বঙ্গ-নিউজঃ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নই নতুন সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে থাকছে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, ২০২১ সালে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ে উন্নীত করার পাশাপাশি লক্ষ্য অনুযায়ী দারিদ্র্য কমিয়ে আনা ও তরুণ প্রজন্মের জন্য ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে বড়রকম প্রত্যাশা রয়েছে, সে লক্ষ্যে অবকাঠামো উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এক্ষেত্রে নতুন প্রকল্পের পাশাপাশি বিগত মহাজোট সরকারের আমলে যেসব বড় ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে নতুন সরকার আরও মনোযোগী হবে। মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে পুরোদমে চলছে পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের কাজ। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশের বৃহত্তম এই প্রকল্পটির কাজের অগ্রগতি হয়েছে প্রায় ৬২ শতাংশ। ফলে আগামী ডিসেম্বরে নির্ধারিত সময়ে কাজটি শেষের ব্যাপারে শঙ্কা রয়েছে সংশ্লিষ্টদের। অপরদিকে ছুটির দিনেও চলছে ঢাকার মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ। এমনকি নির্বাচনের সময়ও কয়েক শিফটে কাজ চলেছে রাজধানীর এই উড়াল রেলপথ নির্মাণ দ্রুততর করতে। এরই মধ্যে মাটি ফুঁড়ে উঠে গেছে মেট্রোরেলের পিলার। এসব খুঁটিতে আগামী জুনে রেলপথ বসানোর কাজ শুরু হতে পারে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। পাশাপাশি পায়রা বন্দর, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজও চলছে দ্রুতগতিতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হলে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের যে সংযোগ তৈরি হবে তাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে ১ দশমিক ২ শতাংশ। আর দারিদ্র্য হ্রাস পাবে ০ দশমিক ৮৪ শতাংশ। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার যে মেগা প্রকল্পগুলো গ্রহণ করেছে, এগুলোর গুণগত মান ঠিক রেখে দ্রুততর সময়ে বাস্তবায়ন করতে পারলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি পূরণ হবে। তিনি বলেন, কিছু টেকনিক্যাল কারণে পদ্মা সেতুর কাজ বিলম্বিত হয়েছে। জঙ্গি আক্রমণের কারণে ঢাকা মেট্রোরেলের কাজও কিছুটা পিছিয়ে গেছে। এরপরও এ দুটো বৃহৎ প্রকল্প দ্রুতগতিতে শেষ করার প্রক্রিয়া চলছে। এমনকি ছুটির দিনেও কাজ চলছে। এসব বৃহৎ প্রকল্পের পাশাপাশি সারা দেশের রাস্তাঘাটগুলোকেও একযোগে সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেওয়ার বিষয়টি নতুন সরকারের অগ্রাধিকারে থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
কী রয়েছে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে : ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ গত ১৮ ডিসেম্বর তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিল, ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ২০২১ পালনকালে হবে মধ্যম আয়ের দেশ। ২০৩০ সালে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় হবে ৫৪৭৯ ডলারেরও বেশি। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সার্বিক দারিদ্র্যের হার শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে। ২০২১ থেকে ২০৪১ অর্থাৎ ২০ বছর বাংলাদেশকে প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধির গড় হার ৯ শতাংশ ধরে রাখতে হবে।’ মেগা প্রকল্প সম্পর্কে দলটির ইশতেহারে বলা হয়, ‘দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধিত হবে এবং সেই সঙ্গে মানুষের কর্মসংস্থান, আয় ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে বহুগুণ।’
যেভাবে এগোচ্ছে মেগা প্রকল্প : সরকারের যে ১০টি বৃহৎ প্রকল্প রয়েছে সেগুলোর কাজ দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সভাপতি করে ‘ফার্স্ট ট্র্যাক মনিটরিং কমিটি’ নামে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয় ২০১৩ সালে। কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবকে সভাপতি করে গঠিত হয়েছে ‘ফার্স্ট ট্র্যাক টাস্কফোর্স’। এই কমিটি নিয়মিত মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন কার্যক্রম পর্যালোচনা করছে। গত জুন পর্যন্ত মেগা প্রকল্পের যে অগ্রগতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয় সে অনুযায়ী পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ সন্তোষজনক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য প্রকল্পগুলোর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় পর্যায়ে মূল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি টাকা। শুরু থেকে গত জুন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। গত জুন পর্যন্ত রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সার্বিক অগ্রগতি দেখানো হয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ১৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। এ পর্যন্ত ব্যয় প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। গত জুন পর্যন্ত মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সার্বিক অগ্রগতি দেখানো হয়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ, যার মধ্যে আর্থিক অগ্রগতি ১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১ হাজার ১২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে। জুন পর্যন্ত এ প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৭১৭ কোটি টাকা। পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি ১৩ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হচ্ছে ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা, প্রকল্পের শুরু থেকে গত জুন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া রামু-মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৭ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ১৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। গত জুন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ১০৭ কোটি টাকা। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) প্রফেসর শামসুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে দেশের চেহারা পাল্টে যাবে। এসব প্রকল্প নিয়ে সরকারের বড় আকারের প্রত্যাশাও রয়েছে। এক পদ্মা সেতু নির্মাণ হলে জিডিপিতে অতিরিক্ত এক শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি যোগ হবে। মেট্রোরেল চালু হলে ঢাকার যানজট অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসবে। পায়রায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ হলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য আরও বাড়বে। তিনি বলেন, মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আনতে মহাজোট সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এখন এই প্রকল্পগুলোর কাজ যাতে সঠিক সময়ে শেষ হয় সে বিষয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। তবেই সরকারের সে প্রত্যাশা পূরণ হবে।
বাংলাদেশ সময়: ৮:০৫:২২ ৩৮০ বার পঠিত