবার্তা লক্ষ করছে কিন্তু হিসাব মেলাতে পারছে না।
লুক হানি, নেহাল বলে চলে, খদ্দেরের পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ঝোলা কাঁধে জীবন চালিয়ে বুঝেছি এতে জীবন উৎসর্গ করা যায় কিন্তু উপভোগ করা যায় না। বাই এনি মিনস আমি জীবনকে উপভোগ করতে চাই । জীবন তো একটাই , বিয়েও…।
নইমা মুচকি হাসে আর চায়ের কাপে চামচ নাড়াতে নাড়াতে নেহালকে দেখে।
অমন করে আমার দিকে স্থির চোখে কি দেখছ?
দেখছি আর ভাবছি, ‘তুমি আর নেই সে তুমি। জানিনা জানিনা কেন এমন হয়…।‘
আগে তো ফটাফট রেডি হয়ে নাও , তারপর জানবে কেন এমন হয় । টাইম ইজ মানি।
অধ্যাপক আব্দুল বায়েস
সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ১৬:০৯:৩৩ ৪৮০ বার পঠিত